থাবা (১ম পর্ব)

১.
বেলা এখনও পড়েনি, কিন্তু তবু চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে।

আষাঢ় মাসে সুন্দরবনের স্বরূপ বুঝি এমনই হয়, ভাবছে সজীব। অদ্ভুত থমথমে ভাব, গায়ে কাঁটা দেয়া নীরবতা। অন্ধকারের মাঝে বুঝি ওঁৎ পেতে আছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, শিকারের গায়ে আচমকা থাবা বসিয়ে দেয়ার মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায়।

সজীব আর ভাবে না। গাইডের দেখানো হরিণের কংকালটা পার হয়ে কাঠের ট্রেইল ধরে অনেক দূর এগিয়ে গেছে সে আর তার বন্ধু রনি। রনিটা আজীবনই বেপরোয়া ছিল, কিন্তু আজকে মনে হচ্ছে একটু বেশিই পাগলামি করছে। গট গট করে হেটে কই যে চলে গেছে। দূরে আরেকটা লোককে দেখা যাচ্ছে মুখে ডিএসএলআর ক্যামেরা লাগিয়ে ছবি তুলতে। এই অন্ধকারে ছবি! পাগলের তাহলে অভাব নেই এই দেশে!

একটু পরই গাইড হুইসেল বাজানো শুরু করলো দূর থেকে, অন্ধকার নেমে এসেছে বলে আগেই সবাইকে ফিরতে নির্দেশ দিচ্ছে। কিন্তু রনির কোন বিকার নেই। হাতে একটি বল দিয়ে এক হাতে ছুড়ছে আর ধরছে বারবার। “ব্যাটা, জানি তো তুই ভালো খেলিস, তাই বলে এই গা ছমছমে পরিবেশে তোর এভাবে ভাব ধরতে হবে?” সজীব মনে মনে বন্ধুকে দুইটা গালি না দিয়ে পারেনা। তারপরেই হঠাৎ, শুরু হয়ে গেল ঝুম বৃষ্টি।

দুই বন্ধুই দৌড় দেয়- সজীব সামনে, আর পিছে রনি। সজীবের ঠান্ডার সমস্যা আছে, তাই বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার তাড়াটাও তার বেশি। হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে পড়ার শব্দ শুনে থমকে যায় সজীব, কিন্তু থামে না। একেবারে গাইডের ছাতার তলে পৌঁছেই দম নেয়। কিন্তু একি, রনি নেই পাশে! পিছনে তাকাতেই যেন মাথায় বাজ পরে- বেশ দূরে রনি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ব্রিজের উপর!

“রনিইই”, এক চিৎকার দিয়ে বন্ধুর উপুড় হয়ে পড়া, ভেজা শরীরের কাছে ছুটে যায় সজীব, তার পিছে ছুটে যায় গাইড ও। কোন সাড়া শব্দ নেই। রক্তের যদিও দেখা নেই, তবে এত অন্ধকার আর বৃষ্টিতে সেটাই স্বাভাবিক। পড়ার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে, কোন ভাবে পরে গিয়ে কাঠের রেলিং এ মাথায় বাড়ি খেয়েছে। এক হাত শরীরের নীচে চাপা পড়েছে রনির, বাকি হাতটা নিয়ে পালস দেখে সজীব। পালস নেই! হায় আল্লাহ! আবার দেখে। আবারও একই ফল, কোন পালস নেই!

গাইড ও পালস দেখে, এক বারই। দেখেই ঘটনা বুঝে যায়। “আপনি দাঁড়ান আমি সাহায্য নিয়ে আসছি” বলেই সে ছুটে যায়। কিন্তু সজীব দাঁড়ায় না, সে ও হাঁটা শুরু করে। প্রথমে আস্তে, পরে জোরে। তারপর দৌড়। প্রচন্ড ভয় গ্রাস করেছে তাকে। কিসের ভয় সে জানে না, একটাবারও পিছনে তাকায় না। যেন পিছে তাকালেই কেউ মুখের উপর তৎক্ষণাৎ বসিয়ে দিবে- এক ভয়াল থাবা!

২.
“কি মনে হয়? রহস্যের ঘ্রাণ পাওয়া যায়?” পায়ের উপর পা তুলে, চেয়ারে হেলান দিয়ে, ছোট ভাইয়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন ইন্সপেক্টর আজাদ সাহেব। ভাই তার বিছানায় বসা, এত ইন্টারেস্টিং কাহিনী শুনানোর পরও মুখের অভিব্যক্তিতে কোন পরিবর্তন নেই।

“বৃষ্টির দিনে পিছলে পড়ে মাথায় বাড়ি খেয়ে যে কারো সিভিয়ার ইনজুরি হতে পারে, যা সাথে সাথেই মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম। অথবা হঠাৎ কার্ডিয়াক এরেস্ট এর পরই পড়ে গিয়েছিল, এমনটাও হতে পারে। শুধু এটুকু তথ্য থেকে তো রহস্য আছে কিনা বুঝা যাবে না।” মেডিকেল স্টুডেন্ট সাদিকের স্পষ্ট জবাব।

নাহ, ছেলেটা দিন দিন আরো বেশি আবেগহীন রোবট হয়ে যাচ্ছে- বুঝলো ইন্সপেক্টর। ছোটবেলা থেকেই সাদিকের ডিটেক্টিভ গল্পে আগ্রহ। এই নিয়ে প্রচুর বই পড়ে অনেক জ্ঞান অর্জন করেছে, কিন্তু বাস্তবে তা কাজে লাগানোর সুযোগ হয়নি কখনো। তার পুলিশ ভাই তাকে আজ একদম বাস্তবের রহস্যময় ঘটনা বলে তাক লাগিয়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু তা আর হলো না। তবে আশার কথা এই যে, তুরুপের তাসটা এখনও ব্যবহার করা হয়নি!

সাদিক নিজ দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “লাশের অটোপসি রিপোর্ট কি বলে?”

এবারে তার বড় ভাই সামনে ঝুঁকে বসে, এক হাত দিয়ে চেয়ারের হাতলে ঘুষি দিয়ে বললেন, “সেখানেই তো আসল কাহিনী! ফিরে গিয়ে সবাই দেখলো যে লাশ নাই! নাই মানে হাওয়া! হাওয়া মানে মিসিং!”

-“কিইইহ?”
-“জ্বীইইই!”

অবশেষে সাদিককে চমকে দেয়া গেল। তার বড় ভাই এবার খুশি, তবে সেটা প্রকাশ না করে বললেন, “লাশ না পাওয়ার পিছে দুইটা লজিক পাওয়া যায়। এক, কেউ লাশ হাওয়া করে দিয়েছে। দুই, লাশ বাঘ এসে টেনে নিয়ে গেছে। তোর কি মনে হয়?”

-“এটুকু তথ্য থেকে বোঝা মুশকিল। তবে আমার মনে হচ্ছে প্রথমটা।”
-‎”কিন্তু… কিন্তু কে সড়ালো লাশ?”
-‎”সেটা তো আর প্রমাণ ছাড়া বলা যাবে না।”
-‎”গাইডের সাক্ষ্য অনুযায়ী কিন্তু সজীব দায়ী না মৃত্যুর জন্য। কারণ গাইড দুজনকেই দৌড়ে আসতে দেখেছে এবং একজন নিজে থেকে পড়ে গেছে এটাও সে দেখেছে। কিন্তু লাশটার কি হলো তা আর কেউ বলতে পারে না। আমার মনে হচ্ছে এটা বাঘের কাজ হলেও হতে পারে। কারণ, দেখ…”

সাদিক কোন মন্তব্য করেনা, কোন কথাও আর শুনতে পায় না। তার মন এখন সুন্দরবনের গহীন জঙ্গলে ঘুরছে আর হন্য হয়ে খুঁজছে একটা হারিয়ে যাওয়া ‘লাশ’!

৩.
-“হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।”
-‎”ওয়ালাইকুম আসসালাম। হ্যাঁ রে সাদিক, তুই কই বলতো?”
-‎”আমি ক্লাস শেষে ফিরছি বাসায়, কেন?”
-‎”কলের মিস্ত্রী আজ বলেছে বেসিনটা ঠিক করার জন্য সময় দিতে পারবে। তুই বাসায় থাকিস তো বিকাল বেলায়।”
-‎”আচ্ছা। থাকবো ইন শা আল্লাহ। তুমি কখন আসবে, ভাইয়া?”
-‎”আমার আসতে দেরি হবে মনে হয়। কালকে যে কেস এর কথা বলেছিলাম না? ওইটার কাজে এসেছিলাম নিহতের বাসায়, বুঝলি। এসে দেখি আরেক কান্ড- নিহতের ওয়াইফও নিহত হয়েছে গতকাল রাতে!”
-‎”ইন্না লিল্লাহ! কি করে?”
-‎”সুইসাইড কেস। ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলেছে বেচারি। দুইদিন আগে মরা স্বামীর শোকে মনে হয়। একটা সুইসাইড নোট রেখে গেছে। কাগজে লেখা না, মোবাইলে ওয়ালপেপার হিসেবে সেট করে গেছে! এই হলো ডিজিটাল যুগ!”
-‎”তাই? কি লেখা ছিল ওতে?”
-‎”লেখা ছিল- আমি চললাম আমার স্বামী আর সন্তানের কাছে; আব্বু, আম্মু আমায় মাফ করে দিও।”
-‎”বাসায় সেদিন কে কে ছিল? কোন স্ট্রাগল এর নমুনা পাওয়া গেছে?”
-‎”বাসায় ছিল শুধুমাত্র বুড়া শ্বশুর…ওয়েট ওয়েট, তুই কি এখানেও রহস্য দেখলি?”
-‎”এখনো বলতে পারি না। একটা সামান্য খটকা মাত্র। লাশ পরীক্ষা করতে নিয়েছে না?”
-‎”হ্যাঁ, তা নিয়েছে।”
-‎”তুমি ওখানেই আছো না?”
-‎”হ্যাঁ, আছি।”
-‎”তুমি একটু ভালো করে ঘুরে দেখো কোন সন্দেহজনক কিছু পাও কিনা। দরজা, জানালা চেক করে দেখো ব্রেক ইনের আলামত আছে কিনা। ওই মোবাইলটা কিন্তু খুব ইম্পরট্যান্ট এসেট এই মামলায়।”
-‎”বাপরে বাপ! আচ্ছা, দেখবো আমি নিজে ইনভেস্টিগেট করে কিছু পাই কিনা। যাইহোক, তুই রাতের তরকারিটা গরম করে দুপুরে খেয়ে নিস। রাখি এখন।”

ফোন রেখে রিকশায় বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে যায় সাদিক। কেন জানি তার মনে হচ্ছে দুইটা ঘটনা একে অপরের সাথে জড়িত। কিন্তু কি করে? সাদিকের জানা নেই। কিন্তু সত্যটা উদ্ধার না করতে পারলে যে মনে শান্তি পাবেনা এটুকু সে ভালোই জানে।

৪.
আবারও সাদিকের রুমে রাত্রিকালীন বৈঠক, অংশগ্রহণকারী সেই দুজনই। বয়োজ্যেষ্ঠ ভাই বিছানায় বসা আর কনিষ্ঠ জন চেয়ারে। কথা শুরু করলেন আজাদ সাহেব- “আজকে পাওয়া সব ইনফরমেশন এবার বলি তাহলে, শোন। তিথী, মানে আমাদের সেকেন্ড ভিক্টিমের অটোপসি রিপোর্ট অনুযায়ী তার শরীরে কোন হাতের ছাপ বা বাড়তি ইন্টারনাল ইনজুরির আলামত পাওয়া যায়নি।”

সাদিক যেন একটু আশাহতই হয়। তার ভাই আরো বলে, “কিন্তু…. তিথীর শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। সব গুলোই পুরোনো, কোনটাই তাজা না।”

সাদিক এবার নড়ে চড়ে বসলো। হ্যাঁ, রহস্যের ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে এবার। তার ইনটিউশন একদম ভুল না হয়তো!

“চিহ্ন বলতে সিগারেটের ছেকা, বেল্টের দাগ সহ অসংখ্য আঁচড় এর দাগ। যে টর্চার গুলো করেছে, সে বেশ হিংস্র ভাবেই করেছে। একেবারে পশু যেন! এখন কথা হলো, সেই পশুটা কি রনিই নাকি অন্য কেউ? দারোয়ান ও প্রতিবেশীর থেকে জানা গেছে, তিথীর সাথে তার হাসবেন্ড রনির ইদানিং নাকি প্রায়ই তুমুল ঝগড়া হত।” এই পর্যন্ত বলে ইন্সপেক্টর আজাদ থেমে যান। কারণ আর কিছুই না, লোডশেডিং।

সাদিক নিজের মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইটটা অন করে দিয়ে বিছানায় রাখে। সেই হালকা আলো তার বড় ভাই এর মুখের উপর পড়ে কেমন এক ভুতুড়ে ভাব এনে দিয়েছে। সাদিক ভাইকে মনে করিয়ে দিল, “হাজবেন্ডের সাথে ঝগড়া হত… তারপর?”

“ওহ, হ্যাঁ… ঝগড়া। ঝগড়া গুলো সবাই টের পাওয়া শুরু করে এক মাস আগে তাদের বিশদিন বয়সী ছেলেটা মারা যাওয়ার পর থেকে। তিথীর চিৎকার করে কান্না নাকি দিনে প্রায় প্রতিদিনই সবাই শুনতে পেত। যেদিন শুনতো না বুঝতো যে তিথী বাড়ি নেই। ওর শরীরও নাকি গত এক মাসে একদম ভেঙে গিয়েছিল।”

“হুম, বাচ্চার শোক কাটানো কষ্টকর।” -সাদিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো।

-“হ্যাঁ, বিশেষ করে মায়ের পক্ষে।”
-‎”ফোনটার থেকে কিছু পেলে?”
-‎”ফোনটার সব ডাটা এনালাইসিস করতে দেয়া হয়েছে। এখনো কিছু জানিনা।”
-‎”আচ্ছা, এই রনি নামের লোকটা কি করত বলোতো?”
-‎”রনি নাকি কয় মাস হল কি বিজনেস শুরু করেছিল, অন্তত ওর একমাত্র ভাই রবিন তাই বললো। খুব একটা নির্দিষ্ট করে বলতে পারল না কিসের বিজনেস, নতুন বলেই নাকি।”
-‎”আর এই রবিন নিজে কি করে? কই থাকে?”
-‎”রবিন একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে বিবিএ পরে,থার্ড ইয়ারে। রনির বাড়িতেই থাকে। তবে সেই রাতে নাকি বন্ধুর বাড়িতে ছিল। দারোয়ানও সাক্ষ্য দিয়েছে।”
-‎”হুমমম। আর রনির বাবা?”
-‎”বাবা তো একদম বুড়া আগেই বলেছি। ঠিক মত চলতে ফিরতেই পারে না। তাকে তুই সাস্পেক্ট লিস্ট থেকে অনায়াসে বাদ দিতে পারিস।”
-‎”দরজা ভাঙার চেষ্টা হয়নি?”
-‎”নাহ। কোন এভিডেন্স নাই অন্তত। হয় এটা সুইসাইড কেস আর নাহয় খুব চতুর কোনো মার্ডারার এর কাজ। বাই দা ওয়ে, এটা কি তোর নতুন মুদ্রাদোষ নাকি স্টাইল?”

ভাইয়ের কথায় হকচকিয়ে গেল সাদিক, নিজের দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিল সে। ঠাট্টাটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লাগলো। তারপর ফিক করে হেসে দিলো।

বড় ভাই আরো বললেন, “নট ব্যাড, নট ব্যাড! সব গোয়েন্দাদের একটা করে ট্রেডমার্ক থাকে। ফেলুদার চারমিনার, হোমসের পাইপ… তুইতো ওসব খাস না, তোর জন্য এটাই ঠিক আছে! আফটার অল, তুই হচ্ছিস ‘হুজুর গোয়েন্দা’!”

সাদিক আবারও হাসলো, এই নাম তার ভাই তাকে কিছুদিন আগে দিয়েছে। তারপর সে উঠে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ পায়চারী করলো। অনেক ভেবে পরে বললো, “ভাইয়া, আমি রনির বাসায় গিয়ে নিজে কিছু ইনভেস্টিগেশন চালাতে চাই। সম্ভব হবে কি?”

ইন্সপেক্টর আজাদ অবাক হলেন না বরং মনে মনে খুশিই হলেন। বললেন, “তাহলে কি এই কেসটা হাতে নিয়েই নিলেন আপনি, হুজুর গোয়েন্দা?”

“আলবৎ!”

ফ্লাশ লাইটের আলো পড়ে সাদিকের চোখ জোড়া যেন অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে উঠলো। সেই সাথে ঘন চুল আর দাঁড়ি মিলিয়ে এক সিংহের প্রতিমূর্তি দাঁড়ানো যেন!

বাঘের বিপরীতে সিংহ নেমেছে, এইবার জমবে লড়াই!