থাবা (২য় পর্ব)

৫.
ইন্সপেক্টর আজাদের সাথে সাদিক এসেছে রনির বাড়ি। অল্প জমির উপর গড়া, পুরোনো ধাঁচের দোতলা বাড়ি। বাড়ির বাইরের প্রাচীর নাম মাত্র, যে কেউ টপকাতে পারবে এমন। দারোয়ানের কাছ থেকে জানা গেছে এটা রনির দাদার তৈরি। দুইতালা বাড়ি, নীচে ভাড়া দিয়ে উপরে থাকে রনির পরিবার, মানে বর্তমানে শুধু তার বাবা আর ছোট ভাই। দারোয়ানের কাছে রনির কথা জিজ্ঞেস করায় বললো-

“হুট কইরাই এমনে চইলা গেলো মানুষটা! আল্লাহর কি ইচ্ছা! বাঁইচা থাকতেও মানুষটা এমনে হুট হাট আইতো যাইতো। আমি টেরও পাইতাম না অনেক সুময়।”

দোতালায় কলিং বেল বাজাতেই সদর দরজার নব ঘুরানোর শব্দ পাওয়া গেলো। তারপরেই দরজা খুলে দিলো এক যুবক। শ্যাম বর্ণ, বেশ লম্বা, স্বাস্থ্য মোটামুটি। আজাদ সাহেবকে দেখে একটু যেন ভড়কে গেল। জিজ্ঞেস করলো, “আপনি! আবার আজকে… মানে, কি জন্য?”

ইন্সপেক্টর সাহেব বললেন, “আপনার ভাই এর মৃত্যুর ব্যাপারে আরো তদন্ত করতে এসেছি।”

“আপনাদের সত্যই মনে হচ্ছে এটা খুনের কেস? আমি তো খুব ক্লিয়ারলি বুঝতে পারছি এক্সিডেন্ট এর পর বাঘ নিয়ে গেছে লাশ। এই জন্যই বনে বাদারে ঘুরা ঘুরি আমার-“

“বাঘ খাওয়া শেষে কঙ্কাল মাটিতে পুঁতে রাখতে পারেনা। যেহেতু কঙ্কালের কোন হদিস এখনো মেলেনি, তাই এই কেস এখনই ডিসমিস করা সম্ভব না। আপনি যদি আমাদের সাহায্য করেন তাহলে হয়তো আপনার ভাই এর মৃত্যুর রহস্য দ্রুত উদঘাটন করা সম্ভব হবে।” এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে থামলো সাদিক।

“ইনি কে?” হতভম্ব রবিনের প্রশ্নের উত্তর দিলেন ইন্সপেক্টর- “ইনি এই কেসটা ডিল করছেন। ডিটেক্টিভ।”

সাদিকের মনে হলো রবিনের মুখের রংটা নিমিষেই কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কিন্তু মুখে ঠিকই হাসি ফুটিয়ে সে বললো, “বেশ তো! আসুন, ভিতরে আসুন।”

ড্রয়িং রুমে ঢুকেই সাদিক চট করে চারিদিক পর্যবেক্ষণ করে নিল। দেয়ালে টানানো কিছু পারিবারিক ছবি। একটা ছবিতে দুই ভাই দাঁড়ানো পাশাপাশি। দুইজনের ওজন, উচ্চতা একই, কিন্তু চেহারা কিছুটা ভিন্ন। রুমের কোনায় একটা শেলফে অনেক গুলা ট্রফি। ওদিকে সাদিক তাকাতেই রবিন বললো, “ওগুলো ভাইয়ার সব, ভালো খেলতো। ক্রিকেট থেকে শুরু করে টেনিস, সবই খেলতো।”

“আর এগুলো বুঝি আপনার?” আরেক কোনায় সাজানো বিভিন্ন রকমের গিটার দেখিয়ে বললো সাদিক।

-“কি করে বুঝলেন!”
-“আপনার ডান হাতের দুটি নখ তুলনামূলক ভাবে বড়। গিটার গুলোর উপর ধুলো পড়লেও, ওই উকুলেলেটা পরিষ্কার। হয় আজ নাহয় গতকাল বাজানো হয়েছে।”

একথা শুনে রবিন নিজের নখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তেমন বড়ও না নখ দুইটা, কিন্তু তুলনামূলক বড়। শখের উকুলেলেটা আজ সকালে একটু বাজিয়েছে এই কথাও ঠিক। দুই মিনিটে কি করে এত কিছু বুঝা সম্ভব?

এরপর অনুমতি নিয়ে দুই ভাই গেলো রনি আর তিথীর রুমে। আজাদ সাহেব ফিসফিস করে বললেন, “যা করার জলদি করিস, আমার টাইম কম।” সাদিক কথামত জলদি রুমটা দেখে নিলো। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রবিনকে জিজ্ঞেস করলো, “তিথীর লাশ কে প্রথমে দেখেছিলো?”
-“ময়নার মা…মানে ছুটা বুয়া আমাদের।”
-‎”আপনি সেদিন রাতে কোথায় ছিলেন?”
-‎”আমার বন্ধুর বাড়িতে। ফরিদপুরে। বেশ কয়েকদিন ছিলাম। ২১ তারিখ বিকালে ভাইয়ার মৃত্যুর খবর পেয়ে রওনা দেই সেদিন রাতেই। পরদিন সকালে পৌছাই। এসে দেখি ভাবীর এই অবস্থা।”
-‎”কয়টার বাস ছিল?”
-‎”আনন্দ পরিবহনের সাতটা পঁয়তাল্লিশ এর বাস।”
-‎”এতক্ষণ লাগলো পৌঁছাতে?”
-‎”বাস নষ্ট হয়েছিল পথে।”
-‎”আচ্ছা। আপনার ভাবীর মৃত্যুর ব্যাপারে আপনার কি মত?”
-‎”কি আবার মত। ভাবী এমনিতেই সবসময় উল্টা পাল্টা আচরণ করতো। বাচ্চাটা হয়ে মারা যাওয়ার পর থেকে একেবারে যাকে বলে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলো। এরপর ভাইয়ার মৃত্যুটা একেবারে সহ্য করতে না পেরে সুইসাইডই করে ফেলেছে।”
-‎”কিন্তু আপনার ভাই এর সাথে তো তার সম্পর্ক খারাপ যাচ্ছিল কিছুদিন ধরে, তাই না?”
-‎”আপনি কি করে…যাইহোক। হ্যাঁ, খারাপ যাচ্ছিলো। ভাবীর ব্যবহার খুব খারাপ ছিল ভাইয়ার প্রতি। হুট হাট বাসা থেকে বের হয়ে চলে যেত। কিন্তু মনে হয় ভাইয়ার মৃত্যুর পর ভাবী অনুশোচনায় ভুগছিলো। তাই সুইসাইড।”

সাদিক এরপর রুম থেকে বের হয়ে গেল। বের হতেই রনির বাবার রুম। দরজা দিয়ে সোজা বিছানা দেখা যাচ্ছে যেখানে ঘুমাচ্ছেন রনির বাবা। তাকে কিছু প্রশ্ন করার ছিল, কিন্তু ঘুমন্ত মানুষকে আর জাগাতে ইচ্ছা হলো না। রবিনকেই জিজ্ঞেস করলো, “তিথীর মৃত্যুর দিন আপনার বাবা কোন শব্দ টের পেয়েছিলেন? বা অস্বাভাবিক কিছু?”

“নাহ তো। বাবা এমনিতেই কম শোনে কানে, আর ভাইয়ার মৃত্যুর পর তো এখন মাথাতেও প্রবলেম করে। কাল রাতে ভাইয়াকে নাকি নিজের রুমে দেখেছে। আজ রাতে আবার এসে হঠাৎ জানতে চাইলো ভাইয়া কই। আসলে ভাইয়া ছিল বাবার একদম নয়নের মণি। খেলাধুলা পারতো বলে ওর কদর একটু বেশিই ছিল। বাবা তাই প্রিয় ছেলের মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না একদম।” রবিনের শেষের কথা গুলোয় কেমন যেন একটা হিংসার আভাস পাওয়া গেলো।

সাদিক এবার রবিনের ঘরের দিকে দৃষ্টি দিলো। রবিন হুট করে বললো, “আমার রুমও দেখা লাগবে… আচ্ছা যান।” রুমের ভিতর বিভিন্ন গায়কদের বড় বড় পোস্টার, সবাই বিদেশি। বিছানা, আলমারি ছাড়াও একটা টেবিল আছে রুমে, সেটা সিডিতে ঠাসা। সিডি ছাড়াও একটা বান্ডিল আছে, কালো রং এর অনেকগুলো ভিজিটিং কার্ড এক সাথে রাবার ব্যান্ডে বাঁধা। সাদিক হাতে নিয়ে দেখলো সেটা ‘আর. এন. আর. লাইফ ইন্সুরেন্স’ এর ম্যানেজার এলভিস আর. চৌধুরীর। রবিন কে দেখিয়ে প্রশ্ন করলো, “এতগুলো কার্ড দিয়ে কি করবেন?”

“মানে… ওগুলা হলো… আমার এক ফ্রেন্ডের ভাই এর। আমাকে দিয়েছে বিলি করতে। একটু পরিচিতির জন্য আরকি।”

সাদিকের হাত থেকে কার্ডগুলো নিয়ে ইন্সপেক্টর আজাদ খুব ভালো করে দেখলেন, অনেকক্ষণ কি যেন চিন্তাও করলেন, কিন্তু কিছু বললেন না। এরপর টুকটাক আরো কিছু প্রশ্ন করে তারা দুজন বাসা বের হয়ে গেলো।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ইন্সপেক্টর বললেন, “আহ, এইবার মনে পড়েছে। আর. এন. আর. লাইফ ইন্সুরেন্স… হ্যাঁ, এই প্রতিষ্ঠান এর নামেই সেদিন একজন মামলা করেছে।”

-“কিসের মামলা?”
-‎”জালিয়াতি। অনেক টাকার জালিয়াতি।”

৬.
সাদিক আজকের সারাদিনে জোগাড় করা তথ্য নোটবুকে টুকে রাখছে। তার ভাই, মানে ইন্সপেক্টর আজাদ তার কাজের জন্য বেশ প্রশংসা করেছেন। যদিও খুনের ব্যাপারে এখনো কোন সুরাহা করতে পারেনি, কিন্তু আর. এন. আর. লাইফ ইন্সুরেন্স এর কার্ডটা সে লক্ষ্য করায় তার ভাই খুবই খুশি। তার কথাতে-

“কেঁচো খুঁড়তে সাপ…না না, সাপ খুঁড়তে অজগর বের হবে কে জানতো! খুনি পাকড়াও হোক আর না হোক, এই ছেলেকে দিয়েই ওই ইন্সুরেন্স এর হোতাদের পাকড়াও করবো ইন শা আল্লাহ। ইউ হ্যাভ ডান আ গুড জব, ব্রাদার!”

সাদিক এখন আরো সিরিয়াসলি নিয়েছে কেসটা। জালিয়াতির মামলারও একটা সুরাহা করতে চায় সে। সেই সুন্দরবন থেকে শুরু হয়ে কত রকম মোড় নিয়ে মামলাটা যে কোথায় শেষ হবে কিছুই বলা যাচ্ছে না!

কলিং বেল বাজতেই নোটবুক রেখে উঠে গেলো সাদিক। সে আর তার বিপত্নীক ভাই এক বাড়িতে থাকে। আর কেউ থাকেনা তাদের সাথে। তাদের মা বাবা অনেক আগেই গত হয়েছেন, তারপর থেকে সাদিকের দেখভাল ভাইই করছেন।

-“আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া।”
-‎”ওয়ালাইকুম আসসালাম। টেবিলে ভাত লাগা তো রে সাদিক। খিদায় আমার জান যায় যায় অবস্থা।”
-‎”ভাত টেবিলে দিয়েই রেখেছি। হাত মুখ ধুয়ে বসে যেতে পারো।”
-‎”গুড! তাহলে বসেই পড়ি। খেতে খেতেই বলি তোকে। অনেক ইন্টারেস্টিং সব নিউজ!”

হাত মুখ ধুয়ে আজাদ সাহেব খেতে বসেন। সাদিক ভাত বেড়ে দেয়। তার ভাই খেতে খেতেই বলা শুরু করলেন, “প্রথমে বলি রবিনের কথা। ছেলেটা যে ভার্সিটির নাম বলেছিল সেখানে খোঁজ নিয়ে দেখেছি এই নামে কেউ পড়েনা।”
-“বলো কি!”
-‎”হ্যাঁ। আরো আছে, শোন। তিথীর ফোনের সব ডাটা এনালাইসিস করে রিপোর্ট দিয়েছে আজ। তুই অবাক হবি শুনলে, মেসেজে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি,কিন্তু গত এক মাসের কল হিস্ট্রিতে ঘুরে ফিরে খালি একটাই নাম- সজীব!”

শুনে সাদিক নিজ মনে বিড়বিড় করে বলে, “এক্সট্রা ম্যারিটাল এফেয়ার কি?”
-“এ ছাড়া আর কি হবে বল।”
-‎”প্রমাণ ছাড়া শিওর হই কি করে। যাই হোক, এই সজীব নামের লোকটা সম্পর্কে কোন ইনফরমেশন খুব দরকার। রনির মৃত্যুর সময় সেই তো কাছে ছিল।”
-‎”মংলা থানার দেয়া ইনফরমেশন অনুযায়ী সজীব একটা ব্যাঙ্কে জব করে, ঢাকাতেই থাকে। তার বাসার ঠিকানা জোগাড় করতে পারবো। কি, ঢুঁ মারতে চাচ্ছিস নাকি একবার?”
-‎”তাই তো মনে হচ্ছে!”

৭.
শ্বাসমূলের ফাঁকে ফাঁকে সাবধানে পা ফেলে এগুচ্ছে মৌয়ালের দল। সবার সামনে বহরদার, মানে তাদের দলনেতা। হঠাৎ দূরে কি যেন চোখে পড়লো তার। নৌকার দিকে না গিয়ে হঠাৎ ওই দিকে আগানো শুরু করলো সে। অন্যরা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।

রঙিন কি যেন মাটিতে পড়ে আছে। মশা আর পোকা মাকড় ভন ভন করছে চারপাশে। মধুভর্তি পাত্রটা মাটিতে রেখে সন্তর্পণে এগিয়ে গেলো বহরদার। কাছে যেতেই আঁতকে উঠলো।

মাটিতে পড়ে রয়েছে একটা আধ খাওয়া, ছিন্ন বিচ্ছিন্ন মানুষের লাশ।