থার্টিফার্স্টনামা

-হলি সুরভী

সদ্য কৈশোরত্তীর্ণ রোহান (মূল নাম রায়হান ) আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থুতনির নীচে ওঠা একগাছি পাতলা দাড়ির আভাস পেয়ে ভীষণ পুলকিত বোধ করছে। যাক অবশেষে বুঝি তাহার দেখা পাইলাম। সমবয়সী সব বন্ধুদের দাড়ি-গোঁফ অনেক আগেই উঠে গেছে।
আলভি তো এর মধ্যে তিন তিনবার শেইভও নাকি করে ফেলেছে।

সেদিন জিসান বলল যে আড়ালে আবডালে মেয়েরা নাকি তাকে হাফ লেডিস বলে ডাকে (গায়ের রং টুকটুকে ফর্সা, জিরো ফিগার আর মাখনের মত ক্লিন চিক দেখে এই নামকরণ করা হয়েছে)।

রোহান সেদিন বাসায় এসে অনেক কেঁদেছিল। এত বেশি কেঁদেছিল যে পরদিন দুই চোখ ফুলে সুপারির মত গোল গোল অদ্ভুত টাইপের গিয়েছিল।

মা তো রোহানের চোখ দেখে দিশেহারা হয়ে গেলেন। তারপর বরফের টুকরো কাপড়ে বেধে চোখে সেঁকে দিতে দিতে বললেন, “কিরে রাতভর কেঁদেছিস কেন?”

রোহান সত্যটা চেপে গিয়ে বলেছিল, “মা, নানীর কথা খুব মনে পড়ছিল। কতদিন দেখিনা!”

তীর একেবারে মোক্ষম জায়গায় গিয়ে লেগেছিল। এরপর শুরু হয়েছিল মায়ের কান্না দিবস। রাঁধতে-বাড়তে, কাজ করতে করতে চিকন সুরে কেঁদেই চলেছেন।

রোহান আহত চোখ মেলে বিরক্তি ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে মার কর্মকাণ্ড দেখছিল।

যাক সে কথা।
নিজেকে অন্যভাবে আবিস্কার করতে পেরে বেশ ভাল লাগছে আজ। রোহান নিজের পাতলা গোফ আর দাড়ি নিয়ে বীরচিত্তে স্কুলে গেল। বন্ধুরা তাহার এহেন ট্রান্সফর্ম দেখে যারপরনাই মন খারাপ। কারন এতোদিন যেভাবে খুশি সেভাবে পঁচানো গিয়েছিল, এখন তো আর সেই পথ খোলা রইলো না।
বন্ধুরা গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলতে লাগলো।

ক্লাশের একটা মেয়ের প্রতি রোহানের নেক নজর অনেক আগেই পড়েছিল ঠিকই, কিন্তু নিজের বাচ্চা বাচ্চা চেহারাটার জন্য কখনোই প্রপোজ করার সাহস করতে পারেনি। এখন নতুন করে মনের মরা গাঙ্গে আবারো ইশ্কের জোয়ার বইতে শুরু করেছে।

সমস্যা হলো, আগে মেয়েটা কথা বলত দু’এক বার। তার আনাড়ি জোকস শুনে হেসেও ছিল। কিন্তু এখন আর তেমন কথাও বলে না, কেমন যেন এড়িয়ে চলছে।

যাক সে সব কথা।

রোহানসহ আরো পাঁচজন বন্ধু মিলে ক্যান্টিন লাগোয়া পুকুরের পাড়ের মেহগনী গাছের নীচটায় বসে আড্ডা দিচ্ছিল। এমন সময় দীপ বলল, “হেই ব্রো! নেক্সট উইকে তো হ্যাপী নিউ ইয়ার। চল আমরা থার্টিফার্স্ট নাইট সেলিব্রেট করি!”

সবার তীব্রমাত্রার সম্মতিতে ধ্রুবর বাসায় পার্টির আয়োজন করা হলো। ধ্রুবর বাবা আবার মিডিয়ার সাথে সম্পৃক্ত। তাদের ঘরে এ ধরনের পার্টি একেবারেই ডালভাত।

যেই ভাবা সেই কাজ। গ্রুপ স্টাডির নাম করে সন্ধ্যার দিকে রোহান ছুটল ধ্রুবর বাসায়। আগে কখনোই সে ধ্রুবদের বাসায় আসেনি। ওদের কালচার, সোশ্যাল স্টেটাস সব কিছুর কারনেই রোহান ধ্রুবর কাছ থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলত।

গেটের সামনে আসতেই হঠাৎ করেই যেন সব আগ্রহ কর্পূরের মত উড়ে গেল রোহানের।
অস্বস্তিবোধে ছেয়ে গেছে গোটা শরীর।

নাহ আমি পারব না!

আশপাশটা ভাল করে খেয়াল করে নিয়ে রাস্তার অপর প্রান্তে গিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে রইল সে। মনে মনে ভাবল পরিচিত কেউ যখন এ পথ ধরে আসবে তখন তার সাথেই ভেতরে ঢুকে যাবে। একা একা ভেতরে যাবার সাহসটা নিভে গেছে।

বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হলো না। গেটের সামনে একটা ঝা চকচকে ব্ল্যাক কালারের নতুন কার এসে থামল। কারের ভেতর থেকে মিনি স্কার্ট পরিহিতা নিশিকে বের হতে দেখে রোহান বোকা বনে গেল।

রোহান ভাবতেও পারেনি নিশিকে এভাবে এতো স্বল্প বসনে দেখবে।
লজ্জায় নিজের চোখ নামিয়ে নিল সে।
মনটা চিরতার চেয়েও তিতা হয়ে আছে। আধ ঘন্টার মধ্যে আরো তিনটে অপরিচিত মেয়ে আর বন্ধুদেরকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখল।

রোহান এবার একটা রিকশা নিয়ে সোজা বাসায় চলে আসলো। নাহ মনের ভেতরের গুমোট ভাবটা কেটে গেছে। চলে এসে ভালই করেছে, নিজেকে ফ্রেশ লাগছে।

বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে মায়ের রুমে গেল রোহান।

মা সুরতুলে কোরআন পড়ছেন। রোহান নিঃশব্দে মায়ের তিলাওয়াত শুনতে থাকে। মা কিছুক্ষন তিলাওয়াত করে তারপর সেটার বাংলা তরজমাটাও টেনেটেনে পড়ছেন। তরজমায় কিয়ামতের আলামত, জাহান্নামের কঠোর শাস্তির কথা ছিল – যা পড়ার সময় মা কেঁপে কেঁপে কেঁদে উঠছিলেন।

রোহানেরও ভয় করছে, হাত পা শুকিয়ে আসছে। কারন আয়াতে আল্লাহ পাক বলছেন তিনি মিথ্যেবাদীদের কঠোর শাস্তি দেবেন।

কথায় কথায় মিথ্যে বলে মমতাময়ী মাকে বোকা বানানোর আর্ট কেউ রোহানের চেয়ে ভালো পারবে না। নিজের এই মিথ্যে বলার আর্টকে এতদিন অন্যতম গুণ হিসেবেই জানত সে।

অথচ আজ লজ্জা লাগছে, ভয় হচ্ছে!

মা তিলাওয়াত শেষ করে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কিরে বাবা কিছু বলবি?”

রোহান মাথা নিচু করে বসে রইল।

– তোর স্টাডি কেমন হলো?

– সরি মা! আমি কোন স্টাডি করতে যাইনি। থার্টি ফার্স্ট নাইট সেলিব্রেট করেতে গিয়েছিলাম।

– এটা আবার কোন নাইট?

– নিউ ইয়ারের আগের রাতে নাচ গান, হই হুল্লোর এই আর কি।

– এসব করতে হয় না বাপ! এগুলো হারাম!!

রোহান মায়ের কোলে মাথা রেখে বলল,
– আচ্ছা মা আমি যদি পাহাড়ের চেয়েও উচু উচু গুনাহ করি, আল্লাহ পাক কি আমায় ক্ষমা করবেন?

– অবশ্যই বাবা। আল্লাহ ক্ষমাশীল, গফুরুর রহীম। তবে তুমি যথাসম্ভব চেষ্টা করবে যাতে করে একই ভুল বারবার না হয়। শয়তান তোমার সামনে লক্ষ সুরতে এসে হানা দিবে যাতে তুমি পথ ভ্রষ্ট হও। আরেকটা কথা বাবা, তুমি মায়ের সাথে কখনোই মিথ্যে বলো না। শুধু মা কেন, কারো সাথেই না। আজ তুমি মিথ্যে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলে, এমনটা যেন আর কক্ষনো না হয় ঠিক আছে?

-ওকে মা! মনে থাকবে।

রোহান বহুদিন পর আজকে নামাজে দাঁড়ালো। নামাজ শেষে দুহাত তুলে মোনাজাত করলো। নতুন বছরটা যেন তার আল্লাহ পাকের দিদার লাভের বছর হয়।

খুব ভোরে জিসানের আম্মু রোহানের মায়ের ফোনে কল দিলেন।

ফোন রিসিভ করতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন জিসানের মা। রোহানের মা জিসানের আম্মুর কান্না শুনে ভড়কে গেলেন।

– কি হয়েছে ভাবী?

– ভাবী আপনার ছেলে রোহান কোথায়?

– রায়হান তো বাসায় ঘুমোচ্ছে। কেন?

– বাসায়? কিন্তু কালকে তো ওর অন্যদের সাথে গ্রুপ স্টাডির জন্য ধ্রুবর বাসায় থাকার কথা ছিল।

– হ্যা ছিল, কিন্তু সে যায়নি। গেট পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে চলে এসেছে। আরেকটা কথা, সেখানে কোন গ্রুপ স্টাডির বিষয় ছিলনা। ওরা থার্টিফার্স্ট নাইট, ওইযে কী যেন বলে ওই টাইপের কিছু নিয়ে একটা পার্টি ছিল।

জিসানের মা কেঁদে বললেন,
– দেখছেন ভাবী! ছেলে আমাকে মিথ্যে বলে বোকা বানিয়ে এখন নিজেই ধরা খেয়ে থানায় আছে। বিশ্বাস করেন ভাবী, আমার ছেলে এমন কাজ কখনোই করতে পারেনা। ওর অন্যান্য বন্ধুরাই ওকে ফাঁসিয়েছে। আমার আর কাউকে মুখ দেখানোর পথ রইলো না ভাবি!

– কাঁদবেন না ভাবি, কী হয়েছে একটু খুলে বলুন। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

– কী আর হবে ভাবী! কাল রাতের সেই পার্টিতে নাকি ওরা সবাই ড্রিঙ্ক করেছিল। নেশায় চুর হয়ে তাদেরই এক সহপাঠি নিশি নামের এক মেয়েকে সবাই মিলে রেপ করে ফেলেছে। মেয়েটা এখন ঢাকা মেডিক্যালে আছে। পুলিশের কাছে স্টেটমেন্ট দেবার সময় ও আপনার ছেলে ছাড়া বাকি সবার নাম নিয়েছে।

রোহানের মা ফোন কানে নিয়ে বজ্রাহতের মত দাঁড়িয়ে রইলেন। আর ভাবতে লাগলেন, আমার আল্লাহ পাক যদি রহম না করতেন তাহলে এরকম জঘন্য পরিস্থিতে হয়তো আমিও রায়হান কে নিয়ে পড়তাম।

সত্যঘটনা কখনো চাপা থাকে না। রোহান নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করছে। সেদিন যদি এভাবে তার মনের গতি আল্লাহ পাক পরিবর্তন না করে দিতেন তাহলে তার নাম ও হয়তো সেই রেপিস্টদের লিষ্টে থাকতো!

রোহান তওবা করলো, কখনোই সে আর মিথ্যে বলবে না।
এক থার্টি ফার্স্ট নাইট পালন করতে গিয়ে হয়তো তার জীবনটাই বরবাদ হয়ে যেত।

আজ সে শিখে গেল,
হারাম অলয়েজ হারাম, সেটা কখনোই জীবনে সফলতা বয়ে আনে না!!

……………………………….

أَيَحْسَبُ الْإِنسَانُ أَن يُتْرَكَ سُدًى

মানুষ কি মনে করে যে, তাকে এমনি ছেড়ে দেয়া হবে?

[৭৫ : ৩৬]

………..