নাক ফুল

সকাল দশটা প্রায়.. কেয়াদের বাসায় লোকজন গমগম করছে । আত্মীয় অনাত্মীয় কেউ বাকি নেই । আজকের দিনটা শুরু হয়েছে বিশেষ একটা ঘটনা দিয়ে । আনুমানিক ভোর পাঁচটায় কেয়ার বাবা মারা যান । কেয়া ঘুম ঘুম চোখে উঠে দেখে তার মা কাঁদছে । কেয়ার বাবার নিষ্প্রাণ শরীরের পাশে তার মা ও ভাই ছাড়া ছিলো পাশের বাসার খালাম্মা । খালু গিয়েছেন আশেপাশের সবাইকে খবর দিতে । ধীরে ধীরে লোকজনের আনাগোনা বাড়তে লাগলো । কেয়াদের কলোনির দুইরুমের বাসায় খুব বেশি মানুষের জায়গা হবার কথা নয় । বেশিরভাগ মানুষ তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আলাপে মগ্ন, বিষয় কেয়ার বাবা ।

কেয়া সকাল থেকে বাসার বাইরে । কখনও খেলছে আবার কখনও আত্মীয় স্বজনের কোলে কোলে ঘুরছে । সবাই আজ বেশ মায়া করছে কেয়াকে । কলোনির এক খালাম্মা ডেকে নিয়ে নাস্তাও করিয়ে দিলেন এক ফাঁকে । খুব মজা করে নাস্তা করছিলো কেয়া । কে বলবে তার প্রিয় বাবা আর নেই । কেয়ার ই বা কি দোষ, বয়স তো খুব বেশি নয় । কেবলই পাঁচ পেরুলো !!!

সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো । হঠাৎই মায়ের কথা মনে পড়লো । অনেকক্ষণ হলো মাকে দেখেনি কেয়া । খেলা ফেলে এক দৌড়ে বাসায় । লোকজনের আনাগোনা যেন কমছেই না । মাকে খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ বাবাকে দেখতে পেলো । আগের মতই শুয়ে আছে তবে এবার বিছানায় নয়, ফ্লোরে রাখা পাটির উপর বাবার নিথর শরীর টা পড়ে আছে । মাকে দেখা যাচ্ছেনা বাবার পাশে । পাশের রুমে ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলো কেয়া । যাক এতক্ষণ পর মাকে দেখতে পেলো সে । কিন্তু এসব কি হচ্ছে ! কিছু মহিলা মিলে মায়ের নাকফুল খোলার জন্য রীতিমত ধস্তাধস্তি করছে । অনেক টেকনিক এপ্লাই করা হলো কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছেনা । কেয়া ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলনা কলোনির খালাম্মারা সবাই হঠাৎ মায়ের নাকফুলের পেছনে লাগলো কেন !!! এরমধ্যে এক মহিলা সুপারি কাটার ছরতা নিয়ে এসে ঘ্যাচাং করে টান দিয়ে মায়ের নাকফুলটা খুলে নিয়ে আসলো । কেয়া তাকিয়ে দেখলো মায়ের নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে আর মা ব্যথায় চিৎকার করছে !! এতটুকু বয়সে এরকম একটা দৃশ্য সহ্য করার মত ক্ষমতা আল্লাহপাক তাকে দেয়নি ।

কেয়া এক দৌড়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসলো । আজ সারাদিনে কেয়া কাঁদেনি তবে এখন তার খুব কান্না পাচ্ছে । বাবা হারানোর কষ্ট যেন মায়ের নাকফুল খোলার যুদ্ধের কাছে হেরে গেলো । কেয়ার খুব ইচ্ছে করছে কারও বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে । চারপাশে অনেক মানুষ কিন্তু কাউকে কেন জানি তার আপন মনে হচ্ছেনা, একটা মানুষ কেও না ।

বাবা মারা যাবার এক বছর পর ওরা কলোনি ছাড়লো । কেয়া এখন নবম শ্রেনী তে পড়ে । একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখে বাসার সামনে অনেক মানুষ । একটা লাশবাহী মিনি ট্রাকও দেখা যাচ্ছে । কেয়ার হাত পা জমে আসতে লাগলো । পা টিপে টিপে কোন রকম বাসায় ঢুকে জানতে পারলো কেয়াদের বাড়িওয়ালা আংকেল মারা গিয়েছেন আজ ভোরে । মা গিয়েছেন বাড়িওয়ালি আন্টি কে দেখতে । নানুকে একটু আসছি বলে কেয়াও স্কুল ড্রেস পরা অবস্থায় গেলো সেখানে । কান্নার রোল শোনা যাচ্ছে ।

কেয়া ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে যা দেখলো তার জন্য প্রস্তুত ছিলোনা । কিছু মহিলা মিলে বাড়িওয়ালি আন্টির দুহাত চাপ দিয়ে ধরে রেখেছে আর আরেক মহিলা বাড়িওয়ালি আন্টির নাকফুল খোলার জন্য জবরদস্তি করে যাচ্ছে । ঠিক যেন দশ বছর আগের সেই দৃশ্যের হুবহু অবতারণা হচ্ছে । কেয়ার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে । মাকে খোঁজার চেষ্টা করছে সে ।

এমন সময় ভিড় ঠেলে আপাদ মস্তক কালো বোরকায় আবৃত এক মহিলা এগিয়ে এসে চিৎকার করে বলে উঠলেন “ বন্ধ করুন প্লিজ আপনারা । একটা মানুষ কেবল মাত্র স্বামীর শোকে বাকরুদ্ধ । আপনারা চুড়ি কানের দুল চেইন খুলতে পেরেছেন ভালো কথা কিন্তু নাকফুল আপাতত যখন খুলছেনা তখন একটু বিরতি দেন । উনাকে একটু দম নিতে দিন প্লিজ । এরকম জোর জবরদস্তি করে উনাকে আঘাত দিয়ে কষ্ট দিয়ে এখনই নাকফুল তুলে আনতে হবে কেন ? “ জবরদস্তি করা মহিলাদের একজন বাজখাই গলায় বলে উঠলো “ আপনি তো হুজুরাইন । এটা জানেন না নাকফুল স্বামীর চিহ্ন । যেখানে স্বামী বেঁচে নেই সেখানে চিহ্ন রাখা তো ইসলামও এলাউ করেনা “ । বোরকা পরা মহিলা নিচু গলায় বললেন “ আপা, প্রথমত, ইসলামে বিধবা মহিলাদের ইদ্দত পালনের সময় শরীর থেকে সকল প্রকার জুয়েলারী খুলে রাখার বিধান আছে বটে তবে সেটারও একটা নান্দনিকতা আছে । নাকফুল বহুদিনের পুরানো হবার কারনে শক্ত হয়ে গেঁথে গিয়েছে। এটাকে ধীরে ধীরে চেষ্টায় আলাদা করা যেতে পারে কিন্তু জোর জবরদস্তি করে আজকেই শোকার্ত মহিলাটা কে আঘাত দিয়ে তুলে আনার চেষ্টা টা বাড়াবাড়ি বৈ কিছু নয়। দ্বিতীয়ত, ইসলাম নাকফুলের সাথে স্বামীর কোন সম্পর্ক আছে এটা স্বীকার করেনা । এটা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, মুসলিমদের না । একই ভাবে একজন মুসলিম মেয়ে বিয়ের জন্য নাক ফোঁড়াতে বাধ্য নয় যেটা আমরা বেশিরভাগ মুসলিম পরিবার মনে করে থাকি । ইসলাম স্বামীর কোন চিহ্ন অনুমোদন করেনা । এগুলো কেবলই কুসংস্কার”। বাজখাই গলার মহিলাটি কেমন যেন ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেলো ।

কেয়া বোরকা পরা মহিলাটির দিকে কিছুক্ষণ একমনে চেয়ে রইলো । একটা অদ্ভুত মায়া তৈরী হয়ে গেলো কেয়ার মনে মহিলাটির জন্য । কত সুন্দর করেই না উনি উচিত কথাগুলো অকপটে বলে গেলো । কেয়া ঠিক করেছে ইসলাম নিয়ে সে আরও পড়াশোনা করবে । ইসলামের চেয়ে লজিক্যাল কোন ধর্ম পৃথিবীতে নেই এটা সে এতদিনে বুঝে ফেলেছে ।

পেছন থেকে কেয়ার কাঁধে একটা নরম হাত এসে পড়লো । পিছনে ফিরে সে দেখলো তার মা দাঁড়িয়ে । কেয়া মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো । মনে হচ্ছিলো বুক থেকে বেশ বড়সড় ধরনের একটা পাথর সরে গেলো । মনে মনে বলে উঠলো ‘ আলহামদুলিল্লাহ ‘ ..

নাক ফুল
নুসরাত জাহান
২৫ অক্টোবর ২০১৮