রক্তাক্ত গোধূলীঃ ৩

ক্লিনিক যত এগিয়ে আসতে থাকলো, চারদিকে বারুদের গন্ধ ততই তীব্র হতে লাগলো। বোধহয় কিছুক্ষণ আগে এখানে এক পশলা গোলাগুলি হয়েছে, কিংবা… এখনো হচ্ছে। ভাবনা শেষ হবার আগেই প্রচন্ড শব্দে গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দ হলো। সাঁই করে গাড়ি ঘুরিয়ে পাশের গলিতে চলে এলো আর এক ঝুপড়ি চায়ের দোকানের পেছনে ঢুকে পড়লো শফিক।

দোকানের পেছনে এককোন ঘেঁষে এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক লুকিয়ে ছিলো, পথে পথে জীবন কাটানো বেচারার মাথা গোঁজার কোন ঠাই নেই! আতঙ্কে কম্পনরত বৃদ্ধ চোখ কপালে তুলে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনে কি পাগল নাকি, এই সময় কেউ ঘর থেইকা বাইর অয়? পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ হইতাসে ভোর রাত থেইকা। কেডায় জিতবো জানি না, আহারে কয়ডা না জানি ধরা পড়ে!”

“কোন জায়গায় হামলা হইছে ভাই”, শফিক হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলো। “ঐ যে মেডিকেলের পাশে যে ইস্কুল আছে, হেইডায় পাক শালাদের ক্যাম্প আছে, হেইখানে গুলাগুলি হইতাসে”।

মেডিকেল মানে যে ম্যাটারনিটি ক্লিনিক সেটা বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো ওর। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই আতঙ্কে হিম হয়ে গেলো। মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজার জন্য নিশ্চয় হানাদারেরা এখন আশে পাশের সব বাসায় ঢুঁ মারা শুরু করবে! যত দ্রুত সম্ভব রাহেলাকে বের করে আনতে হবে, কচি খুকী থেকে বৃদ্ধা মহিলাকেও যারা ছাড় দেয় না, তারা সদ্য প্রসবাকে ছেড়ে দেবে এমন বিশ্বাস করা অতি কল্পনা!

গাড়ী সেখানেই রেখে দৌড়ে বের হলো শফিক, একটা কোন উপায় অবশ্যই করতে হবে। নিজের জান গেলেও, রাহেলাকে উদ্ধার করতে হবে। পেছনে বিস্মিত বুড়ো ভিখারীকে রেখে, দেয়াল টপকে পাশের দালানের উঠোনে নেমে গেলো ও। সেখান থেকে এঁদো গলি আর পুকুরে কিনারা দিয়ে হেঁটে ক্লিনিকের পেছন পর্যন্ত গেলো। আবার দেয়াল টপকে ঢুকে পড়লো ক্লিনিকের সীমানায়।

কিন্তু…
.
.
ক্লিনিকের দরজা হাঁ করে খোলা! ভেতরে চেয়ার টেবিল সব লণ্ড ভন্ড হয়ে আছে, যেন তুমুল ঝড় বয়ে গেছে সেখানে! “রাহেলা?” – ডাকতে গিয়ে গলা কেঁপে উঠলো শফিকের। ডেলিভারি রুম শূন্য, প্রতিটা রুম শূন্য! শুধু একপাশে পড়ে থাকতে দেখলো কমলা রঙের একটি শাল, গত রাতে এই শালটি চপলা পিসির গায়ে দেখেছিলো। আতঙ্কে রোম খাড়া হয়ে গেলো ওর। তবে কি… নাহ, আর কিছুই ভাবতে পারছে না।

ক্লিনিকের পেছনের দরজা দিয়ে বের হলো শফিক, এমন সময় হঠাত কানে এলো সদ্যজাত শিশুর কান্না! ‘রাহেলা’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো শফিক। তখনি বাগানের কোনে একটি ঝোপ নড়ে উঠলো, উদ্ভ্রান্ত চেহারা নিয়ে বেড়িয়ে এলো রাহেলা।

প্রচণ্ড ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলতে লাগলো, “ আয়া আর চপলা পিসিকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে, আমি লুকিয়ে ছিলাম এখানে, ওরা বোঝেনি এই সময়ে কোন রোগী থাকতে পারে। না হলে আজ আমার কি হতো জানি না।“ বলতে বলতে শফিককে জড়িয়ে ধরে অদম্য কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো ও।

শফিক তার কণ্যা সন্তানকে কোলে নিয়ে বললো, “এখন কাঁদার সময় নেই, আগে নিরাপদ স্থানে যেতে হবে আমাদের”। গোলাগোলির শব্দ আর তেমন শোনা যাচ্ছে না। তবুও ঝুঁকি নিলোনা, যেভাবে এসেছে সেভাবে রাহেলা কে নিয়ে ফেরত এলো গাড়ি পর্যন্ত। হাসপাতাল থেকে চেয়ার নিয়ে তার উপর চড়িয়ে রাহেলাকে দেয়াল পার করালো। তার আগে, চপলা পিসির শালটি দিয়ে কণ্যাকে বেঁধে নিলো নিজের বুকের সাথে।

কোন স্বাভাবিক সময় হলে এমন শারীরিক অবস্থায় কোন নারী এতটা হাঁটা ও দেয়াল পার হতে পারতো নাকি জানি না, কিন্তু অবস্থার প্রেক্ষিতে নাম না জানা এক শক্তি এসে ভর করে শরীরে।

পাবলিকা গড়িটি নিয়ে যখন ছেরু চাচার ঘরে তারা পৌঁছল, তখন বেলা প্রায় দশটা। রাহেলা ভাবী আর তার শিশু সন্তানকে দেখার জন্য সবাই ঘিরে ধরলো ওদের। চাচাতো বোনেদের কাছে সবসময়েই এই ভাবী অতীব পছন্দের।

কারন তাদের পরিচিতদের মাঝে রাহেলাই একমাত্র মহিলা, যে কিনা ইংরেজী জানা ও গাড়ি চালাতে পারদর্শী! যে কারনে বাঙালী হবার পরেও সবাই ওকে ডাকে “মেম ভাবি”। যদিও মেয়েরা ওকে যতটা পছন্দ করে, বাড়ির মুরুব্বীরা ততটা পছন্দ করে না, তাদের চোখে ও কিছুটা নাক উঁচু ও অহংকারী।

এ কথা কিছুটা সত্য, প্রখর আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন রাহেলা জীবনে কখনো কারো সামনে নিজেকে ছোট করে নি। কিন্তু এই যুদ্ধ তার সব কিছু বদলে দিয়েছে। এখন তার পরিচয়, সে একজন বাস্তু ভিটে হারানো উদবাস্তু, একজন পলাতকের স্ত্রী এবং অন্যের বাড়িতে আশ্রিতা!

……………………………………………………….

এক মাস পরঃ

পুরনো এই দোতালা দালানের ছাদে বসে থাকতে রাহেলার খুব ভালো লাগে। এক মাসের মনি কে আর আদিব কে নিয়ে প্রায়ই সে ছাদের কোনে গাছের ছায়ায় বসে থাকে। তখন কিছুক্ষনের জন্য হলেও মনে হয় সে তার নিজের পুরনো জগতে ফিরে গেছে, মনে হয় তার নিজের সংসারে ফিরে গেছে । যেখানে বাইরের মানুষের কোলাহল নেই!

এ বাড়িটা বড্ড বড়, বাইরের বৈঠক খানায় সারাদিন লোকের আনাগোণা। তাছাড়া তার মতো আশ্রিতার সংখ্যাও কম নয়।

এখানে তার সাথে শফিকের খুব কম দেখা হয়। এতো মানুষের ভীড়ে আরাম করে কথাও বলা হয় না। প্রায়ই ভাবতে বসে ও, আর কখনো কি নিজের সংসারে, সাজানো গৃহ কোনে ওরা ফেরত যেতে পারবে? নাকি চিরকাল কি এমন পালিয়ে বেড়াবে!

ওর ভাবনার সুতোয় ছেদ পড়লো শফিকের গলার শব্দে। এ’কদিনেই শফিকের চেহারা কেমন ভেঙে পড়েছে, অবশ্য অযত্নে অবহেলায় ওর নিজের চেহারাও যে খুব ভালো অবস্থায় আছে তা নয়।

আজ অনেক দিন পর শফিকের গলায় আনন্দের ছাপ! জিজ্ঞাসু নয়নে স্বামীর দিকে তাকালো রাহেলা।

এক নাগাড়ে বলে চললো শফিক, “ভালো খবর আছে, আজ আমাদের পুরনো বাসার দিকে গিয়েছিলাম, অফিসের পিয়নের সাথে দেখা হলো। অফিসে এখন নাকি কাজ করম স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। আমার সম্পরকেও কেউ কোন খোঁজখবর করছে না, সরকারী রেশন কারড দেখালে রাস্তায়ও মোটামোটি নিরাপদে চলা যায়।”

“চলো আমরা বাড়ি ফিরে যাই”। আনন্দে মনিকে, কোলে নিয়ে চুমু দিলো শফিক। তার চোখ ছেলেমানুষি উচ্ছাসে জ্বলজ্বল করছে। মানুষের আশ্রিত থেকে সেও অস্থির হয়ে পড়েছে। হাতে টাকা পয়সাও শেষ হয়ে গেছে।

রাহেলা কেন যেন এই সংবাদে খুব একটা খুশি হতে পারলো না, মনের কোথায় যেন খচখচ করছে। রাহেলার মন খচখচানিকে শফিক এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিলো।

ছেরু চাচা আর চাচীও বললেন, আর কয়টা দিন থেকে যেতে। কিন্তু সেদিন রাতেই তারা বেরিয়ে পড়লো। যাবার সময় মাতৃস্নেহে এতোদিন আগলে রাখা চাচীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রাহেলা।

এক রাতে তারা মৃত্যু ভয়ে পালিয়ে এসেছিলো, আজ এক মাস পর নিজের অজান্তেই আবার মরনের মুখে এগিয়ে চললো। শফিক কি কল্পনা করতে পেরেছিলো, আগামী কাল ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে!!! (চলবে)

——- ————–
(আগামী খণ্ডে সমাপ্য)