রাত দশটায়

শাহানা একটু আগে ক্যালেন্ডার দেখেছে। আজকে ডিসেম্বরের আঠারো তারিখ। ঢাকা শহরে শীত খুব একটা পড়ে না। তবু তিনদিন ধরে বেশ শীত পড়েছে।আজ সকাল থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি পড়েছে। এখনো পড়ছে। শাহানা ওর আলমারির বাম পাশে নিচে রাখা শাড়ির ড্রয়ার থেকে লাল রঙের সুতির শাড়িটা বের করলো। সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ। সাথে দুইটা টাওয়াল নিল। গোলাপী রঙের টাওয়ালটা বেশ বড় আর নীল রঙের টা মাঝারী সাইজের।

শাহানা প্রথমে দাঁত মাজলো। বেশ সময় নিয়েই মাজলো। এর পরে চুলে ঘষে ঘষে শ্যাম্পু দিলো।

শাহানা সবসময় বাম হাতে শাড়ির কুচি ধরে। এতেই ওর সুবিধা হয়। শাড়ি পড়া শেষে কাজল দেয়ার আগে ও আয়নাতে নিজের দিকে গভীরভাবে একবার তাকালো। কপালের রগ ফুলে আছে। ওর নানীরও কপালের রগ এরকম ফুলে থাকে। ওর চোখের নিচটাতে নীলচে কালো দাগ। এর মধ্যে ছোট ছোট শিরা উপশিরা গুলো দেখা যাচ্ছে। কলেজে পড়বার সময় চোখে কাজল দিলে ওকে অদ্ভুত সুন্দর লাগতো। কাজল দেয় না প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেছে। আজ দিবে। বেশ মোটা করেই দিবে।

হাসান ঠিক রাত দশটায় আসবে। গত সাড়ে পাঁচ বছরে রুটিনের কোন তারতম্য হয় নি।

ঠিক পৌনে নয়টায় ও কফির জন্য দুধ জ্বাল দিয়ে হিট ক্যাপচারড মগে ভরে রাখবে। দুধে পটাশিয়াম সায়ানাইড আগে থেকেই মেশানো থাকবে। হাসান ফিরলেই কফি আর চিনি মিশিয়ে নেড়ে দিবে। ব্যাস। মামলা ডিসমিস। হাসান কফিতে চুমুক দিবে আর ও গভীর আগ্রহ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকবে। চোখের সামনে হাসান লুটিয়ে পড়বে। একসময় ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাবে। দৃশ্যটা চিন্তা করতেই শাহানার মধ্যে একটা তীব্র উত্তেজনা কাজ করছে। বহুকষ্টে পাশের বাসার অর্পার ক্যামিস্ট্রি ল্যাব থেকে ও এই জিনিজ আনিয়েছে।এর জন্য ওর গুনে গুনে এগারোটা মিথ্যা কথা বলতে হয়েছে অর্পাকে।

কিভাবে কি করবে সেটা শাহানা কাল বিকেলেই ডায়েরীতে লিখে রেখেছিলো। আজকের সারাদিন ও প্ল্যানমাফিকই কাটিয়েছে। কোন কিছুই এদিক ওদিক হয় নি।এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

পর পর তিনটা কলিংবেল বাজলো। শাহানার বুকটা ধক করে উঠলো।বেশ ধীর পায়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো ও।

হাসান গোসল করছে। গানের আওয়াজ ভেসে আসছে ভেতর থেকে। সোনা দিয়া বান্ধাইয়াছো ঘর। ও মনরে….

…………………

রাত বারোটা পঁয়তাল্লিশ। শাহানা ঘুমিয়ে আছে। শিশুর মত ঘুম। আজকে ওকে দুইটা ঘুমের ওষুধ খাওয়াতে হয়েছে। আহারে বেচারি। না জানি কি কষ্ট ওর মনের ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে। হাসান কাল রাতেই ওর ডায়েরী পড়েছে। প্রায়ই পড়ে।

পড়ে একদমই অবাক হয় নি। এরকম প্ল্যান ও প্রায়ই করে। সাইক্রিয়াটিস্টও তাই বলেছে। এই ধরনের কেইসে এরকম করে রোগীরা। খুব ভয়ের কিছু নাই। হাসান কফির মগে চুমুক দেবার ঠিক আগেই শাহানা নিজেই মগ ছুড়ে ফেলেছে। এরপর আকাশ পাতাল কান্না। হাসান ওর রাতের ওষুধ তাড়াতাড়ি খাইয়ে দিয়েছে। শাহানার সমস্যার শুরু ওর এগারো বছর বয়স থেকেই। যদিও তখন ওরকম কিছু বোঝা যায় নি। গত পাঁচ বছর ধরে কেন জানি বেড়ে গেছে।

………………..

শাহানার মা প্রতিদিন ভোরে হাটতে বের হত মেয়েকে নিয়ে। এরপর বাসায় এসে ওকে স্কুলে নিয়ে যেত। কি অসম্ভব সুন্দর ছিলো শাহানার দিনগুলো। এক ভোরে পার্কে দুই ছিনতাইকারী এসে ওর মাকে বলে যা আছে দিয়ে দিতে। ওর মা যতই বলে সাথে কিছু নাই।এরা কিছুতেই মানতে রাজি হয় না। মাতাল ছিলো হয়ত। এরপর যা হলো তা শাহানা আজো ভুলতে পারেনা। এক মিনিটের মধ্যে মায়ের মৃত দেহ ওর চোখের সামনে লুটিয়ে পড়লো। মায়ের মাথা ওর কোলে।ওর পুরো শরীর রক্তে মাখামাখি।

হাসান শাহানার কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ওর একটা হাত মুঠ করে ধরে রেখেছে।ঘুমের মধ্যেই শাহানা হাসানের হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরলো।

রাত দশটায়
সানজিদা সিদ্দিকী কথা
১৩ নভেম্বর ২০১৮