গল্প নয়, বাস্তব

স্কুলের বাচ্চাদের সাথে নাশিদের প্রাকটিস শেষ করে, হাতের কাজ গুছিয়ে মাত্রই স্কুল থেকে বের হয়েছে জিয়ান্তা। তখনই আব্বুর ফোন।

-অমুক ম্যারেজ মিডিয়া থেকে আজ একটা বায়োডাটা পাঠিয়েছে তোমার ইমেইল এড্রেসে। একটু প্রিন্ট করে এনো তো।

কোন রকমে জ্বি আচ্ছা বলে ফোন রাখে জিয়ান্তা।

মাত্র চারদিন পরেই স্কুলের কালচারাল প্রোগ্রাম। বাচ্চাদের নাশিদ শেখানো, ইভেন্টের জন্য জামা বানানো সব নিয়ে ভীষন ব্যাস্ত সে। তার উপর তিনদিন পরেই তার প্রিয় শায়খের দিনব্যাপী লেকচার প্রোগ্রামের ভলান্টিয়ার হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এসব কিছুর মাঝে এই ঝামেলাটা একদম ভালো লাগে না জিয়ান্তার।

কদিন পরপরই এক একটা বায়োডাটা আসে। আব্বা ভীষণ আশাবাদী হয়ে যান। তারপর হয় পাত্রপক্ষ নাকচ করে দেয় বা জিয়ান্তার বাবা।

এরকম গত পাঁচবছর ধরেই চলছে। পাঁচবছর আগে যখন জিয়ান্তার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল, তারপর থেকেই।
ডিভোর্স এর পর ভেবেছিল আর বিয়েই করবে না। কিন্তু তিন বছর আগে হজ্জ্বে যাবার পর থেকেই এই সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে সে।

জিয়ান্তাদের গ্রুপে অন্য যে কজন মহিলা হজ্জ্বযাত্রী ছিলেন, প্রত্যেকে নিজেদের বরের সাথে একসাথে আল্লাহর ঘরের সামনে হাত তুলে দাড়িয়েছিলেন। সেই দৃশ্য দেখে খুব লোভ হয়েছে জিয়ান্তার।

স্বামীর সাথে একসাথে আল্লাহর ঘরের সামনে দাঁড়ানোর লোভ।

এখনও স্পষ্ট মনে আছে জিয়ান্তার, বারবার আল্লাহর কাছে এমন একজন সংগী চেয়েছিল জিয়ান্তা, যাকে দেখে
জিয়ান্তার চক্ষু শীতল হয়।

একদিন তো দোয়া করতে করতে হটাৎ বলেই ফেলেছিল, ইয়া আল্লাহ, এবছর এতো এতো মানুষ হজ্জ্ব করতে এসেছে, এদের মধ্য থেকে কোন একজনকে আমার জন্য নির্ধারণ করে দাও মাবুদ।

বলেই লজ্জা পেয়ে গেলো জিয়ান্তা।
এসব কি বলছে সে!
ছিঃ ছিঃ কি লজ্জার ব্যাপার।
ঢাকায় ফেরার পর আম্মা যখন জানতে চাইলেন কি কি দোয়া করেছে, ভুলেও এটা মুখে আনেনি সে।

এসব কিছু ভাবতে ভাবতে কখন প্রিন্টিং এর দোকানে চলে এসেছে জিয়ান্তা খেয়ালই করেনি। ম্যারেজ মিডিয়া থেকে বায়োডাটার সাথে হাসিখুশি চেহারার এক ভদ্রলোক এর ফটোও পাঠিয়েছে। যদিও এসব ছবি বা বায়োডাটা কোনটাতেই জিয়ান্তার আগ্রহ নেই। বায়োডাটা প্রিন্ট আউট করে খামে ভরে সোজা বাসার উদ্দ্যেশে রওনা হল সে।

তিন দিন পর আব্বা জানালেন, পাত্রের সাথে তাদের কথা হয়েছে এবং তারা পাত্রের সাথে সামনা সামনি কথা বলতে যাবেন। অবশ্য এসব কথার কোনটাই কানে ঢুকছে না জিয়ান্তার। কেননা তার পরের ঘটনা গুলো মোটামুটি একইরকম হয়। বেশিরভাগ সময় কালোরঙ আর স্থূল হওয়ার কারনে পাত্ররাই তাকে রিজেক্ট করেন। যাকগে সেসব, তার পছন্দের প্রোগ্রামের ভলান্টিয়ার হতে পেরেছে তাতেই সে খুশি।

পাত্র দেখে এসে আব্বা ভীষণ রকম খুশি, কিছুক্ষণ পরপর বায়োডাটা বের করে পড়ছে আর এক একটা লাইন পড়ে পড়ে শিশুদের মত খুশি হয়ে যাচ্ছে।

হটাৎ জিয়ান্তার কানে এলো, “শুনছো জিয়ান্তার মা, এই ছেলে তো হজ্জ্ব ও করে ফেলছে, আরে দেখো না একবার, আমাদের জিয়ান্তা যে বছর হজ্জ্ব করল সে বছরই।”
একটু যেনো থমকে গেলো জিয়ান্তা।

তারমানে সে যখন আল্লাহর ঘরের চতুর্পাশে ঘুরে ঘুরে ফরিয়াদ জানিয়েছে, আরাফাতের ময়দানের দুহাত তুলে চোখের পানি ফেলেছে, মুজদালিফায় রাত্রি যাপন করেছে, তখন এই ভদ্রলোক তার আশে পাশেই কোথাও ছিল?
এও কি সম্ভব?

আব্বার কাছে শুনেছে পাত্রের নাকি পাত্রির গায়ের রঙ বা স্থুলতা নিয়ে কোন সমস্যা নাই। তিনি চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানোর আগে পাত্রীর সাথে একটু কথা বলতে চান শুধু।
শুনে বেশ ভালোই মনে হচ্ছিল জিয়ান্তার তবে এটা সে একবারেই আশা করেনি।

এটা কে কি কোন সংকেত মনে করবে?
আর কিছু ভাবার আগে ইস্তেখারা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে জিয়ান্তা।

………..

বিয়ের চার বছর পর স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে আবারো আল্লাহ্‌র ঘর তওয়াফ করার উদ্দ্যেশে রওনা হয়েছে জিয়ান্তা। রাব্বুল আলামিনের প্রতি কৃতজ্ঞতায় বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।

জিয়ান্তার পাশে কে আছেন বোঝা যাচ্ছে? সেই হাশিখুশি চেহারার ভদ্রলোকটিই।

গল্প নয়, বাস্তব
তানজিয়া ফাহিমা

জুলাই ১২, ২০১৮ইং