ড্রাইভার

 “কইরে কালু কই গেলি? অক্ষনই গাড়ি ইস্টাট দিতে হইব, তুই কই গিয়া মরলি?”

– “মাফ কইরা দেন ওস্তাদ, একটু জল বিয়োগ করতে গেছেলাম।”

– “তাড়াতাড়ি গাড়িত উঠ হালা।”

হেল্পারকে কষে ধমক মেরে চার চাক্কার ট্রাকের ড্রাইভিং সিটে আরাম করে বসে ফুল মিঞা। মুখে সুবাস ভরা জর্দা মাখা পান, বা হাতে জ্বলন্ত কেটু সিগারেট।

একটু আগেই বিশেষ পাড়ার মেয়েলোকটার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে এসে বেশ হালকা লাগছে। এখন মাল ভর্তি ট্রাক নিয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে।

মেয়েছেলের কাছে আসলে আসলে টাইম টেবিল ঠিক থাকে না। তার উপরে বাংলা মদের হালকা নেশা মনটাকে আরও ফুরফুরা করে দেয়। পনেরো দিন হইল সখিনা আর একমাত্র ছেলে সোহাগকে দেখে না।

মাল খালাস করে ট্রাক জমা দিয়ে বাড়ি যাবে।
শহর থেকে ছেলের জন্য একটা চাবি দেয়া গাড়ি কিনেছে ফুল মিঞা, সখিনার জন্য জরির পাড় দেয়া লাল টুকটুকা একটা সুতার শাড়ি।

নেশার ঘোরে কালুর বারবার ঝিমুনি আসছে।
ফুলমিঞার আবার অত সহজে নেশায় ধরে না। কিন্তু টানা দুই রাত নির্ঘুম কাটিয়ে এখন চোখ দুটো টালমাল করছে।

“রাইতে গাড়িতে না ঘুমায়ে বাজারের মেয়েটার কাছে যাওয়া ঠিক হয় নাই। ঘুমটাও হইল না, এদিকে সময় মতো মাল ডেলিভারি না দিতে পারলে চাকরি নট হয়া যাইব।” – মনে মনে ভাবল সে।

ফুল মিয়া রাস্তা ফাঁকা দেখে জোড়ে গাড়ি টান মারে। পাহাড়ি সর্পিল রাস্তায় গাড়ি সাপের মত একেবেঁকে চলছে। আর মাত্র পাঁচ কিলোমিটার, তারপরই সড়কের ধারে ছোট্ট কুটির ঘর | যেখানে ফুলমিঞার কলিজার ধন সোহাগ থাকে। যদিও বাড়ি পেড়িয়ে আরও তিন কিলোমিটার গেলে পড়ে বাজার।

সোহরাব মিঞার গোডাউনে মাল খালাস করে তবেই বাড়ি যেতে পারবে।

মনের পাঙ্খায় সুখের বাতাস সুরসুরি দেয়। বাইরের প্রকৃতির বুকে আলো আঁধারি কেটে গিয়ে কেবল মাত্র সূর্য উঁকি দিয়েছে। কালু তখনও ঘুমে মগ্ন।

ঝিমুতে ঝিমুতে হঠাৎ করেই ব্রেক কষল ফুলমিঞা। কিছু একটা বুঝি গাড়ির সাথে বাড়ি খেয়েছে। ফুলমিঞার আর বুঝতে বাকি নেই ঘটনা কী ঘটেছে। ভয়ে, উত্তেজনায় চোখ থেকে ঘুম উধাও। আশেপাশে কোন দিকে না তাকিয়ে দ্রুত গাড়ি নিয়ে গঞ্জে চলে যায় সে।

সোহরাব মিঞার গোডাউনে মাল খালাস করে কলের পানিতে ভাল করে গা ধুয়ে নেয়। ভেতরটা তখনও ভয়াবহভাবে কাঁপছে। আজ পর্যন্ত যতগুলো একসিডেন্ট করেছে সব নিজ এলাকার বাইরে। তবে আজ এটা কী হলো!

“হালায় আর কারো গাড়ি পাইল না মরার লাইগা বুঝি আমার গাড়িটাই বাইছা নিল?” ফুলমিঞা মৃত ব্যক্তির উপর অশ্রাব্য গালি বর্ষন করে।

এদিকে কালু হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে ফোন হাতে নিয়ে ছুটে আসে।

– “ওস্তাদ ওস্তাদ তাড়াতাড়ি এদিকে আহেন!”

– “কী হইছে এমনে চিল্লাস কেন? চা খাইতে দে।”

– “ওস্তাদ একটা দুঃসংবাদ আছে।”

– “কিয়ের দুঃসংবাদ!”

– “আপনের পোলা সোহাগ আজকে সকালে টেরাকের তলে পইড়া মইরা গেছে।”

ফুলমিঞার হাত থেকে চায়ের কাপটা খসে পড়ে।

“তাইলে কি আমিই……” নাহ আর ভাবতে পারেনা। মাথা ঘুরে পড়ে যায় সে।

সখিনার তীব্র আর্তচিৎকারে তখন গোটা বাড়ি ভারি হয়ে গেছে। ছেলেটা ভোরে মায়ের কাছ থেকে জেনেছিল একটু পরে বাবা এই রোড ধরে গন্ঞ্জে যাবে। ফুলমিঞা রাতে সখিনাকে বলে রেখেছিল ভোর ছয়টা নাগাত চইলা আসমু।

বাবার অপেক্ষায় কাতর ছেলেটি রাস্তার পাশে দাড়িয়ে থাকে পরিচিত ট্রাকটির অপেক্ষায়। নেশায় চুর বাবা তার ট্রাকটা অজান্তেই আইল্যান্ডের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ছেলের গায়ে তুলে দেয়। সোহাগ ছিটকে রাস্তার মাঝে পড়ে যায়। পেছনে থাকা আরেকটা লরি…… ততক্ষনে সব শেষ।

পুলিশ এসেছিল। সোহাগের পিষে যাওয়া ছোট্ট দেহটা একটা পুটলি করে দিয়ে গেছে।

ফুলমিঞার বুকে সেই ছোট্ট পুটলিটা আস্ত ট্রাকের মত চেপে বসেছে।

এ দৃশ্য সহ্য করবে কেমন করে?

যাবার আগে বাবার গলা ধরে বলেছিল, “বাজান আমার জন্য গাড়ি কিন্না আইনো।” চাবি দেয়া গাড়িটা বুকে চেপে ছেলের লাশের পাশে বসে থাকে ফুলমিঞা।

পাপের শেষকৃত্যটা যে এভাবে হবে কোন দিন ভাবতেও পারেনি সে। খুনি ফুলমিঞা নিজেকে কার কাছে সোপর্দ করবে? বিবেকের কাঠ গড়ায়, নাকি পুলিশের কাছে?

…………………..
ড্রাইভার
হলি সুরভী