পরিত্যক্ত ডায়েরি

“সুইসাইড করতে ইচ্ছে করে সারাক্ষণ। কোনো কিছুই ভালো লাগে না। জীবনটা অর্থহীন মনে হয়। বাঁচার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। কেনো বাঁচবো! কার জন্য বাঁচবো! যাকেই আমি ভালোবাসি, সেই তো ধোঁকা দেয়।

তপুকে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবেসেছিলাম। কতো কি করেছি ওর জন্য। আব্বু আন্মুর চোখে পানিও এনেছি ওর জন্য। তপুও আমাকে ধোঁকা দিলো। আমার এতো কষ্ট! আল্লাহ্‌ কি কিছুই দেখে নাহ্! কতো মানুষ মারা যায় ডেইলি। আমি মরি নাহ্! অনেকবার সুইসাইড করতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেটাও পারিনি। কোনো না কোনো ভাবে বেঁচে গেছি। ওরনা দিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলেছিলাম। কিন্তু ওরনা ঠিক করে বাধা হয়নি। তাই ধপাস করে পরে, কোমরে ও বাম পায়ে ব্যথা পেয়েছি। আর সাথে গলায় তো ফাঁসির দাগ আছেই। একসাথে ৫ পাতা হিস্টাসিন খেয়েছিলাম। তারপর, টানা ১৫ ঘন্টা ঘুমিয়ে আমি আবার সজাগ। এমনিতেই আমি ডেইলি ১০/১২ ঘন্টা ঘুমাই। তাই টানা ১৫ ঘন্টা ঘুমানোটা বাসার কারো কাছেই অস্বাভাবিক কিছু লাগেনি। নাহয় কেউ হয়তো খেয়ালই করে নাই। কেউই আমাকে ভালোবাসে নাহ্!”

এইটুকু লিখেই চোখ ঝাপসা হয়ে এলো ইন্তিহার। দুনিয়া জোড়া কান্না পাচ্ছে ওর। নীল মলাটের ডায়রিটা টেবিল থেকে সরিয়ে অনেক্ষন বাচ্চাদের মত কাঁদলো। তারপর, নীরবে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকলো, ঠিক কিভাবে ওড়না বাধলে আর খুলে যাবে না। ইদানীং, কিছুই ভালো লাগে না ইন্তিহার। এ ব্যাপারটা একবার দীপ্তিকে বলেছিলো। দীপ্তি বলেছিলো সাইকোলজিস্ট দেখাতে। “মাথা খারাপ, নাকি!” ওতো আর পাগল হয়ে যায়নি। সাইকোলজিস্ট কেনো! ইশ্! তপুর সাথে যদি একটু কথা বলা যেতো! হয়ত একটু ভালো লাগতো। কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লো ইন্তিহা।

ঘুম ভাঙ্গলো মায়ের ডাকে – “কিরে! এই বেলায় কি ঘুমাচ্ছিস তুই! শরীর খারাপ করেছে, নাকি?” “নাহ্! তুমি এখান থেকে যাও। বলেছিনা অযথা আমার রুমে আসবে না।” এই বলে, উঠে বসলো ইন্তিহা। মায়ের সাথে এমন ব্যবহার করে ওর খারাপ লাগাটা আরো বেড়েছে। আবার ডায়রি লেখা শুরু করলো। কে যেন ওকে বলেছিলো, মনের কথা ডায়রিতে লিখলে নাকি মন ভালো হয় যায়। সব ফালতু কথা! কোনো কিছুতেই এখন আর ওর মন ভালো হয় না। তবুও লেখা শুরু করলো।

“মায়েরা নাকি সবার মনের কথা বুঝে। আমার মা কেনো বুঝে না তাহলে! আমি তো আর টিনএজার না, যে সারাক্ষণ আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে! সব কিছু একেবারে হাতে ধরে শিখাতে হবে! মা সারাদিন আমাকে বকে। মাও আমাকে ভালোবাসে না।”

আবার যেন ঝড়ের মত কান্না পাচ্ছে ইন্তিহার। কিন্তু সে নিজেই বুঝতে পারছেনা ঠিক কি কারণে ওর কান্না পাচ্ছে। মা ঘুম থেকে তুলে দিলো, এই জন্য! তপু ফোন ধরছে না, এই জন্য! নাকি কেউ ওকে ভালোবাসে না, এই জন্য! নিজেকে এখন সত্যিই পাগল মনে হচ্ছে ইন্তিহার। কিচ্ছু ভেবে পাচ্ছে না। পুরো মাথা ব্লাঙ্ক হয়ে আছে। অথচ সামনে মিড। পড়াশোনার গোল্লাছাট অবস্থা। ভাবলো একটু ফেসবুকে মেসেজ চেক করে দেখবে, তপু মেসেজ দিলো কিনা। নাহ্! দেয় নি। দিবেও না হয়ত আর!

নিউজ ফিড ঘেটে কিছু গল্প পড়লো সে। সবই ভালোবাসার গল্প। আল্লাহ্‌ সবার জীবনেই ভালোবাসা দিয়েছে। শুধু তার তপুকেই কেড়ে নিলো। এসব ভাবতে ভাবতে স্ক্রোল ডাউন করছে। হঠাৎ একটা বাক্যে চোখ আটকে গেলো। লেখা, ” আত্মহত্যা করবেন ভাবছেন!” কৌতূহল নিয়ে পড়া শুরু করলো। দু এক লাইন পড়েই মেজাজ খারাপ করে ফোনটা খাটের উপর ছুড়ে ফেললো। রাগে গা জ্বলছে ইন্তিহার। কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে সে আবার ডায়রি লেখা শুরু করলো।

“তাহমিনা আপুর একটা পোস্ট দেখে ভাবলাম পড়ে ভালো লাগবে। দুই লাইন পড়েই দেখি, সেই কোরআন হাদীসের প্যাঁচাল। এই সব হুজুর টাইপ মানুষরা কি আর কিছু পায় না, নাকি! ফেসবুকেও কি কোরআন হাদীস ঢুকানো দরকার আছে। কাজিন, তাই আনফ্রেন্ডও করতে পারি না। মেসেজ নোটিফিকেশন অফ করে রাখসি। তা না হলে, দুদিন পরেই নতুন নতুন বইয়ের লিংক দিবে। নাহয় বলতে থাকে, ‘এই বই ভালো তুই পড়িস। পড়সিস তো।’ সবই কোরআন, হাদীস, ইসলাম রিলেটেড। কতবার বলসি এইসব পড়তে আমার ভালো লাগে না। তাও দিতেই থাকে। একবার তো বিরক্ত হয়ে ব্লক করেই দিয়েছিলাম। ভেবছিলাম বুঝবে। নাহ্! পরে আম্মুর সামনে আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে ইন্তিহা, তুই কি ব্লক করলি আমাকে!’ আর কি করা! আবার আনব্লক করে ফ্রেন্ড হওয়া লেগেছে। ভেবেছিলাম, এইবার অন্তত শিক্ষা হবে। কিন্তু নাহ্! উনি এখন আরো নতুন উদ্যমে, খুশি মনে ফেসবুকে ইসলাম রিলেটেড পোস্টও দেয়া শুরু করেছেন। কোনো লজ্জাও নেই মনে হয়! এভয়েড করতেসি, দেখতেসে বুঝতেসে তাও গায়ে পরে কথা বলতে আসে!
একটা সময় আমি আর তাহমিনা আপু বেস্ট ফ্রেন্ডের মত ছিলাম। একই ড্রেস পরতাম। জুতা, চুলের ক্লিপ থেকে শুরু করে সব একই কিনতাম। এমনকি একই ছেলেকে দেখে আমরা দুজন একই সাথে ক্রাশ খেতাম। একই সাথে একই গান শুনতাম। তখন তাহমিনা আপুরা আমাদের পাশের বাসায় থাকতো। হঠাৎ, ফুফার পোস্টিং রাজশাহী হলো। ওরা চলে গেলো। প্রায় এক বছর আমাদের দেখা হয়নি। কিন্তু ফেসবুকে ডেইলি চ্যাট হত। তখন থেকেই ও আস্তে আস্তে চেঞ্জ হয়ে যায়। কথায় আছে, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। ওর বেলায়ও একই অবস্থা হয়।

এক বছর পর যখন আমাদের দেখা হয়, তখন তো আমি পুরাই হা! কাকে দেখলাম আমি এটা। আগা গোড়া পুরা কালো বোরখায় ঢাকা একটা মেয়ে! যার নখে অলওয়েজ নেইল পলিশ মাস্ট থাকতোই, তার এখন নখ বলতে গেলে দেখাই যায় না। কেটে এতোটাই ছোট করে রাখছে। ও আসবে, তাই কত্ত এক্সাইটেড ছিলাম। কিন্তু ওকে দেখে আর কোনো কথা বলতেই ইচ্ছা হচ্ছিলো না। তখন থেকেই আমাদের দূরত্ব বাড়ে। তপুর কথা বলসিলাম একবার ওকে। বলে,’এসব করিস নাহ্! গুনাহ্ হয়’। একজন মানুষকে ভালোবাসলেও গুনাহ্! এটা আবার কেমন কথা।

জানিনা কেনো যেন তাহমিনা আপুর সাথে কথা বলতে খুউব ইচ্ছা করছে। রাগ করে তো কল ব্লক করে রাখসি। আচ্ছা দেখি ফেসবুকে রিপ্লাই দেয় কিনা। দিবে না মনে হয়।” 

ফেসবুক খুলে করে তাহমিনা আপুকে একটা মেসেজ দিল ইন্তিহা। কি লিখবে তা ভেবে পাচ্ছিলো না। তাই শুধু ” 

🙂 ” দিয়ে সেন্ড করে দিলো। পাঁচ মিনিটের মধ্যে রিপ্লাই।

“কিরে মন খারাপ, নাকি?” মেসেঞ্জারে, তাহমিনা আপু। ইন্তিহা খুব অবাক হলো। আপু বুঝলো কি করে! যাক, তাও এতদিন পর হঠাৎ নক দিয়ে মন খারাপের কথা বলতে কেমন সংকোচ হচ্ছিলো ইন্তিহার। তাই স্বাভাবিকভাবেই বললো,” নাহ্! কেমন আছো?”

– আলহামদুলিল্লাহ্‌। 

^_^ তুই?
– ভালোহ্।

আর কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না ইন্তিহা। আবার মনে মনে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। এই না আবার ইসলাম নিয়ে কথা শুরু করে দেয় আপু।

– মামা মামি ভালো আছেন?
– সবাই ভালো আছে।
– তোর পড়াশোনা কেমন চলছে?
– ভালহ্।
– বাসায় থাকবি কালকে? ফ্রি ছিলাম। যাবো ভাবছিলাম তোদের বাসায়।
– এসো।
– তোর তপুর খবর কি?
– ভালোহ্।
– সেদিন কবে যেনো দেখলাম কাকে নিয়ে বাইকে করে যাচ্ছে।
– আমাদের ব্রেকাপ হয়ে গেছে আপু। বাদ দাও ওর কথা।
– মামির মাজার ব্যথা কমছে?

অফলাইন।

“আজকে তাহমিনা আপু এসছিলো। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত। এতোদিন তো তাও কান্না করতে পারছিলাম। যখনই কষ্ট লাগতো ইচ্ছা মত কেঁদে নিতাম। কিন্তু আপুর সাথে কথা হওয়ার পর মনে হচ্ছে যেন কষ্টগুলো সব বুকের ভেতর জমাট বেধে গেছে। একটুও কাঁদতে পারছি না। বার বার আপুর কোয়েস্চেনগুলা কানে ভাসে। কিছু ডায়রিতে তুলে রাখি হয়ত ফিউচারে আমারই কাজে লাগবে।

১) তোর বেঁচে থাকা উদ্দেশ্য কি? তপুর মত একটা ছ্যাচড়া ছেলেকে বিয়ে করা?
২) এই জন্যই কি এত বছর থেকে মামা মামি এত কষ্ট করে তোকে বড় করেছে?
৩) এই জন্যই কি আল্লাহ্‌ তোকে সৃষ্টি করেছেন?

এখন আর আমার কান্না পায় না।বার বার চোখ ভিজে আসে। আবার কথাগুলা মনে পড়ে। মুহূর্তেই চোখে খরা “

ইন্তিহা এক দৃষ্টিতে দেয়ালে আঁকা প্রজাপতিটার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মাথার ভেতর এখন রাজ্যের ভাবনা ঘুরছে। সত্যিই তো! আল্লাহ্‌ কেন তাকে সৃষ্টি করেছেন, জীবন দিয়েছেন। আল্লাহ্‌ নাকি কোনো প্রয়োজন ছাড়া কিছু করেন না, তাহলে ইন্তিহার বেঁচে থাকার কি প্রয়োজন আছে! হ্যাঁ! প্রয়োজন তো আছেই হয়ত। তা না হলে এতবার সুইসাইড করতে ট্রাই করেও কেন পারলো না সে।আবার সামনে মিড! পড়তে হবে। কোনোভাবেই মিডে খারাপ করা যাবে না। তা না হলে সবাই ভাববে তপুর জন্য এমন হয়েছে।
এসব ভাবতে ভাবতে ইন্তিহা পড়তে বসলো। প্রায় মাস খানেক পর পড়তে বসেছে ও। কিন্তু পড়তে বসেই আবার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আগে তো পড়তে বসলেই তপুকে একটা এসএমএস দিয়ে দিতো। এখন আর তা হবে না। পরক্ষণেই তাহমিনা আপুর একটা কথা মনে পরে যায়। আপু বলেছিলো খুউব বেশি মন খারাপ হলে নামাজ পড়ে সেজদায় গিয়ে আল্লাহ্ এর সাথে কথ বলতে। এতে নাকি মন হালকা হয়। কিন্তু এত বছর পর নামাজ পড়তে কেমন যেন সংশয় হচ্ছিলো ইন্তিহার। তাও আবার নিজের কষ্টের কথা বলতে সে নামাজে দাঁড়াবে। অদ্ভুত! এত বছর কোনো কষ্ট ছিলো নাহ্। নামাজও পড়ে নি। কি ভাববে আল্লাহ্! ভাবতে ভাবতেই কানে হেডফোন লাগিয়ে গান প্লে করে দিলো ইন্তিহা। সামনে বই।কানে হেডফোন। হাতে ফেসবুক। গান প্লে হচ্ছে।

“তুমি যাকে ভালোবাসো স্নানের ঘরে ভাসবে ভাসো।
তার জীবনে ঝড় তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেধো ঘর।”

অজান্তেই ইন্তিহার গাল বেয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে গেলো। গানের “তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেধো ঘর” সেনটেন্সটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা ও।হেডফোন খুলে দূরে ছুড়ে ফেললো। আর সাথে সাথে ফোনের সব গান ডিলিট করে দিলো। সবগুলা ফালতু গান! তারপর ওযু করে নামাজে দাড়ালো। যদিও বার বারই মনে হচ্ছিলো যে আল্লাহ্‌ কি ভাববে। কতটা স্বার্থপর সে। আর এতো বছর নামাজ না পড়ায় অনেক কিছুই ভুলে গিয়েছিলো। তবুও যেটুকুই মনে আছে তা দিয়েই নামাজটা পড়ে নিলো।

এক সপ্তাহ মিড দিয়ে এখন একটু ফ্রি হলো ইন্তিহা। তাহমিনা আপুর সাথে অনেক কথা হয় এখন। দুজন আবার আগের মত ফ্রেন্ড হয়ে গেছে। নামাজ পড়া, কোরআন পড়া, পর্দা করা সব ধরণের ভালো কাজেই আপু ওকে প্রচুর ইন্সপাইয়ার করে। নামাজটা কন্টিনিউ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে ইন্তিহা। ফজর আর জোহরের নামাজটা পড়তে খুব বেশি কষ্ট হয় ওর। আর কোরআন পড়া তো ভুলেই গেছে। লাস্ট কবে যে কোরআন হাতে নিয়েছিলো, তাও মনে নেই। পর্দা করার ব্যপারটা এখনো মন থেকে মেনে নিতে পারছে না ইন্তিহা। কেন এত গরমের মধ্যেও এত কালো একটা বস্তু গায়ে দিয়ে রাখতে হবে। কেন শুধু মেয়েদেরকেই পর্দা করতে হবে। এ ধরণের হাবিজাবি অনেক কোয়েস্চেন মাথে আসে ওর। তবু তাহমিনা আপু পর্দার ব্যপারে কিছু বললে ইন্তিহা জবাব দেয়, “হুম করবো ইনশাআল্লাহ্‌! “

কফির মগটা হাতে নিয়ে, বারান্দায় এলোভেরা টবের পাশে বসলো ইন্তিহা। এলোভেরা টবটা তপু সহ কিনেছিলো, আই হসপিটালের সামনে থেকে। ভারি টবটা হাতে নিয়ে হাটতে তপুর খুব কষ্ট হচ্চিলো। একটাও রিকশা পাওয়া যাচ্ছিলো না। সব স্মৃতির খুটিনাটি সব কিছুই মনে আছে ইন্তিহার। কি মনে করে যেন ও উঠে গিয়ে আবার টবের পাশে এসে বসলো। বারান্দার ফ্লোরে এলোভেরা টবটার পাশে বশে ইন্তিহা ডায়রি লেখা শুরু করলো।

“তপু আসলে খুব একটা খারাপ ছেলে নাহ্। এখন শয়তানের ধোঁকায় পরে হয়ত এসব করে বেরাচ্ছে। আমি আল্লাহ্‌ এর কাছে দো’আ করি আল্লাহ্‌ যেন ওকে হেদায়াত দেন। সেই সাথে আলহামদুলিল্লাহ্‌! তপু আমার সাথে চিট না করলে হয়ত আমি কখনোই আমার রবকে চিনতে পারতাম না। আলহামদুলিল্লাহ্‌, আমার রব আমাকে পথ দেখিয়েছেন, অনেকবার সুইসাইড করতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। আলহামদুলিল্লাহ্‌। এটা আল্লাহ্‌রই ইচ্ছা।

এখন আর সুইসাইড করার কথা ভুল করেও ভাবতে পারি নাহ্ আমি। এত কষ্ট, এত ধৈর্যের রেজাল্ট এক সেকেন্ডে শেষ করে দেয়ার কোনো ইচ্ছা বা সাহস কিছুই নাই আমার। এমনিতে আমরা অনেক ছোট বড় গুনাহ্ করে ফেলি। আল্লাহ্‌ চাইলে সব মাফ করে দিতে পারেন। কিন্তু যারা সুইসাইড করে তাদের আল্লাহ্‌ কখনো ক্ষমা করেন না। তাহলে কেন, কার জন্য আমি আমার সারাজীবনের ছোট বড় সব ভালো কাজগুলা এক মুহূর্তে শেষ করে দিবো? তপুর জন্য? যে এই সাময়িক পৃথিবীতেই আমাকে এত কষ্ট দিলো, তার জন্য আমি আমার আলটিমেট লাইফ কেন শেষ করবো!

মাত্র অল্প ক’দিনে মনে হচ্ছে আমার বয়সটা অনেক বেড়ে গেছে।অনেক কিছু বুঝতে পারসি আমি। আসলে, আল্লাহ্‌ সব সময়ই মানুষকে পথ দেখায়। কিন্তু সে তা মানবে নাকি মানবে না সেটা তার নিজের ডিসিশন। লাইক, তপুর সাথে রিলেশন শুরুর আগে কিন্তু আমি জানতাম যে এটা হারাম। কিন্তু মানি নাই।আমার সামনে দুইটা পথই ছিলো। হয়, এটা হারাম তা মেনে নিয়ে আল্লাহ্‌ কে ভয় করে রিলেশনে না জড়ানো। নাহয়, না মেনে নিয়ে আল্লাহ্‌ এর পরোয়া না করে রিলেশনে জড়ানো। যদি মেনে নিতাম তাহলে তো, লাস্ট দুইটা বছর ওর জন্য যে কষ্টগুলা আমি পাইসি তা আমার জীবনে আসতো না। আর কেউ হয়ত আমাকে মেন্টাল পেশান্ট ভেবে সাইকোলজিস্ট দেখাতেও সাজেস্ট করতো না। ডিসিশনটা আমার ছিলো আর এর রেজাল্টও বুঝতে পারছি।

এখন শুধু বার বার মনে হয়, ইশ! তখন যদি আল্লাহ্‌কে ভয় করে কোনো হারাম সম্পর্কে না জড়াতাম! কিন্তু যা হয়ে গেছে তার জন্য আল্লাহ্‌ এর কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। সেদিন কথার ফাঁকে, কি বলতে বলতে যেন দীপ্তি বলে উঠলো, “তপু তোর সাথে এমন করেছে!আল্লাহ্‌ বিচার করবে ওর! কু* একটা!” কথাটা শুনে হঠাৎ খুউব ভয় পেলাম আমি। মনে হলো আল্লাহ্‌ তো ন্যায়বিচারক! রিলেশন করাতে যদি আল্লাহ্‌ ওর বিচার করেন তাহলে তো আমারও বিচার হবে। ও আমাকে প্রোপজ করেছে আর আমি এক্সেপ্ট করসি। তাহলে গুনাহ্ তো আমারও হইসে। এইসব ভেবে দীপ্তিকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,”আচ্ছা বাদ দে! আল্লাহ্‌ ওকেও মাফ করে দিক আর আমাকেও।” একথা শুনে দীপ্তি টিটকারী দিয়ে বললো,”হায়রেহ্ ভালোবাসা!”

আমি চুপ ছিলাম। কারণ, তখন দীপ্তিকে বোঝানো আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না; যে তপুকে ভালোবাসি বলে আমি এই কথা বলিনি। বরং আল্লাহ্ কে ভয় করি বলেই, বলেছি। আর দো’আ করি আল্লাহ্‌ যেন আমাদের দুজন কেই ক্ষমা করে দেন।

ল্যাব মিডের শেষে তপুর সাথে দেখা হয়েছিলো। ও হয়ত অপরাধবোধে ভুগছে। মাথা নীচু করে ৫ বছরের বাচ্চাদের মত সরি বললো। দেখে এত্ত মায়া লাগসিলো আমার। কিন্তু আমি অন্য দিকে তাকায়ে বললাম, “তপু, নামাজ পড়ে আল্লাহ্‌ কে সরি বলো। আর দো’আ করো আল্লাহ্‌ যেন আমাদের দুজনকেই ক্ষমা করে দেন।” এটুকু বলেই আমি চলে এসেছি। ওর উত্তরের জন্য অপেক্ষা করি নি। কোনো ভাবে যদি আমরা আবার শয়তানের ধোঁকায় পরে যাই! শয়তান হয়ত এখন আর আমাকে ধোঁকা দিতে পারছে না, তাই ওর মনে অপরাধবোধ দেখাচ্ছে।

এখন বার বার মনে হয়, ইশ! কেন যে আগে তাহমিনা আপুর কথা শুনি নাই। আল্লাহ্‌ তো আমার কাছে আগেই তাহমিনা আপুকে পাঠিয়েছিলো। আমিই মানি নাই। কি আশ্চর্য তাই নাহ্! একজন মুসলিম মেয়ে হয়েও এই ২০ বছর বয়সে এসে আমি ইসলাম নতুন করে শিখছি। আমি কোরআন পড়া ভুলে গেসি। একটা লেটারও চিনিনা।” ক্বুলহু আল্লাহ্‌ ” কে এই ১৫ টা বছর “কুল্ফু আল্লাহ্‌” পড়ে এসছি। কারো কোনো মাথা ব্যথা নাই। অথচ কোন ক্লাসে যেন আওয়ার(Hour) কে হাওয়ার বলেছিলাম। আম্মু কি বকা টা যে দিসিলো। ‘আওয়ার’ উচ্চারণ জীবনে আর ভুলিনি। আম্মুকে বলেছিলা, যে আমি কোরআন পড়া আবার শিখতে চাই। কিন্তু আর হয় নাই। “এই বয়সে তুমি হুজুরের কাছে আলিফ বা শিখবে! কি বলবে সবাই” এইসব হাবিজাবি কথা। আম্মুকে কোনোভাবেই বুঝাতে পারলাম না যে কে কি বলবে আর থেকে আমার কোরআন পড়া শিখাটা বেশি ইম্পরট্যান্ট। তারপর তাহমিনা আপুর থেকে কোরআনের অনুবাদটা এনে পড়া শুরু করেছি। আরবি পারিনা তাতে কি হয়েছে! বাংলা তো পারি। একদিন আরবিও পারবো ইনশাআল্লাহ্‌। গতরাতে সুরা ফাতেহার অর্থ পড়লাম। এতো বছর এই সুরা নামাজে কত বার পরেছি। অথচ অর্থ কালকে জানলাম। এত সুন্দর অর্থগুলো। আজকে সকালে সুরা বাক্বারাহ্ এর অর্থ পড়লাম। শেষ হয়নাই এখনো। তাও কিছু কিছু আয়াতের অর্থ পড়ে মনে হয়েছে, কথা গুলা যেন আল্লাহ্‌ নিজে আমাকেই বলছেন। আর বার বার চোখ ভিজে আসছিলো। আর মনে মনে ঠিক করে নিলাম, যত যাই হোক জীবনে আর কখনোই আল্লাহ্‌ এর অবাধ্য হবো নাহ্। ইনশাআল্লাহ্‌।”

মিডের পর এই প্রথম ক্লাসে এসেছে ইন্তিহা। প্রায় দুই সপ্তাহ ক্লাসে আসেনি ও। কেমন যেন দ্বিধা দ্বন্দ হচ্ছিলো ওর। আর বার বার মনে হচ্ছিলো সবাই কি ভাববে, “এত্ত ট্রেন্ডি একটা মেয়ে হঠাৎ এমন হয়ে গেলো কেন!” মনে মনে যে ভয়টা পাচ্ছিলো ঠিক তাইই হল; ইন্তিহাকে দেখেই দীপ্তি, অনন্যা, রেদোয়ান সেই লেভেলের পঁচানি দিলো। অনন্যা তো বলেই বসলো, “কিরে বিরহে তো চিৎ হয়ে গেলি দেখি। কোনো সাজ নাই। ইইয়া বড় ওড়না দিয়ে চুল ঢেকে এসছিস। নাকি প্রেমের শোকে চুল বিসর্জন দিলি!”

অন্য কোনো সময় হলে হয়ত মুখ ঠাসা কোনো উত্তর দিয়ে দিতো ইন্তিহা। কিন্তু আজ সে পুরো চুপ ছিলো। কারণ সে জানে এখন ধৈর্য ধরা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। হাজার বলেও এখন কাউকেই এটা বুঝানো সম্ভব না যে, ঠিক কি কারণে সে একটু একটু করে পর্দা করার চেষ্টা করছে। পঁচানির এক পর্যায়ে দীপ্তি বললো,”ইন্তিহা, আজ তোর ক্রাশ আসবে। তাহসান। অডিটোরিয়ামে কন্সার্ট। সবাই যাবো ফার্স্ট গ্যাপে।” রেদোয়ান বললো, “তুই তো আবার হুজুর হয়ে গেছিস। কন্সার্টে তো যাবি নাহ্, তাই না?” এ কথায় একটা হাসির রোল পরে গেলো। ও সত্যিই যাবে না। কিন্তু এ কথা এখন এখানে বলার কোনো মানেই নেই। ফার্স্ট গ্যাপে সবাই কন্সার্টে চলে গেলো।

ইন্তিহা কিছুক্ষন ক্যান্টিনে বসে আগের পড়াগুলো পড়ে নিলো। তারপর আর তার একা বসে থাকতে ভালো লাগছিলো না। তাই হাটতে হাটতে রবীন্দ্রসরবরে গিয়ে বসলো। দুপুর বেলা বলে হয়ত অনেক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে যায়গাটা।সন্ধ্যা হলে তো কপত কপতীর বিচরণ ক্ষেত্রে পরিনত হয় এটা।কত্ত স্মৃতি ভরা একটা জায়গা। বড় বট গাছটার নীচে বসে তপুর সাথে কত গল্প করত। এখনো সেই একই জায়গায় বসেছে ও। কিছুদিন আগেও বড় বট গাছের নীচটা ইন্তিহার ফেভারিট জায়গা ছিলো। কিন্তু আজ এখানেও বোরিং লাগছে। অযথা মনটা খারাপ হয়ে আছে। কিছু একটা লিখবে ভেবে ব্যাগ থেকে নীল মলাটের ডায়রিটা বের করলো ইন্তিহা। নাহ্! লিখতেও ইচ্ছে হচ্ছে না। তাই পেছনের পাতাগগুলো উলটে দেখছিলো। কত কথা লেখা আছে এই ডায়রিতে। মাঝে একটা পেজে, একটা প্রান হজম ক্যান্ডির খোশা স্ট্যাপল করে লাগানো।আর নীচে লেখা,”উনি দিয়েছেন 

^_^ । ” আম্মুর সাথে রাগ করে কতো কি লিখে রেখেছে এখানে। দীপ্তিকে নিয়ে লেখা, “দীপ্তি একটা ঢঙ্গী।” তাহমিনা আপুকে নিয়ে প্রায় দুই বছর আগে লিখেছিলো, “তাহমিনা আপুটা দিন দিন ক্ষ্যাত হয়ে যাচ্ছে” পড়তে পড়তে চোখ জ্বালা করছে ইন্তিহার।
মনে হচ্ছে যেন নিজের জীবনের টাইমলাইন নিজেই দেখছে। মাত্র এক মাস আগের ইন্তিহা আর আজকের ইন্তিহা একই মানুষ না। সেই হাত, পা, শরীর, চেহারা, চোখ সব একই আছে; কিন্তু কোথাও যেন কি একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন হয়ে গেছে। টুইংটুং!!! ফোনে এসএমএস এসেছে। রেদোয়ানের এসএমএস, “কিরে কি হইসে তোর! কন্সার্টেও আসলিনা। ক্লাস তো শুরু হয়ে গেছে। ক্লাসেও আসবি না, নাকি!”

উঠে দাড়ালো ইন্তিহা। খুব শান্ত মেয়ের মত হাটছে, ক্লাসের উদ্দেশ্যে।ওকে বাইরে থেকে দেখে ভেতরের ঝড় বোঝার উপায় নেই। আর নীল মলাটের ডায়রিটা, রবীন্দ্র সরবরের সেই বড় বট গাছের নীচেই রয়ে গেলো। এখন আর ওটার কোনো প্রয়োজন নাই ইন্তিহার।

মন খারাপ হলে, কারো উপর রাগ হলে, মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে খুব একা একা লাগলে, অনেক সুন্দর বৃষ্টি হলে বা কোনো বিকাল আর সন্ধ্যার মাঝামাঝি সময় কোনো হলুদ পাখি চোখে পরলেও আর ডায়রি লিখবে না ইন্তিহা। কারণ, মনের সব কথা বলার মত একজনকে এখন ও পেয়েছে। যে ওর মনের সব কথা খুব মনযোগ দিয়ে শোনে।আর যার কাছে সব ধরণের প্রবলেমের বেস্ট সলুশনটাই আছে। কে যেন ইন্তিহাকে বলেছিলো, মনের কথা ডায়রিতে লিখলে মন ভালো হয়ে যায়।সব ফালতুহ্ কথা! দু’রাকাত তাহাজ্জত নামাজ পড়ে মনের কথা আল্লাহ্‌ কে বললে মন ভালো হয়ে যায়। যে এটা কখনো করেনি; সে কখনোই বুঝবে না ফিলিংসটা।

নুসরাত জাহান মুন

(১ অক্টোবর ২০১৭)