প্রিয় বাপী, প্রিয় মামণি

১.
আজ আবির আর আনিলার জীবনে সবচেয়ে খুশীর দিন। এর চেয়ে আনন্দের দিন যেন তাদের জীবনে কখনোই আসেনি। আজ তারা জীবনে প্রথম প্লেনে চড়বে। উফ্ ভাবতেই আনিলার গায়ের পশমগুলো কেমন দাঁড়িয়ে যাচ্ছে উত্তেজনায়। আর আবির তো সকাল থেকে এক মুহূর্তও স্থির হয়ে বসছে না। ওর একটাই কথা, “কখন প্লেন দেখব? কয়টার সময় প্লেন ছাড়বে? আমরা কখন বের হব?” আবির ও আনিলা দুই ভাই বোন একই স্কুলে পড়ে। আবির নার্সারিতে আর আনিলা ক্লাস ফোরে। স্কুল বন্ধ, গরমের ছুটি চলছে। দুই ভাইবোনের অনেক দিনের স্বপ্ন প্লেনে চড়ে আকাশে উড়বে।

বাপী আর মামণি দেশের বাইরে এর আগেও কয়েকবার গেছেন। কিন্তু আবির আর আনিলা কখনোই প্লেনে চড়েনি, শুধু প্লেন আর বিদেশের গল্পই শুনেছে। এবার বাপী প্রমিজ করেছিলেন যদি হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষা ভাল হয়, তাহলে আনিলা আর আবির কে গরমের ছুটিতে নেপাল বেড়াতে নিয়ে যাবেন। ব্যস আর যায় কোথায়? দুই ভাই বোন সব ছেড়ে ছুড়ে রাত-দিন শুধু নেপালের স্বপ্নই দেখতে লাগলো। প্লেনে চড়বে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পর্বতমালার নীচে দাঁড়িয়ে বাবা-মাকে নিয়ে সেলফি তুলবে, হিমালয়ের কোলে বসে বরফ চুষবে, ক্লাসের সব বন্ধুদের নেপালের চকলেট খাওয়াবে আরও কত কী!

দেখতে দেখতে হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষা এসে গেল। বাপী যাতে তার প্রমিসটা রাখতে পারেন, সেজন্য দু’জনই পুরো এক মাস খুব সিরিয়াসলি পড়াশোনা করল। দুজনের পরীক্ষাই খুব ভালো হলো। ভিসা পাওয়ার পর বাপী যেদিন দুপুরে নেপালের টিকেট কাটতে যান, সেদিন তো টেনশনে দুই ভাই বোন কিছুই মুখে দিচ্ছিল না। মামণি বার বার জোর করছিলেন, কিন্তু বাপীর মুখ থেকে “কবে যাচ্ছি” এই কথা না শুনে কেউই ভাত খাবে না।

২.
সেদিনটি আনিলার এখনোও মনে পড়ে। বারান্দায় আনিলা বাপীর অপেক্ষায় অনবরত পায়চারী করছিল। আর আবির তার মনের মাধুরী মিশিয়ে বিভিন্ন রকম প্লেনের ছবি এঁকে আর্ট খাতা ভরিয়ে ফেলছিল। ছবিগুলোর কথা মনে হতেই আনিলার হাসি পেয়ে গেল। কোনটা দশ তালা প্লেনের ছবি, কোন ছবিতে প্লেনের নীচে রিকশার মত বড় বড় চাকা, আবার কোনটিতে প্লেনের স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে পাইলট। তার নীচে লেখা ‘আবির’। বাপীর আসতে আসতে ৫টা বেজে গেলো। এসেই সুখবরটা দিল। সামনের সপ্তাহের রবিবার দুপুর দু’টায় ফ্লাইট।
সুখবরের সাথে বাপী দুই ভাই বোনের জন্য কিছু নতুন জামা-কাপড় আর জুতোও কিনে আনলেন। বাপী দুজনকে দুটো ছোট ব্যাগ দিয়ে বললেন, “এ দু’টা তোমাদের পারসোনাল ব্যাগ। এখানে তোমরা তোমাদের সব দরকারী জিনিস ঢোকাবে। মা কিন্তু তোমাদের ব্যাগ গোছাবে না।”

দু’জন খুশীতে তখনই ব্যাগ গোছাতে শুরু করে দিল। আবির তো এক মূহুর্তের জন্যও ব্যাগটি কাছছাড়া করে না, এটা যে ওর পারসোনাল ব্যাগ! রাতে ঘুমানোর সময়ও ব্যাগটি কোলবালিশের মত জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। আর আনিলা? ফোন করে করে সব বান্ধবীদের নেপাল যাওয়ার খবর দিতে লাগল, “জানিস, আমরা প্লেনে চড়ে নেপাল যাচ্ছি, এক সপ্তাহ্ থাকব। প্লেন দেখেছিস কখনো? এর এক একটা পাখা তোদের পুরো বাড়ীর সমান হবে। মামণি বলেছে, প্লেনের জানালা দিয়ে আকাশ দেখা যাবে তবে ধরা যাবে না। কারণ জানালা বন্ধ থাকে। বুঝলি না? জানালা খোলা থাকলে আকাশের সব পাখীরা দল বেঁধে প্লেনের ভেতরে ঢুকে যাবে, মজার ব্যাপার না? আচ্ছা, নেপাল থেকে তোর জন্য কি কি আনব বলত?”

দুই ভাই বোনের এতদিনের লালিত স্বপ্ন আজ সত্যি হতে যাচ্ছে। আনন্দ আর উত্তেজনায় রাতে কেউই ভাল করে ঘুমায়নি। গত রাতে বাবা আর মা যখন বড় সুটকেসটা রেডি করছিলেন, আনিলা আর আবিরও তাদের ব্যাগ দু’টা শেষ বারের মত গুছিয়ে নিল। আনিলা তার ব্যাগের গায়ে একটা হলুদ কাগজ আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিল। তাতে লেখা আছে –

“ANILA-PERSONAL BAG”

আবিরও আনিলার দেখাদেখি ওর ব্যাগে একটা সবুজ কাগজ জুড়ে দিল। বোনের দেখাদেখি সে-ও লিখেছে –

“ABIR-PESSHONAL BAG (DON’T TOUCH)”

আবিরের ‘পেসহোনাল’ বানান দেখে মা আর আনিলা হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। বাপী মজা করে বলল, “আব্বু, আমাদেরকে তুমি তোমার ‘পেসহোনাল’ ব্যাগ টাচ করতে না দিলেও এয়ারপোর্টের লোকেরা কিন্তু ঠিকই চেক করবে”।
ঘুমাতে গিয়ে বাপীর কাছে আবিরের কত প্রশ্ন – “আচ্ছা বাপী, রাস্তায় যেরকম গাড়ীর যানজট হয়, আকাশেও কি প্লেনের সেরকম যানজট হয়? আর যখন বৃষ্টি হয়, প্লেনের ভেতরের মানুষগুলো কি সব ছাতা মাথায় দিয়ে রাখে? রাস্তার পুলিশ মামাদের মত আকাশের পুলিশ মামারাও কি মাথায় লোহার টুপি পড়ে থাকে?” আবিরের হাজারো প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে, বাপী একসময় ঘড় ঘড় করে নাক ডাকতে শুরু করে দিল।

আনিলা এবার মা কে ধরল, “মামণি, বলো না নেপালে কি কি আছে? আমরা ওখানে কি কি দেখব?” মামণি হাই তুলে বললেন, “নেপালে? কত কি যে আছে দেখার? হিমালয়, জলপ্রপাত, হ্রদ, কয়েকশো বছরের পুরনো রাজবাড়ী, পার্ক, জাদুঘর আরো কত কি! আমরা এই এক সপ্তাহে সব ঘুরে ঘুরে দেখব, ইনশাল্লাহ। এখন দু’জনই চোখ বন্ধ করো”।

দুই ভাইবোন হিমালয় কন্যা নেপাল কে নিয়ে কল্পনার জাল বুনতে বুনতে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল।

৩.
পরদিন ভোরে বাবা-মা ওঠার আগেই দুই ভাই-বোন ঘুম থেকে জেগে উঠল। উঠেই লিস্ট বানানো শুরু করে দিল। আনিলা নিজের জন্য লিখল – প্রজাপতিওয়ালা হেয়ার ব্যান্ড, চিকচিক চুড়ি, স্টোন বসানো লাল ঘড়ি, গোলাপী রঙ এর ফ্রক আর ডলস্ হাউস। কাজিন আর বন্ধুদের জন্য স্টিকার আর পেন্সিল। লিস্টের নীচের দিকে আবির বললো আর আনিলা লিখল- রিমোর্ট কনট্রোল জীপ গাড়ী, লোগো, লাইট আলা ব্ল্যাক জুতো, পকেট আলা জ্যাকেট, বাবার মত নীল সানগ্লাস আর বেশি করে চকলেট, মিমি। বাবা-মা ওঠার আগেই ওরা যত্ন করে কাগজটা ভাঁজ করে আনিলার ব্যাগে রেখে দিল। প্লেনে বাবাকে দেখাবে।

বারোটার আগেই সবাই খেয়েদেয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ল। বের হওয়ার আগে শেষবারের মত সব চেক করে মামণি দরজা লক করে দিল। মামণির মুখটা একটু মলিন দেখাচ্ছিল। আনিলা জিজ্ঞেস করতেই মামণি বললেন, “যদিও বেড়াতে যাচ্ছি, তবুও আমার এই ছোট্ট বাসাটার জন্য মনটা জানি কেমন করছে, আবার কবে দেখব!”

আনিলা মাকে সান্ত্বনা দিল, “মামণি, তুমি শুধু শুধু মন খারাপ করছো! আমরা তো এক সপ্তাহ্ পরই সবাই বাসায় ফিরে আসবো।”

মামণি শুকনো হাসি দিয়ে বলল, “হ্যাঁ তাই তো, এক সপ্তাহ্ পরইতো চলে আসছি ইনশাআল্লাহ্‌।” বাপী ফোন করে সবার কাছে দোয়া চাইলেন।
গাড়ী এয়ারপোর্টের কাছাকাছি আসতেই আবির প্রশ্ন করল, “বাপী, এয়ারপোর্ট কি?” বাপী উত্তর দিলেন, “এয়ারপোর্ট হলো এমন একটা জায়গা যেখান থেকে মানুষদের আনা-নেয়ার জন্য প্লেন আকাশে উঠে আবার আকাশ থেকে নামে।”

আবির মাথা নেড়ে বলল, “বুঝেছি, আমাদের বাড়ীতে যেমন গাড়ীর গ্যারেজ আছে; এয়ারপোর্টও সেরকম প্লেনের বড় গ্যারেজ।”

মামণি মুচকি হেসে বললেন, “বেশ, প্লেনের বড় গ্যারেজে চলে এসেছি, এখন সবাইকে নামতে হবে।”
আনিলা আর আবির এয়ারপোর্টে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তাদের স্বপ্নের প্লেন দেখার জন্য। সব চেক হয়ে গেছে। দশ মিনিটের মধ্যেই সবাই প্লেনে উঠবে। দুটো প্লেন বিকট আওয়াজে এয়ারপোর্টের উপর দিয়ে উড়ে চলে গেল। আনিলা সেদিকে তাকিয়ে আনমনে জিজ্ঞেস করল, “বাপী, আকাশে কি গাড়ীর মতো প্লেন এক্সিডেন্ট হয়?” মামণি চোখ বড় করে ধমক দিলেন, “আনিলা, তোমাকে না বলেছি বেড়াতে যাওয়ার সময় কখনো খারাপ কথা বলবে না? সবসময় ভালো চিন্তা করবে।”

একটু পর সবাই প্লেনে উঠে যার যার সীটে বসে গেল। আবির আর আনিলা জানালার পাশে বসা নিয়ে মারামারি শুরু করে দিল। আনিলা আবির কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে জোর করে জানালার পাশে বসে গেল। আবিরও কম দুষ্টুু না; একদম গিয়ে আনিলার কোলের উপর চেপে বসলো। আনিলা কোনোভাবেই আবির কে সরাতে পারছে না। শেষে ঠিক হল দু’জনই জানালার পাশে বসবে। তবে আনিলা বাপীর সাথে আর আবির মামণির সাথে বসবে।

এয়ারহোস্টেস এসে সবাই কে সীট বেল্ট বাঁধতে বলল। আবির বিজ্ঞের মতো বলল, “আন্টি, বেল্ট না বাঁধলে আমরা সবাই ডিগবাজি খেয়ে প্লেন থেকে নীচে পড়ে যাব, তাই না?” তারপর একটু ভেবে বলল, “আচ্ছা আন্টি, আমাদের প্লেনের ড্রাইভার মামা কোথায়? আমি ওনার কাছ থেকে একটু প্লেন চালানো শিখতে চাই।” এয়ারহোস্টেস আবীরের গাল টিপে হেসে বলল, “প্লেন চালাতেতো অনেক শক্তি লাগে। বেশি করে খাওয়াদাওয়া করে আগে বড় হয়ে নাও, তারপর প্লেন চালানো শিখবে, ঠিক আছে বাবু?” আবির মুখ লাল করে বলল, “আমি কিন্তু এখন আর বাবু না; বড় হয়ে গেছি, নার্সারিতে পড়ি।” এয়ারহোস্টেস এক গাল হেসে মোবাইলে আবিরের কয়েকটা ছবি তুলে নিল। যাওয়ার সময় বলল, “ঠিক আছে ইয়াংম্যান, এখন রেস্ট কর। আবার দেখা হবে।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লেন নড়ে উঠল, কচ্ছপের গতিতে একটু একটু করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আনিলার চোখ দুটো উত্তেজনায় চকচক করে উঠল। সামনের সীটে বসা আবিরের পিঠে জোরে বাড়ি দিয়ে বলল, “এই আবির, প্লেন চলা শুরু করে দিয়েছে, আমরা আকাশে উড়তে যাচ্ছি!” আবির পেছনে ফিরে বাবাকে বলল, “বাপী, তুমি না বলেছিলে প্লেন যখন আকাশে উঠে যাবে তখন প্লেনের পেটের ভেতর চাকাগুলো লুকিয়ে যাবে?” বাবা মুচকি হেসে সায় দিলেন।

দুই ভাই বোন মুগ্ধ চোখে জানালায় চোখ রেখে পেছনের দিকে হারিয়ে যেতে থাকা এয়ারপোর্টের মানুষ, গাড়ী, বিমান, গাছপালা সব দেখতে লাগলো। আস্তে আস্তে প্লেনের স্পিড বেড়ে গেল। প্রচণ্ড আওয়াজ করে প্লেন ছুটতে লাগলো বাতাসের গতিতে। হঠাৎ প্লেনটা উপরে উঠে গেলো। চাকাগুলো ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেলো। আনিলা আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “সুবহানআল্লাহ! বাপী, মামণি আমরা আকাশে! আমরা এখন ঈগল পাখি!” আবির খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল। আশে-পাশের যাত্রীরা দুই ভাই-বোনের কাণ্ডে মজা পেয়ে হাসতে লাগল।

প্লেন ছুটে চলেছে তার গন্তব্যের দিকে। আনিলা আর আবির এক মুহূর্তের জন্যেও জানালা থেকে চোখ সরাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর আবির মার দিকে ফিরে বলল, “মামণি, নেপালে আমরা কোথায় থাকব?” মামণি বললেন, “ওই যে আমার ছোটবেলার ফ্রেন্ড শিলার গল্প করেছিনা তোমাদের কাছে? শিলা আন্টিরা কাঠমুণডু থাকে। ইনশাআল্লাহ্‌ আমরা ওদের বাসাতেই আমরা থাকব।”

আবির হাই তুলে বলল, “মামণি, আমার না ঘুম পাচ্ছে কিন্তু আমি ঘুমিয়ে গেলে, তোমরা যদি আমাকে ছাড়াই প্লেন থেকে নেমে যাও?” মা আবিরের চুলে আঙ্গুল দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে বললেন, “মামণি কথা দিচ্ছি, তোমাকে একা রেখে আমরা কোথাও যাব না। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারো।” আবির নিজের ছোট হাত মায়ের দিকে বাড়িয়ে বলল, “প্রমিস?” মা আবিরের হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে বললেন, “প্রমিস।” আবির পরম বিশ্বাসের সাথে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মায়ের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।

আনিলা বাবার পাশে বসে বাইরের সাদা মেঘের পাহাড় দেখতে দেখতে রূপকথার দেশে হারিয়ে গেল। কৌতূহলী হয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা বাপী, সত্যি সত্যি কি ওই মেঘের দেশে লাল পরী, নীল পরীরা থাকে? আর বড়ো বড়ো শিংওয়ালা দুষ্টু দৈত্য?” বাবা হেসে বললেন, “নারে বোকা, ওইসব দৈত্য-পরীরা শুধু গল্পের বইয়ের মেঘের দেশেই থাকে, এই মেঘের দেশে ওরা থাকে না।” আনিলা এবার ফিস ফিস করে বাবার কানের কাছে মুখ এনে বলল, “জানো বাপী, আমি আর আবির না লুকিয়ে লুকিয়ে একটা লিস্ট বানিয়েছি।” বাবা অবাক হয়ে বললেন, “কিসের লিস্ট আম্মু?” আনিলা একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “ওই যে নেপালে গিয়ে আমরা কি কি জিনিস কিনব, কি কি গিফট আনবো তার লিস্ট।”

তারপর আস্তে করে ব্যাগ থেকে কাগজটা বের করে বাবাকে দেখালো। বাবা লিস্ট দেখে কৃত্রিম চিন্তার ভঙ্গি করে বললেন, “এত্ত বড়ো লিস্ট! সর্বনাশ! সব জিনিস কিনতে কিনতে বাপী তো ফকির হয়ে যাব।” তারপর হেসে আনিলার পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, “চিন্তা কোর না মা, এই প্রথম আমার বাবুদেরকে বিদেশে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছি। বাপীর যত টাকাই লাগুক, তোমাদের শখের জিনিস স-ব কিনে দেবো, ইনশাআল্লাহ্‌।” আনিলা খুশীতে বাবা কে জড়িয়ে ধরলো।

৪.
এয়ারহোস্টেস ঘোষনা দিলো — আর ৩০ মিনিটের মধ্যেই প্লেন ত্রিভুবন এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করতে যাচ্ছে। যাত্রীরা সব সীট-বেল্ট বাঁধতে শুরু করে দিলো। সবার চোখে মুখে আশা আর আনন্দের ছাপ। ৩০ মিনিটের জায়গায় ৫০ মিনিট হয়ে যাচ্ছে, তবু প্লেন শুধু এয়ারপোর্টের উপর ঘুরপাক খাচ্ছে। যাত্রীরা কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। আনিলাদের সামনের সীটের একজন মহিলা যাত্রী একটু জোরেই জানালার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “দেখ, দেখ প্লেনটা একদিকে কেমন উঁচু হয়ে আছে।” হঠাৎ প্লেন খুব জোরে ঝাঁকি খেলো। ৫ মিনিট পর আবারো একই রকম ঝাঁকি। একটু পর আবার। যাত্রীরা আতংকে চিৎকার দিয়ে উঠল। কে যেন ভয় মেশান গলায় বলল, “বাম্পিং হচ্ছে, সবাই দোয়া-দরুদ পড়ুন!” সবাই চিৎকার দিয়ে সমস্ত শক্তি একসাথে করে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে লাগলো। এই পৃথিবীটাকে তারা যে বড়ো ভালবাসে! এত তাড়াতাড়ি মৃত্যুদূতকে দেখতে চায় না। আবির তখনো মায়ের কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। আনিলা ছলছল চোখে বাবার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। ইচ্ছে করছে এখনই বাসায় চলে যেতে। ভীত গলায় বলল, “বাপী, প্লেনটা এরকম লাফাচ্ছে কেন?” বাবা আনিলার ভয় দূর করার জন্য ওকে কোলে নিয়ে বসলেন। তারপর সাহস দিয়ে বললেন, “ও কিছু না মা! প্লেন এয়ারপোর্টে নামার আগে এরকম একটু লাফায়। এই তো আমরা নেপালে চলে এসেছি। জানালা দিয়ে দেখ, ওই যে কাঠমুনডুর ত্রিভুবন এয়ারপোর্ট।”

প্লেনটা ত্রিভুবন এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করছে। সবাই অধীর আগ্রহে জানালা দিয়ে নীচে তাকিয়ে আছে। কিন্তু প্লেন রানওয়ে স্পর্শ করার সাথে সাথে কান ফাটানো বিকট আওয়াজ হলো। দাউ দাউ করে প্লেনের পাখাগুলোতে আগুন জ্বলে উঠলো।

১৫৫ জন যাত্রী নিয়ে প্লেনটি পাশের একটি পরিত্যক্ত মাঠে ছিটকে পড়লো। যাত্রীদের চিৎকার আর আর্তনাদে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠলো। আশপাশের মানুষ সব ছুটে আসতে লাগলো। প্লেনের ভেতরে কাঁচের গুঁড়া আর রক্তের ছড়াছড়ি। কালো ধোঁয়ায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। বাবার কোল থেকে ছিটকে আনিলা সামনের দিকে আগেই গড়িয়ে পড়েছে। নাক-মুখ থেতলে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে অসহায়ভাবে আনিলা ডাকতে লাগলো, “বাপী, মামণি, আবির!”

চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ! প্লেনের পেছন দিকের সীটগুলো আগুনে পুড়ছে। একটু একটু করে আগুন সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ পেছন দিক হতে মামণির ক্ষীণ গলা শোনা গেলো। আনিলা দৌড়ে গেলো। গিয়ে দেখে মামণি এক হাত দিয়ে আবিরকে শক্ত করে বুকের উপর ধরে রেখেছে, আর এক হাত দেখা যাচ্ছে না। প্লেনের সীটের নীচে একদম বাঁকা হয়ে আটকে আছে। নড়াতে পারছে না। হাতের উপর অনেকগুলো লাগেজ। মামণির কপাল থেকে গলগল করে রক্ত ঝরছে। আবির ঘুম ঘুম চোখে ততোক্ষণে জেগে উঠেছে। কিছু বুঝতে পারার আগেই মামণি ধাক্কা দিয়ে আবির কে আনিলার গায়ে ফেলে বলল, “সামনের জানালাটা ভাংগা আছে, তোমরা ওখান দিয়ে বেরিয়ে যাও, জলদি!” আনিলা মার হাত ধরে হু হু করে কেঁদে উঠল, “মামণি, তোমাকে আর বাপী কে ছাড়া আমরা একা বের হবো না।” মা নিরুপায় হয়ে এক হাতের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রচণ্ড জোরে ওদের ধাক্কা দিলো। আনিলা আর আবির ভাংগা জানালার মুখে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। দুজনেরই কপাল আর হাত-পা কেটে গেছে। কারা যেন বাইরে থেকে ওদের টেনে বের করে আনলো।

৫.
চারদিকে চিৎকার, কান্না, আহতদের আর্তনাদ, ধোঁয়া আর অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ। উদ্ধারকর্মীরা একের পর এক লাশ বের করে আনছে। বাইরে দাঁড়িয়ে দুই ভাই-বোন ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো।

আনিলা কিছুই বুঝতে পারছে না — হঠাৎ করে কি হলো, কেমন করে হলো, বাপী-মামণি কে দেখা যাচ্ছে না কেন? ওরা কোন দিক দিয়ে প্লেন থেকে বের হলো’? আবির আগুন আর রক্ত দেখে, চোখ বন্ধ করে আনিলা কে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। কেউ এগিয়ে আসছে না বাচ্চা দুটোর কাছে। প্রতিটা মানুষই আঘাত, কষ্ট আর হাহাকারে জর্জরিত। যেন কেয়ামত শুরু হয়েছে কাঠমুন্ডুর ত্রিভুবন এয়ারপোর্টে। আগুন প্লেনের ভেতরে সামনের দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আনিলা দেখল একটু আগেও যেখানে মামণি ছিল, সে জায়গাটাতে এখন আগুন ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না।

অনেক্ষন পর আবির কথা বলল, “আপী! বাপী, মামণি কোথায়?” আনিলা অসহায়ভাবে চারদিকে তাকাতে তাকাতে কেঁদে ফেলল, “জানি না ভাইয়া, প্লেন অ্যাকসিডেন্ট করেছে।” আবির অ্যাকসিডেন্টের মানে কিছুটা আঁচ করলো। তারপর অভিমানের সুরে বলল, “কিন্তু মামণি তো আমাকে প্রমিস করেছিলো, আমাকে রেখে কোথাও যাবে না। মামণি কেন প্রমিস রাখল না, আপী?” হঠাৎ দূরে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলো, “ওই যে মামণি! আমাদেরকে খুঁজছে।” বলেই পাগলের মতো ওইদিকে দৌড় দিলো।

আবির যাকে মামণি ভেবে দৌড় দিলো, সে একজন ইন্ডিয়ান মহিলা। দেখতে অবিকল আবিরের মামণির মতো। সামনে গিয়ে আবির থমকে দাঁড়ালো। কোথা থেকে আবিরেরই বয়সী একটি ছেলে ‘মাম্মি’ ‘মাম্মি’ বলে মহিলাটির কাছে ছুটে আসলো। মহিলাটি ছেলেটির গালে একটা চুমো খেয়ে, হাতে একটা জুসের বোতল ধরিয়ে দিল। পেছন পেছন ছেলেটির বাবাও এলেন দুটো চিপ্সের প্যাকেট হাতে নিয়ে। বাবা-মার মাঝখানে বসে ছেলেটি পরম আনন্দে চিপ্স আর জুস খাচ্ছে- অপলক দৃষ্টিতে আনিলা আর আবির সেদিকে তাকিয়ে রইল।

হঠাৎ আবির আনিলার হাত খামচে ধরল। চিৎকার করে বলতে লাগল, “আপি, মামণি কোথায়? বলো? সবার মামণি আছে, আমার মামণি কোথায়? এক্ষণই আমি মামণিকে দেখতে চাই।” আনিলা কোন রকমে হাত ছাড়াতে ছাড়াতে ভাইকে স্বাভাবিক করার জন্য সান্ত্বনা দিতে লাগল, “নিশ্চয়, বাপী আর মামণিও আমাদেরকে খুঁজছে। চল ভাইয়া আমরা ওইদিকে যাই।”

আবির ফ্লোরে বসে পাগলের মত হাত দিয়ে ঘুষি দিতে লাগল, “পচা,পচা, মামণি একদম পচা, মামণি প্রমিস রাখেনি, আমাকে একা ফেলে চলে গেছে।” অনেক কষ্টে আনিলা আবিরকে ওখান থেকে সরিয়ে নিল।

৬.
আনিলা আর আবিরকে আহতদের সাথে হাসপাতালে নেয়া হলো। দু’জনেরই বেশ কয়েক জায়গায় কেটে গেছে, ঔষধ দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়া হয়েছে। শিলা আন্টিরা আগেই এয়ারপোর্টে ছিল। এখন আনিলা আর আবিরের সাথে হাসপাতালে আছে। আবির ‘মামণি’ ‘মামণি’ করে কেঁদেই চলেছে, কেউ থামাতে পারছে না। আনিলা যাকেই সামনে পাচ্ছে, একটা কথাই জিজ্ঞেস করছে, “শুনেন, আমার বাপী, মামণি কে দেখেছেন? আমার বাপীর নাম রায়হান কবীর…….চশমা পড়ে….লম্বা… আমার মামণি দেখতে অনেক ফর্সা…..হাতে একটা কালো ব্যাগ আছে…..।”

সবাই অবুঝ বাচ্চাদুটো কে মিথ্যে সান্ত্বনা দিতে লাগল, “তোমাদের আব্বু-আম্মু অনেক অসুস্থ তো, ভেতরের কেবিনে আছেন। ঔষধ দেয়া হয়েছে। এখন ঘুমুচ্ছেন। ডিস্টার্ব করা যাবে না।”

শিলা আন্টি জোর করে আনিলা আর আবিরকে বাসায় নিয়ে গেলেন। ঢাকায় আনিলার আত্মীয়স্বজনদের বাড়ীতে ইতিমধ্যেই খবর চলে গেছে। আনিলার মামা-মামী আর ফুপু-ফুপা দুই একদিনের মধ্যেই নেপালে আসছেন।
পরদিন বেশির ভাগ লাশেরই পরিচয় পাওয়া গেলো। কিনতু আনিলার বাবার লাশ এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। আনিলা আর আবির প্রতিদিনই কান্না করে- ‘হাসপাতালে গিয়ে দূর থেকে বাপী আর মামণি কে একটু দেখে আসবে, কোন ডিস্টার্ব করবে না’। কিন্তু একটিবারের জন্যও তাদের কেউ হাসপাতালে নেয় না। ঢাকায় চলে আসার আগের দিন একটি লাশের খবর এল। পুরো শরীরটাই পুড়ে গেছে, চেহারা চেনা যাচ্ছে না। শুধু বাঁ হাতের কব্জিটা অক্ষত ছিল। তার মধ্যে শক্ত করে ধরা একটা কাগজ, স্থানে স্থানে রক্তের ছিটা। তাতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা-
‘চিকচিক চুড়ি’…….. ‘স্টোন বসানো লাল ঘড়ি’……‘রিমোর্ট কনট্রোল জীপ গাড়ী’…… ‘বাবার মত নীল সানগ্লাস’………..চকলেট-মিমি………

৭.
বাবা-মায়ের লাশ নিয়ে আনিলা আর আবির ঢাকায় ফিরল। প্লেনের মধ্যে দুই ভাই-বোন মূর্তির মত শক্ত হয়ে বসেছিল, কোন কথা বলছিল না। প্লেন ছাড়ার আগে আবির একটু পাগলামি করছিল। আবিরের পাশের সীটে ও কাউকে বসতে দিবে না। আবিরের ছোট্ট ব্যাগটাতে ওর মায়ের একটা ছবি ছিল। পাসপোর্টের জন্য ওরা সবাই আলাদা আলাদা ছবি তুলেছিল। ওখান থেকে ৪টা ছবি আবির আগেই ওর ব্যাগে রেখে দিয়েছিল। এখন ওর পাশের সীটে, ওর মামণির পাসপোর্ট সাইজের হাস্যজ্বল ছবিটা শুধু থাকবে; আর কাউকে সে মামণির জায়গায় বসতে দিবে না।

প্লেন চলতে চলতে আনিলারও বার বার মনে হচ্ছিল বাপী যেন ওর কাঁধে হাত রেখে পাশে বসে আছেন, আঙ্গুল উঁচিয়ে সাদা মেঘের দেশ দেখাচ্ছেন, হিমালয় কন্যার গল্প শোনাচ্ছেন…।

সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে বনানী কবরস্থানে লাশ দুটো পাশাপাশি দাফন করা হলো। ছোট আবির তো অত কিছু বোঝে না, কিন্তু লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় আনিলা খুব কান্নাকাটি করছিলো — বাপী আর মামণিকে শুধু একবার সে দেখবে আর একটু আদর করে দিবে। শুধু একবার! আর তো কোনদিন আদর করতে পারবে না।

কিন্তু এই ক্ষত-বিক্ষত পোড়া লাশগুলোকে দেখলে আনিলা যে ওর আদরের বাপী-মামণি কে চিনতে পারবে না, একথা মুখ ফুটে কেউই বলতে পারছিল না।

৮.
বাপী, মামণি চলে গেছে প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল। আনিলার দাদু আর নানা বাড়ীর লোকেরা অনেক চেষ্টা করেছিল দুই ভাই-বোনকে তাদের সাথে নিয়ে যেতে। কিন্তু ওরা মামণির হাতে গোছানো এই ফ্ল্যাটটি ছেড়ে কোথাও যাবে না। এখানে যে ছড়িয়ে রয়েছে বাপী, মামণির অসংখ্য স্মৃতি। আনিলার দাদু আর ফুপী ওদের সাথেই এখানে থাকে। রাতে আবির প্রায়ই ঘুমের মধ্যে ‘মামণি’ ‘মামণি’ বলে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে।

সেদিন বিকেলে ফুপি ছাদে গিয়ে দেখে, দুই ভাই-বোন ঘুড়ি ওড়ানোর চেষ্টা করছে। অনেক দিন পর দু’জনকে একসাথে খেলতে দেখে ফুপি একটু স্বস্তি পেলো। যাক, বাচ্চা দুটো স্বাভাবিক জীবনে আবার ফিরে আসছে।

ফুপি কে দেখে আবির বলল, “জানো ফুপি, আমরা না প্রায় বিকেলেই বাপীর সাথে ছাদে ঘুড়ি ওড়াতাম।” ফুপির চোখে পানি এসে গেল। প্রসংগ পাল্টাতে ফুপি আনিলাকে ডাকলেন, “আনিলা মা, তুমি কি করছ?” আনিলার হাতে একটা সাদা কাগজ, তাতে কি কি যেন লেখা। ঘুড়ির গায়ে আঠা দিয়ে লাগানোর চেষ্টা করছে।

আনিলা দৌড়ে এসে বলল, “ফুপি, সকিনা খালা মানে আমাদের বুয়া বলেছে, মানুষ মারা যাওয়ার পর আকাশের তারা হয়ে যায়। আমি আর আবির মিলে বাপী আর মামণিকে একটা চিঠি লিখেছি। কিন্তু অত দূরে চিঠিটা পাঠাব কিভাবে? তাই ঘুড়ির গায়ে চিঠিটা লাগিয়ে দিচ্ছি। ঘুড়িটা উড়তে উড়তে তারার দেশে গিয়ে বাপী-মামণি কে চিঠিটা পৌঁছে দিবে।”

ফুপি অনেক কষ্টে কান্না চেপে বললেন, “কই, দেখাও তো চিঠিটা।” আনিলা সাদা কাগজটা নিয়ে আসল।
………………
প্রিয় বাপী, প্রিয় মামণি,
তোমরা কেমন আছ? আমরা ভালো নেই। তোমাদের জন্য খুব খারাপ লাগে। জানো, আমরা প্রতিদিনই লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাদের জন্য কাঁদি। আচ্ছা, তোমাদের কি আমাদের উপর অনেক রাগ?

মামণি তুমি প্রায়ই বলতে, “যেসব বাচ্চা বাবা-মাকে কষ্ট দেয়, তাদের বাবা-মাকে আল্লাহ্‌ নিয়ে যায়।” সেজন্যই কি তোমরা তারার দেশে চলে গেছো?

আমি প্রমিস করছি, ইনশাআল্লাহ্‌ আর কখনো তোমাদের কষ্ট দিব না। সন্ধ্যে হলেই হোমওয়ার্ক নিয়ে বসে যাব, বেশি কার্টুন দেখব না, প্রতিদিন ভাতের সাথে শাক-সব্জি খাবো, টিফিন নষ্ট করব না, আবির এর সাথে ঝগড়া করব না, তোমাদের সাথে মেজাজ করে কথা বলব না, এবার অনেক পড়াশোনা করে ফাইনাল পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে দেখাব ইনশাআল্লাহ্‌।

আবিরও প্রমিস করেছে। এখন থেকে নিজের হাতে ভাত খাবে, প্রতিদিন বিকেলে দুধ খাবে, বেশি গেমস খেলবে না, বেশি চিপস, চকলেট খাবে না, স্কুলে কারো সাথে মারামারি করবে না, লাইট আলা জুতো কিনে দেয়ার জন্য বাপীর সাথে জেদ করবে না আর কথায় কথায় কাঁদবে না।

সত্যি বলছি! সত্যি ! সত্যি ! সত্যি ! আমরা এখন থেকে খু….ব ভালো হয়ে যাব, ইনশাআল্লাহ। আর কখনো, কোনদিন তোমাদের জ্বালাবো না, কষ্ট দিব না, অবাধ্য হব না।

প্লি-জ বাপী, প্লি-জ মামণি, তোমরা ফিরে এসো। আমরা তোমাদের খু-ব খু-ব ভালবাসি। আমাদের যে অ—নে—–ক, অ—নে—–ক কষ্ট হচ্ছে………।

অনেক, অনেক আদর
– আনিলা

ও নে ক লা ভ
– আ বি র
………………………………

ফুপি কোনভাবেই কান্না আটকাতে পারলেন না। দুই ভাই বোনকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদলেন। তারপর চোখ মুছে বললেন, “শোন মা, মানুষ মারা যাওয়ার পর আকাশের তারা হয়ে যায় না, আল্লাহ্‌র কাছে চলে যায়।”

আবির পশ্চিম আকাশে সদ্য ঢলে পড়া লাল সূর্যটার দিকে তাকিয়ে উদাস গলায় জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা ফুপি, যারা আল্লাহ্‌র কাছে চলে যায়, তারা কি আর কখনো ফিরে আসে না?” ফুপি আবির কে বুকে টেনে বললেন, “না, বাবা।”

*আগামী পর্বে সমাপ্ত*
………………
প্রিয় বাপী, প্রিয় মামণি
উম্মু জুয়াইরিয়াহ