মা

‘ডাক্তার, আমি প্রতি সন্ধ্যায় ওর মৃত্যু কামনা করি, আর প্রতি সকালে ওর সুস্থতা।’ লরেটা কান্নায় ভেঙে পড়ল। ‘আমি কিভাবে এত খারাপ মা হয়ে গেলাম? আমি তো ওই মায়ের চেয়েও খারাপ যে তার ৫ সন্তানকে মেরে ফেলেছে।’

‘লরেটা, তুমি অত্যন্ত চমৎকার একজন মা। তারচেয়েও বড় কথা, তুমি অসাধারণ এক মানুষ। আমরা পাশাপাশি দাঁড়িয়েই কিন্তু রেডগ্রোভের ভিক্টিমদের সাহায্য করেছি। তুমি প্রতিটা বাচ্চাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে প্রাথমিক সেবা দিয়েছ যেন তারা তোমার নিজের। ঝলমলে রোদ্দুরের দিনেও কিন্তু আচমকা ঝড়বৃষ্টি আসে।’ চিকিৎসক লোগান মৃদু গলায় উত্তর করল। তার ধূসর চুল জানালা দিয়ে চুঁইয়ে আসা রোদে চিকচিক করছে। ‘লরেটা, তুমি কি আমাকে বলতে চাও তুমি কেন নাওমির মৃত্যু কামনা কর?’

‘নাওমি, ওহ, আমার এত সুন্দর, জীবনে ভরপুর মেয়েটা।’ হাত বাড়িয়ে ডাক্তারের কাছ থেকে ট্যিসুটা নিয়ে চোখ মুছল লরেটা। পরক্ষনেই আবার উপচে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল গাল বেয়ে। ‘আমার খুব সাধনার মেয়ে নাওমি, আপনি তো জানেন। সায়মনের সাথে রীতিমত ঝগড়া করেই দ্বিতীয় সন্তান নেয়া। সবকিছু ঠিকও হয়ে গিয়েছিল ওর জন্মের পর। ডক্টর, আপনি কি বিশ্বাস করবেন যদি বলি নাওমি একেবারে ফেরেশতাদের মতন দেখতে ছিল জন্মের সময়?’

‘ঠিক তার মায়ের মতন!’

কাষ্ঠ হেসে নাক টানল তেত্রিশে পা দেয়া লরেটা। ‘থাক, আপনাকে তোষামোদি করতে হবে না, ডক্টর। যা হোক, যেটা বলছিলাম। নাওমি সব কিছুতেই সেরা ছিল, দেখতে তো বটেই, কিন্তু অন্য সব দিকেও। ব্যালে, পিয়ানো বাজানো, সাঁতার সমস্ত কিছুই ও তিন বছর বয়সে আয়ত্তে এনেছিল। সবাই ওকে ‘ওয়ান্ডার চাইল্ড’ বলত। কিন্তু তিন বছরের জন্মদিনের কিছুদিন পরেই ওর ভয়ংকর অসুখটা ধরা পড়ল। আমার কেন যেন মনে হয় আমার দোষেই ওর এ অসুখটা হয়েছে। হয়ত আমি..আমি ও পেটে থাকতে এমন কিছু করেছি…’

‘লরেটা, আমরা এটা নিয়ে আগেও কথা বলেছি। এমন কিছুই নেই, কিচ্ছুই না যা তুমি অন্যভাবে করতে পারতে যাতে নাওমির ব্রেইন ক্যান্সার হত না।’

‘ব্রেইন ক্যান্সার!’ বিড়বিড় করল লরেটা।নিজের কানেই কেমন অদ্ভুত শোনাল। অথচ গত দেড় বছর ধরে শত হাজারবার এ শব্দগুলি তাকে শুনতে হয়েছে। যেদিন প্রত্যেক সকালের মতনই চিরপরিচিত দোতলার সিঁড়িগুলো বেয়ে নামার সময় নাওমি পায়ের অনুভূতি হারিয়ে পড়ে যায় তার কিছুদিন পর থেকেই। ‘হ্যা, ওর ডাক্তাররাও তাই বলেছিল। কিন্ত আমার মেয়ের কেন এমন হবে? আমার মেয়েরই কেন? সায়মনও বলছিল আমারই দোষ। তাইতো ও আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেল। ও আর নিতে পারছিল না।’

‘সায়মান পালানোর পথ খুজঁছিল তার দায়িত্ব থেকে এবং সেটা সে পেয়ে গেছে। তোমাকে আগাতে হবে এখন, বুঝতে পারছ কি বলছি? তুমি যদি সায়মনের কথা বেদবাক্য হিসেবে ধরে নাও তাহলে তুমি অতলে ডুবে যাবে, ডুবতেই থাকবে। লরেটা, সামনে তোমার কেস শুনানি আছে লেভিনের কাস্টোডির জন্য। আর তোমার জন্য নিজেকে মানসিক ভাবে শক্ত থাকাটা খুব জরুরী।’

‘লেভিন! হ্যা, শুধু লেভিনের জন্য কাস্টডি ব্যাটেল। হাহা।’ হাসিটা ফাঁকা, খাপছাড়া শোনাল ডক্টর লোগানের উষ্ণ চেম্বারে। ‘কারন আমার লেভিন সুস্থ বাচ্চা। তাই সায়মন লেভিনকে চায় শুধু। আর নাওমি ডিফেক্টেড জিনিশ। জিনিশ! শুনেছেন, ডক্টর? আর আমি ডিফেক্টেড জিনিশ তৈরিকারী মেশিন। ‘ কিছুক্ষণ থেমে চোখ মুছে আবার কথা শুরু করল লরেটা। ‘আমার জীবনটাকে যেভাবে দেখি জীবন আমাদের সেভাবেই দেখবে তা জরুরী না, আমার নানি বলত। আমি মাঝে মাঝে ভাবি বাবা মা আমাকে নিয়ে পর্তুগাল থেকে না আসলে আমার জীবনটা অন্যরকম হত। আমি এখানে সেন্ট্রাল কলেজে নিউট্রিশন পড়তাম না, আর সায়মনের সাথেও দেখা হত না।’

‘হয়ত তারপরেও তোমার একটা ফুটফুটে নাওমি হত। তবে হয়ত সে অত উন্নত চিকিৎসা পেত না। হয়ত তুমিও এত ভালো চাকরী করতে পারতে না। হয়ত, হয়ত, হয়ত। জীবন ভরা ‘হয়ত’ আর ‘যদি’ আমাদের। কিন্তু তুমি কি ভেবে দেখেছ যে তুমি নিজেকে পড়ে যেতে না দিয়ে যদি এক এক দিনের জন্য বাঁচতে তাহলে আগামীকাল নিয়ে ভয় পেতে হত না?’ চামচের হালকা টুংটাং শব্দ তুলে লোগান তাদের দুজনের জন্য চা বানালো। নিজেরটায় এক কিউব চিনি আর লরেটারটায় দু কিউব গুলে দিয়ে লরেটার কাপটা তার হাতে ধরিয়ে দিল। গত ছমাস ধরে সপ্তাহে তিন দিন এমনটাই রুটিন মাফিক চলে আসছে। মুখ তুলে দেয়ালের কোকিল ঘড়ির দিকে তাকালো লোগান। কোকিলটা অবশ্য চুপ করিয়ে দেয়া হয়েছে, লোগান চায় না তার রোগীরা তড়িঘড়ি করে চলে যাবার চাপ অনুভব করুক। আরো আধা ঘন্টা বাকি আছে তাদের সেশনের। একটু বেশীক্ষণ লাগলেও লোগান কিছু মনে করবে না। বাস্তবিকই লরেটার জন্য তার মায়া লাগে, নাওমির সাথে দু একবার সাক্ষাতের পরে আরো বেশী। কি অসম্ভব সুন্দর মেয়েটা, একইরকম অসম্ভব তার এই বাজে অসুখটি সারানো।

‘আমি প্রতি সকাল ভয় পাই। প্রতি সকালে আতঙ্ক গ্রাস করে আমাকে যে নাওমির হাপরের মতন বুকের উঠানামা দেখতে পাব নাকি, ওর ক্লান্ত নিশ্বাস থেমে গেছে নাকি ঘুমের মাঝে এসব ভেবে। কফি বানাতে নিচে নামলে উপরতলায় কোন শব্দ শুনলেও ভয় পাই, মেয়েটা পড়ে গেল নাকি বিছানা থেকে। লেভিন, আমার আট বছরের ছেলেটাও এখন সকালবেলাটা পা টিপে টিপে হাঁটে, যাতে আমি চমকে না যাই। সারা দিন মেয়েটার বেঁচে থাকার আপ্রান চেষ্টা দেখি, দেখি মেয়েটা আগের মতন দৌড়াতে চেষ্টা করছে, ব্যালেন্স ঠিক রাখার প্রয়াস করছে আপ্রাণ। যখন দেখি পরীর মতন মেয়েটার মাথাটা সবসময় এক পাশে হেলে আছে, মুখ থেকে লালা বেরোচ্ছে আর তবুও সে গুঙিয়ে গুঙিয়ে কত কথা বলার চেষ্টা করছে তখন বুক ভেঙে খানখান হয়ে যায় আমার। সেদিন একটা বেলুন আঁকতে গিয়ে সতেরো বার হাত থেকে ক্রেয়ন পড়ে গেল তার। ‘ হু হু করে কাঁদতে লাগল লরেটা। ডক্টর লোগান বাধা দিল না। তার মতে, কাঁদার দরকার আছে, অনেকটা সেল্ফ হিলিং-এর কাজ করে।

‘আমার মেয়েটার এত এত চেষ্টা সব বৃথা হয়ে যাবে ডক্টর? নাওমির চোখের ফুটে ওঠা আকুতি, বার বার জানতে চাওয়া তার ব্যাথাগুলো উপশম হয়ে কবে সে আগের মতন ভালো হয়ে যাবে, আমাকে অপরাধী করে চলে প্রতিনিয়ত। আমার মনে হয় আমার মেয়েটা বরঞ্চ মরে যাক, নিশ্চিন্তে ঘুমে মাঝে, কোন কষ্ট ছাড়াই। আমার এত আদরের মেয়েটা…আমি চাই মরে যাক!’ হাহাকারের মতন লরেটার কণ্ঠ ভাসছে লোগানের অফিস কামরায়। ‘সাথে যদি আমিও মরে যেতে পারতাম! কিন্তু আমার লেভিন। লেভিনের তো কোন দোষ নেই।’

দোষ এখানে কারোরই নেই, লরেটা। গাফিলতি আছে, তবে তা সায়মনের। তুমি তোমার লড়াই অব্যাহত রাখবে। টর্নেডো আসলে কিন্তু সবসময় পালিয়ে যাওয়া একমাত্র পন্থা না, বরং টর্নেডোর মাঝে পড়ে গেলে কিভাবে টিকে থাকা যায় সে কৌশল বের করাটাই সারভাইভরদের কাজ। আর, তুমি আমার দেখা সবচেয়ে সেরা সারভাইভর। গতবাধা কথা নয়,তুমি সত্যি প্রশংসার যোগ্য। ‘

লরেটা প্রতিউত্তর করল না, তবে কান্না থামিয়ে তার ঝকঝকে সবুজ চোখ মেলে জানালার বাহিরে তাকালো। হাইস্কুলে পড়াকালীন সময় এক সৌন্দর্য কম্পিটিশনে সে সব ছাত্রছাত্রীর ভোটে ‘কুইন’ নির্বাচিত হয়েছিল। আহ, সে কি উচ্ছাস, কি আনন্দ। অথচ এখন কতকাল মনে হয় নিজেকে আয়নায় খুঁটিয়ে দেখা হয় নি। এই হয়ত প্রথম সামার যে সে পিছনের বাগানে কোন সবজি, ফুলের গাছ লাগায় নি। সময় কি থেমে গেছে নাওমির মেডিকেল ফাইল আর একগাদা ওষুধপত্রের মাঝে?

‘তুমি হস্পিটালের মমসদের ক্লাবে যাচ্ছ তো নিয়মিত? ওখানে তোমার মতন অনেক মম থাকার কথা। এই জার্নিতে কেউ কারো না এটা ঠিক, তবে আরেকজনের সাহসে উজ্জীবিত হয়ে নিজের যুদ্ধ লড়াইয়ের নতুন কৌশল, পথ চলার অনুপ্রেরণা তুমি পেতেই পারো।’

‘যাচ্ছি, ডক্টর।’ ছোট করে বলল লরেটা।

‘আর? এনিথিং ইন্টারেস্টিং? ‘

‘উমম, ইন্টারেস্টিং কিনা জানি না। তবে এক মায়ের সাথে পরিচয় হয়েছে। হাফসা নাম। ও মুসলমান, সিরিয়া থেকে এসেছে এক যুগ আগে। প্রথম প্রথম এড়িয়ে চলতাম, কেমন জানি অস্বস্তি হত সারা শরীর ঢেকে রাখা বেশভূষা দেখে।’

‘এখন অস্বস্তি কেটে গেছে?’

‘হুম। আমরা বেশ ভালো বন্ধু এখন। এই সানডে বিকালে চা খেতে ডেকেছি। ওর ছেলের হাড়ের ক্যান্সার…লাস্ট স্টেজ। নাওমির চেয়ে বছরখানেক বড়। আমার মনে হয় ওরাও ভালো বন্ধু হতে পারবে।’

‘চমৎকার, লরেটা। অন্যের দুঃখ সামনাসামনি দেখলে নিজেরটা সামলাতে তুলনামূলক ভাবে সহজ হয়ে যায়।’ ডক্টর লোগান উচ্ছ্বসিত গলায় বলে উঠল। তার সত্যি মনে হচ্ছে এবার লরেটার মনোবল অনেকটা দৃঢ় হবে। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছেন, ভিন্ন পশ্চাতপট থেকে আসা দুজন পৃথক সত্তা একসাথে হলে তাদের জোট বেশ ফলপ্রসূ হয়।

‘ও দেখতে ভীতু হলেও আমার মতন ভঙ্গুর না। ওর বাদামী চোখগুলোতে কি যেন আছে, ডক্টর। এক অসম্ভব মনোবল, আর কেমন এক শান্তি। ওর স্বামী এক্সিডেন্টে মারা গেছে, তবুও ওর মাঝে হতাশা নেই। ওর ধারনা…ওর বিশ্বাস এর পরেও এক জীবন আছে। আহমাদ..ওর ছেলে..সেখানে গেলে কিছুদিন পরে হাফসাও আহমাদ আর আহমাদের বাবার সাথে মিলিত হবে। ও সবসময় বলে, দিস পেইন ইয টেম্পোরারি।’

‘আই সি। আর তোমার কি ধারণা? ‘

‘আমি…আমি এখনো ঠিক জানি না। আসলে আমি কখনো গডকে নিয়ে ভাবিই নি তেমন। ছোটবেলায় চার্চে যেতাম, এখন ওসব কেবল স্মৃতি। হাফসা অবশ্য আমাকে পুশ করে না, ও নিজের শক্তির উৎসের কথাই বলে। আমি এখনো ঠিক ধরতে পারি না কিভাবে এত শান্ত থাকে সে, তবে একবার হলেও আমি তা এক্সপিরিয়েন্স করতে চাই।’

সেশন শেষে ডক্টর লোগানকে বিদায় জানিয়ে নিজ গন্তব্যে পা বাড়ালো লরেটা। দিনের এখনো অনেকটাই বাকি। নাওমি আর লেভিনের কাছে স্পেশাল বেবি সিটার রেখে এসেছে, নারসিং শিক্ষানবিশ মেয়েটা নাওমিকে সামলাতে বেশ দক্ষ। নিজ থেকে আদর করে প্রায়শই এটা সেটা খাবার বানিয়ে এনে দেয় নাওমি আর লেভিনকে। আহ, এত এত মানুষের আদর ভালোবাসা যদি নাওমিকে সুস্থ করে তুলতে পারত! ফোনের কাঁপুনি অনুভব করে ফোন বের করল ব্যাগ থেকে তড়িঘড়ি। হাফসা! বাহ, একটু আগে যখন ওর কথাই হচ্ছিল ডক্টর লোগানের অফিসে তখন আকস্মিক ভাবেই উপলব্ধি হল, সে খুব পছন্দ করে হাফসাকে। মেয়েটার ভ্রু জোড়ার নিচের বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দেখলে কেন যেন খুব আপন মনে হয়।

‘হেই! কেমন আছ, হাফসা?’

‘ভালো! তুমি?’

‘আমি ভালো নেই। তুমি কিভাবে ভালো আছ?’

‘প্রিয় বন্ধু, বেচেঁ থাকাই ভালো থাকা। কিভাবে ভালো থাকবা এটা অবশ্য তোমার সিদ্ধান্ত। ‘

‘বাপ রে! কে বলেছে এসব? তোমার গড?’

হেসে ফেলল হাফসা, ‘হুম! তোমারও।’

‘আর কি বলেন উনি? এত কষ্ট কেন দেন আমাদেরকে এটা কি বলেছেন? আমার মতন দুর্বল মানুষদের জন্য এ পরীক্ষা খুব বেশী, উনি কি জানেন না?’ হালকা সুরে কথাটা বললেও লরেটা গলার ক্ষোভ লুকাতে পারল না।

‘আলবৎ! আল্লাহ্‌ বলেছেন, যার যতটুকু
ধারণক্ষমতা তাকে ততটুকুই দেয়া হয়, এর বেশিও না, কমও না।কষ্টের ব্যাপারটাও তাই। যে যত বিশ্বাসের সাথে মোকাবেলা করবে, তার সম্মান গডের কাছে ততই বেশী, পুরষ্কারও।’

টুকটাক এমন কথা আগাতে থাকল আর লরেটার পথ ক্রমশ ছোট হতে লাগল। পর্তুগালের ছোট্ট মেয়ে লরেটা আর সিরিয়ার অলি গলিতে খেলা করা চপলা বালিকা হাফসা হাজার হাজার মাইলের দূরত্ব ঘুচিয়ে গ্রীষ্মের এক পড়ন্ত বিকেলে ভীন কোন দেশে মা নামক এক সত্ত্বায় মিলেমিশে ভীষণতর ভাবে একাকার হয়ে উঠল।

মা
নাবিলা নোশিন সেঁজুতি

জুলাই ০৫, ২০১৮ইং