অধিকার

স্বামীঃ “তুমি জানো, ইসলামে আমাকে তোমার উপর কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে? সুতরাং আমি যা বলবো, তোমাকে তাই শুনতে হবে! যাও, আমার মায়ের পা টিপো বসে বসে!”

স্ত্রীঃ “ইসলামে এটাও আছে, স্ত্রী কে প্রয়োজনে আলাদা সংসার দেয়ার কথা! আর বউ তার শশুর শাশুড়ির সেবা করতে বাধ্য নয়!”

স্বামীঃ “তাই? এত কিছু জানো, আর এটা জানো না, যে মহিলা তার সব ইবাদত ঠিক রেখে স্বামী কে সন্তুষ্ট রাখা অবস্থায় মারা যাবে, সে জান্নাতে যাবে? এই তোমার সন্তুষ্ট রাখার নমুনা!”

স্ত্রীঃ “বিয়ের সময়ের দেন মোহরের টাকাই এখনো দাও নি, আর এসেছো স্বামীগিরী ফলাতে! হাদিসে এমনও আছে, সেই ব্যাক্তি উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম। তোমার মধ্যে তো আমি উত্তম কিছু দেখছি না।”

এভাবে ঝগড়া চলতেই থাকে… চলতেই থাকে… কিন্তু, এই ঝগড়ার শেষ কোথায়?

হুম… বলছি। তার আগে চলুন একটি গল্প শুনে নেই 

🙂 

“অন্ধের হস্তি দর্শন”

১ম ব্যাক্তিঃ হাতি দেখতে কুলার মতন। (কারন সে হাতির কানটিই শুধু ধরে দেখেছে)

২য়ঃ হাতির পা ছুয়ে বলে, হাতি তো বিরাট বড় খাম্বার মত!

৩য়ঃ লেজ ধরে বললো, “কি বলেন আপনারা উলটা পালটা। হাতি তো দেখতে চাবুকের মতো!

৪র্থঃ হাতির দাঁত যে ধরেছে সে বললো, “আপনাদের সবারই মাথা খারাপ হয়ে গেছে! তলোয়ারের মত বাঁকা আর চোখা জিনিসকে আপনারা বলছেন, কুলা, চাবুক আর খাম্বার মত??

গল্পে কেউই কিন্তু মিথ্যা বলে নি। আবার তাদের কথাই যে একমাত্র সত্য, তাও নয়।

এবার চলুন মূল কাহিনীতে ফিরে যাই। আমাদের অনেকের একটা বড় সমস্যা হল, আমরা ইসলাম কে দেখি, অন্ধদের হাতি দেখার মত করে! নিজেরা যতটুকু জানি, সেটুকুকেই চূড়ান্ত জ্ঞান মনে করি। 

এবং যখন কোন সমস্যায় পরি, তখন আলেম ওলামাদের থেকে “ফতোয়া শপিং’ শুরু করি। অর্থাৎ, বেছে বেছে নিজের স্বার্থের সাথে জড়িত হাদিস আর কুরআনের কথাগুলো জোগাড় করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করি। 

শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে সমাজে পুরুষের দাপট বেশি ছিল, তাই আমরা এত দিন কেবলই পুরুষের কাজে লাগবে এমন ইসলামী বিধান গুলো শুনেছি। যেমন, রাতে স্বামীকে অসন্তুষ্ট রাখলে, ফেরেশতারা সারা রাত স্ত্রী কে অভিশাপ দেয়। 

আজকাল নারীরাও কিছুটা পড়াশোনা শুরু করায়, তারা এখন নিজেদের কাজে আসবে এমন হাদিসগুলোই খুঁজে নিয়ে আসেন। ফলাফল স্বরুপ স্বামী স্ত্রী দুজনেই ইসলামকে ‘হাতি দর্শনের’ অবস্থায় নিয়ে যান!

এ সমস্যা থেকে উত্তরনের একমাত্র পথ হলো, আমাদের ‘চোখ খুলে’ ইসলামকে দেখতে হবে! শুধু নিজেদের পছন্দের ফতোয়া না খুঁজে, যে কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে সামগ্রিক ভাবে ইসলামে কি বলা আছে, তার সব কিছু পড়তে/ জানতে হবে! দ্বীনের whole picture টি উপর থেকে দেখতে হবে। অন্ধের মত শুধু খাম্বার মত পা আর কুলার মত কান নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না!!

whole picture দেখার চেষ্টা করলে আমরা একটা মজার জিনিস আবিষ্কার করবো! 

অবাক হয়ে ধীরে ধীরে টের পেতে শুরু করবো, আমাদের ধর্মটি শুধু নারীদের কিংবা পুরুষদের জন্য নাযিল করা হয় নি। পুরো মানব জাতির জন্য নাযিল হয়েছে।

বাই দা ওয়ে, যারা ভুলে গেছেন তাদের বলছি, নারী এবং পুরুষ উভয়কে নিয়েই মানব জাতি গঠিত। 

একবার স্বামী স্ত্রীদের নিয়ে একটা কনফারেন্স হয়েছিল। সেখানে দুটো লিফলেট তৈরি করা হয়েছিল। একটাতে ছিল স্বামীর অধিকার এর লিস্ট, অন্যটাতে ছিল স্ত্রীর অধিকারের লিস্ট। 

মহিলাদের হাতে স্বামীর অধিকারের লিস্ট ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল আর পুরুষদের হাতে দেয়া হয়েছিল তাদের অর্ধাঙ্গিনীরটি।

কনফারেন্স আয়োজকদের এ কৌশলের মাঝেই আসলে লুকিয়ে রয়েছে আমাদের কাঙ্খিত সমাধান।

আমরা যখন সব সময় কেবল নিজের স্বার্থ দেখা বাদ দিয়ে, আমাদের পাশের জনের অধিকারগুলোকেও সম্মান দেখানো শুরু করবো, পাশের জনের প্রতিও দায়িত্ব পালন শুরু করবো এবং এ ধরণের মানসিকতা যদি স্বামী-স্ত্রী দুজনের মাঝেই থাকে, তাহলে ইন শা আল্লাহ্‌ সারা জীবন তারা ঝগড়া মুক্ত জীবন কাটাতে পারবেন, কোন সন্দেহ ছাড়া।

ইসলাম শুধুই ‘তোমার’ কিংবা ‘আমার’ সম্পত্তি নয়। এটি একটি অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। তাই অর্ধেক ধর্ম নিয়ে লাফালাফি না করে পুরোটা জানার চেষ্টা করলে, ‘নারীবাদী’ নারীরাও উদ্ধত কথা বলা বন্ধ করবে আর নির্যাতনকারী পুরুষরাও দাপট দেখানো ছেড়ে দেবে। 

“অধিকার”
হাসনীন চৌধুরী
(১৯ নভেম্বর ২০১৭)