প্রত্যাশা

ভাইয়ার বিয়ের দিনের কথা। দুরত্ব ঢাকা টু চিটাগাং। কমিউনিটি সেন্টার থেকে বিদায় নিয়ে ভারী গয়না ও সাজ সজ্জায় অলংকৃত নববধূ কে সঙ্গে করে সোজা প্লেনে করে ঢাকায় ফিরলো ভাইয়া। আমরা বাকিরা ফিরলাম বাই রোডে।

রাত তখন আটটা, বাসায় ফিরে দেখি ঘর ভর্তি লোকজন। কাছের সব আত্মীয় স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীরা ভাবী কে দেখতে এসেছে। মায়ের চোখ ছলছল। প্রথম সন্তানের বিয়ে, বাবার কথা খুব করে মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। এতকিছু ছাপিয়ে সেদিন যে জিনিসটা আমাকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছিলো তা হলো, আমার ভাবীর চোখগুলো।

গত কিছুদিনের শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি , নতুন পরিবারের নতুন মানুষদের মাঝে কিছুটা ভীত সন্ত্রস্ত আবার একই সাথে বহু আকাংখিত মানুষটাকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়ে সীমাহীন আনন্দ এবং নিজ বাড়িতে ফেলে আসা বাবা মা ভাই বোনের জন্য আকুলতা – চোখের ভারী মেইক আপও যেন আড়াল করতে পারছিলোনা এই অনুভূতিগুলো। আমার নিজেরও তখন বিয়ে হয়নি তবুও সেদিন ভাবীর মুখখানার দিকে তাকিয়ে আমি অসামান্য মায়া অনুভব করলাম।

বিয়ে নামক সম্পর্ক টা হঠাৎ করে একদল অপরিচিত অজানা মানুষের মাঝখানে এনে ফেলে দেয়। জন্মের পর থেকে এক রকম পরিবেশ পরিজনের মধ্যে বেড়ে উঠা মেয়েটি, বিয়ের পর সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন চিন্তা চেতনার মানুষগুলোর সাথে হঠাৎ করেই এক ছাদের নিচে বসবাস করা শুরু করে। জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং সময়টা একটা মেয়ের জন্য বোধ করি ঠিক তখন থেকেই শুরু হয়ে যায়।

সবকিছু সুন্দর করে সে ম্যানেজ করে নিতে পারবে কি পারবেনা, এই দুশ্চিন্তা তাড়া করে বেড়ায় বাকি জীবন। এই সময়টাতে যে মানুষটার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব রাখে মেয়েটার জীবনে, সে মানুষটা হলো তার স্বামী।

আমাদের মা চাচীদের সময় বিয়ের আগেরদিনও উনারা দেখতে পেতনা কিংবা জানতো না, যে মানুষটার সাথে বাকি জীবনের জন্য এক রুমে এক বিছানায় কাটাতে হবে সে মানুষটা আসলে কেমন। এখন দিন বদলেছে, বিয়ের আগেই প্রচুর জানাশোনা হয়ে যায় সম্ভাব্য জীবন সঙ্গীর সাথে।

তবে সময়ের সাথে সাথে আমরা যতই আধুনিক হইনা কেন, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে প্রত্যাশাগুলো কিন্তু পরিবর্তিত হয়না। স্বামী হিসেবে একজন পুরুষের কাছে থেকে আমার নানী কিংবা আমার মা-শ্বাশুড়িরা যা আশা করতেন, আমরা এখনও তা করি এবং আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের নারীরাও বোধ করি তাই করবে।

“একজন নারী তার স্বামীর কাছে সাধারনত কি কি প্রত্যাশা করে” – এই শিরোনামে আমেরিকায় একবার একটা জরিপ হয়েছিলো। সেক্যুলার সমাজের নারী হলেও এই জরিপে যে যে ব্যপারগুলো উঠে এসেছে তা আমার জন্য ছিলো রীতিমত বিস্ময়কর! জরিপের মূল পয়েন্টগুলোর সাথে স্বামীর প্রতি একজন নারী ও স্ত্রী হিসেবে নিজের চিন্তা বহির্ভুত আরও কিছু পয়েন্ট জুড়ে দিলাম।

জরিপের সর্বপ্রথম পয়েন্ট ছিলো “ Assurance of love “ –

একজন স্ত্রী যত কম শিক্ষিত কিংবা উচ্চ শিক্ষিত হোক না কেন, সে সব সময় তার স্বামীর নিকট থেকে আমৃত্যু যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা করে তা হলো “ভালোবাসার নিশ্চয়তা”।

প্রত্যেকটা মেয়ে বিয়ের দিনে কাঁদে। হাসব্যান্ড পূর্ব পরিচিত হোক বা না হোক তারপরও কাঁদে! কেন? কারন বাবার বাড়িতে যে ভালোবাসার ছায়াতলে তার শৈশব কেটেছিলো সে ভালোবাসা তার স্বামীর বাড়িতে গিয়ে পাবে কিনা এরকম একটা ভয় তার মনে জেঁকে বসে। আর এই ক্ষেত্রে আইস ব্রেকিং এর কাজটা করতে হয় তার স্বামী কে। স্বামী যদি তাকে নানা ভাবে নিশ্চয়তা দিতে থাকে no matter what happens in our life, I will be there for you all the time – তবে দাম্পত্য জীবনটা অদ্ভুত রকমের সুন্দর হতে পারে।

এপ্রিসিয়েশন বা মূল্যায়ন –

স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে জীবনভর যে জিনিস টা সবচেয়ে কম পেয়ে থাকে তা হলো, মূল্যায়ন !! একজন স্ত্রী তার সাধ্যের ভিতর নিজ সংসারটা কে সুন্দর রাখার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে। নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা কে সাইডে রেখে স্বামী সন্তানদের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।

এ ব্যপারটাতে যে তার মনক্ষুন্ন থাকে তা নয় বরং অত্যন্ত আনন্দ নিয়ে হাসিমুখে সে কাজগুলো করে। কিন্তু স্বামীরা তাদের স্ত্রীর এ strength কে weakness মনে করে taken for granted নিয়ে নেয় যার দরুন আমাদের বেশির ভাগ পরিবারে নারীর অবমূল্যায়ন হয়ে থাকে বছরের পর বছর।

সারাদিনের সাংসারিক পরিশ্রম শেষে বিছানায় ঘুমাতে এলে কেউ যদি একটু আবেগ মাখা কন্ঠে মাথায় হাত দিয়ে বলে “তোমার খুব কষ্ট হয় …না? আমি তো তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনা! আমি স্বামী হিসেবে আসলে খুব খারাপ একটা মানুষ”। দেখবেন, আপনার স্ত্রী আপনাকে পৃথিবীর সব চাইতে ভালো স্বামী মনে করে পুলকিত হবে।

ইমোশনাল সিকিউরিটি –

পুরুষের তুলনায় নারীরা আবেগ তাড়িত বেশি হয়। এজন্য দেখা যায়, স্বামী হয়ত অফিসে কাজে ব্যস্ত অথবা কোথাও কাজে আটকা পড়েছে কিংবা দেরী হচ্ছে অথচ স্ত্রী কে কল দিয়ে বা নিম্নতম টেক্সট ম্যাসেজ করে জানানোর প্রয়োজন মনে করছেনা কিন্তু স্ত্রী সারাদিন সাংসারিক পরিশ্রমের ফাঁকে ফাঁকে ব্যাকুল থাকে তার স্বামীর খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য । এ ব্যপারটিকে একজন স্বামী ক্ষেত্র বিশেষে বিরক্তিকর মনে করে অথচ এটা যে তার জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা প্রদত্ত নিয়ামত, এটা বোধ করি তারা অনুভব করেনা।

স্বামীরা, আপনারা রিযিকের জন্য বাহিরে যান। কাজের প্রচুর প্রেসার থাকে কিন্তু তারপরও প্রতিদিন স্ত্রীকে কাজের ফাঁকে দু’মিনিট সময় বের করে কল দিন, তার খোঁজ খবর নিন। মাস শেষে ঘরে আনা আপনার পরিশ্রম অর্জিত রিযিক দিয়ে যে মানুষটা বাকি মাস জুড়ে সুন্দর ভাবে ম্যানেজ করে নিচ্ছে সে আপনার স্ত্রী। শ্রম দু’জায়গাতেই ইনভেস্ট করুন, ফলাফল নিজেই দেখতে পাবেন।

দোষ ত্রুটি গোপন করা –

কোন মানুষই দোষ ত্রুটির উর্ধ্বে নয়। স্বামী স্ত্রী প্রত্যেকেরই তাই কিছু না কিছু ক্রটি থাকতে পারে। কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা বলেছেন –

“ তারা (তোমার স্ত্রীগণ) তোমাদের জন্য পোষাক স্বরুপ এবং তোমরাও তাদের জন্য পোষাক স্বরুপ”
[সুরাহ আল-বাক্বারা, ১৮৭]

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা স্বামী-স্ত্রী কে একে অপরের পোষাক বলেছেন। আমরা পোষাকের মাধ্যমে যেমন শারীরিক দোষ ত্রুটি গোপন করি ঠিক তেমনই স্বামী স্ত্রীর একে অপরের সব ধরনের দোষ ত্রুটি কে বিচক্ষণতার সাথে গোপন রাখাটাই সুন্দর দাম্পত্য জীবনের লক্ষণ।

চোখের পর্দা –

পুরুষদের বেশিরভাগ ইমোশন শরীর কেন্দ্রিক এবং এটা তাদের ফিতরাত বা সহজাত স্বভাব। আর একারনেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা কুরআনে নারীর পর্দার পাশাপাশি পুরুষের চোখের পর্দা হিসেবে দৃষ্টির হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, একজন স্ত্রীর প্রতি স্বামীর গীরাহবোধ যতটাই জনপ্রিয় ঠিক ততটাই অজনপ্রিয় হলো স্বামীর প্রতি স্ত্রীর গীরাহবোধ।

কোন কোন স্বামী নিজ স্ত্রীর পর্দার প্রতি যতটাই সিরিয়াস ততটাই নিজ দৃষ্টির হেফাজতের বেলায় উদাসীন! আপনার স্ত্রী আপনার সন্তানের মা হতে গিয়ে নিজের শারীরিক সৌন্দর্য অনেকাংশে খুইয়ে ফেলে। সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়া আপনার স্ত্রীর জন্য যেন কখনও আফসোসের বিষয় না হয়ে যায়।

বন্ধু –

একজন স্ত্রী কে খুব প্রয়োজনীয় ভাবে তার স্বামীর বন্ধু হতে হয়না কিন্তু প্রত্যেকটি স্ত্রী একজন আদর্শ স্বামী তাকেই মনে করে, যে স্বামী তার ভালো বন্ধু হতে পারে। পুরুষ মাত্রই ইস্পাতসম এবং কম ইমোশনাল। তারা তাদের সমস্যা তাদের স্ত্রীর কাছে খুলে বলতে চায়না। অথচ স্ত্রী ক্ষেত্র বিশেষে কোন সমাধান দিতে পারবেনা জেনেও যদি স্বামী তার সমস্যার কথা স্ত্রীর সাথে শেয়ার করেন তবে স্ত্রী মানসিক ভাবে স্বামীর প্রতি খুব এটাচড ফিল করে।

স্বামীর সব ধরনের মানসিক লড়াইয়ে স্ত্রী পাহাড়সম অনুপ্রেরনা নিয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করে। একই ভাবে স্ত্রী যখন তার কোন দুঃখবোধ স্বামীর সাথে শেয়ার করে তখন কোন সমাধানের আশায় করেনা। স্ত্রী শুধু চায় তার স্বামী তার দুঃখটা একই ভাবে অনুভব করুক। প্রচন্ড মন খারাপের সময় হেলে যাওয়া মাথাটা রাখার জন্য একটা কাঁধ এগিয়ে আসুক।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে আম্মাজান ‘আইশা রাদিয়াল্লাহু আনহা একবার প্রশ্ন করেছিলেন “ ইয়া রাসুলাল্লাহ , আমার প্রতি আপনার ভালোবাসা কেমন ?”। জবাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন “দড়ির শক্ত বাঁধনের মতন”। মজবুত দড়ির দুপাশ ধরে আপনি যতই টান দিবেন দড়ির বাঁধন যেন ততই শক্ত হয় । স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে অন্যান্য সম্পর্কের মতই চড়াই উৎরাই আসে। এ চড়াই উৎরাই যেন সম্পর্ক ভাঙ্গনের নয় বরং সম্পর্কের ভিত মজবুত হবার কারন হয়ে যায় ইন শা আল্লাহ।

অনেক আগে পড়েছিলাম এ কথাটা –

“when a wife has a good husband, it is easily seen on her face …”

স্বামীগন,
আপনার স্ত্রীর দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন । নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করুন । জেনে রাখুন –

If you treat your woman as the queen of your heart then surely, your woman will treat you as the king of the whole world ….

প্রত্যাশা
– নুসরাত জাহান

(০৮/০৩/২০১৯)