সমবাহু ত্রিভুজ

বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আনিকা।

গ্রিলের ফাক দিয়ে দুরের মেঘগুলোর দিকে তাকিয়ে। মেঘ দেখতে দেখতে নয়বছর আগেরকার দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে খুউব। বিয়ের দু’দিন পর ঘুরতে গিয়ে ধ্রুব হুট করেই নিরবতা ভঙ্গ করে বিরাট প্রকৃতিপ্রেমীর মত জিজ্ঞেস করল:”আচ্ছা আনিকা, এই গাছটার নাম কী বলতো?

এইযে এই মেঘের মত পাতা।”

বৃক্ষবিষারদ হিসেবে খ্যাতি আছে বেশ আনিকার। বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রায় সব গাছের নামই তার জানা, আবিষ্কার করে ফেলল ধ্রুব।

তারপর থেকেই আনিকাকে “বৃক্ষবিষারদ ” নামেই ডাকে ধ্রুব। শুধু বৃক্ষবিষারদ না, “আমার বৃক্ষবিষারদ।”

টপটপ করে অশ্রুগুলো গাল বেয়ে নেমে যাচ্ছে আনিকার। কেমন জানি লাগছে বুকের ভেতরটায়।
বাতাসে কান পেতে তার এখনও শুনতে ইচ্ছে করে ধ্রুবর ভারী কন্ঠের ঐ ‘বৃক্ষবিষারদ ‘ ডাকটা। কত মায়া মেশানো ছিল ওতে।
.
লাইফটা আজকাল কেমন যেন যান্ত্রিক হয়ে গেছে। অফিস থেকে ফিরেই ধ্রুবর সেই গৎবাঁধা আদেশের ফিরিস্তি: “কী হল আনিকা, দাঁড়িয়ে আছো যে?
খাবারটা রেডি করগে, খিদে পেয়েছে।”
.
আজকাল ঝগড়াও বাঁধে দুজনের বেশ।
মেয়েটা না শুনুক এজন্যে দরজা আটকে ঝগড়া করে ওরা ।

তা কী আর হয়?
ছোট্ট মেয়েটারও তো বুদ্ধি হয়েছে। বাসায় মেহমান আসলে খুব কষ্ট নিয়ে বলে: “জানো, মামণি-বাবা দরজা আটকে ঝগড়া করে! “
তারা হয়তো কখনো চায়নি তাদের মেয়েটা প্রভাবিত হোক, তবুও….
.
আনিকা কি জানতো সম্পর্কের মাত্র এ কয় বছরে শব্দেরা এত দ্রুত “জান” থেকে “জানোয়ার” এ পরিণত হবে?
.
মুখ চেপে ধরে রাখে আনিকা। নিজেকে সামলাতে পারছিল না আর। দৌড় দিয়ে বাথরুমে চলে যায়। জোরে পানিরট্যাপ ছেড়ে দিয়ে গলা ছেড়ে কাঁদতে থাকে।

……………

-মামণি, তোমার চোখ একটু লাল কেন?
-কিছুনা মা, এলার্জির জন্য মনে হয়।
-কেন এলার্জি হয়েছে মা?
-ডাস্ট এলার্জি, মা। স্টোররুম থেকে মনে হয়ে একটু ধুলা গেছে চোখে।
-তুমি একটু ডাক্তার আন্টিকে ফোন করনা মা।
তাহলে সে তোমাকে ওষুধ দিয়ে ভালো করে দিবে।
-থাক সোনা। এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে একটুপরে।

কিছুক্ষন মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থেকে ড্রয়িংরুমের দিকে চলে গেল আদিবা।এত কৌতুহল মেয়েটার! প্রশ্ন বাণে সারাদিন জর্জরিত করতেই থাকে মেয়েটা। ওর নানু এসে অতিষ্ঠ হয়ে আনিকার সামনে গিয়ে বলে,

“মার মতোন হইছে আরকি। এটা এক্কেবারে আনিকার কপি। ছোটবেলায় তুইও আমারে জ্বালায়ে শেষ করতি:এটা কী, ওইটা কেন! বাপরে বাপ!”
.
ঘুরে এসে আদিবা একটা খেলনা কাছিম নিয়ে লাফাতে লাফাতে বলল,

-মা, সমবাহু ত্রিভুজ কী তুমি জানো?
-হুম।

আদিবা কিছুএকটা বলার আগেই আনিকা বলে উঠল,

-এটা তোমাকে পরে বলি মা?
-আচ্ছা।
আবার অদীবার প্রশ্ন,
– মা, কাছিমের ইংলিশ কী তুমি বলতো।

না না মা, তুমি বোলোনা- বলেই মায়ের মুখ চেপে ধরল আদিবা। এটার ইংরেজি হল: টরটয়েস।
এবার হাসো। হাসো মামণি।
না না, দাঁত বের করে হাসো।
………………….

এই মেয়েটার জন্যই আনিকার এখনো বাঁচতে ইচ্ছে করে। আরো কিছুদিন ওর সাথে খেলতে ইচ্ছে করে, বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে ইচ্ছে করে।

ক্রিং ক্রিং তীক্ষ্ণ ফোনের শব্দে বিরক্ত হয়ে গেল আনিকা। না, সে ফোন ধরবেনা এখন। মন তার ভালো নেই। পানসে হয়ে গেছে জীবনটা তার।

পরদিন দুপুরে রেণু ভাবীর সাথে দেখা আনিকার। পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে রেণুভাবী। আপাদমস্তক ঢেকে চলে, এধরণের মানুষ কে উপর দিয়ে বোকাসোকা দেখা গেলেও রেণুভাবী কিন্তু বেজায় মজার আর স্মার্ট একজন মানুষ!

কে দেখতে কেমন তাতে কীই বা আসে যায়?
মনে মনে ভাবে আনিকা। রেণুভাবী স্বল্পভাষী হলেও তার প্রতিটি শব্দের গাঁথুনি আর ঠিকরে পড়া প্রজ্ঞা মিলেমিশে খুব অল্প কথা-ই বিরাট অর্থপূর্ণ হয়ে যায়।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বল্ল আনিকা,

-ভাইয়া কেমন আছে? অফিসে আছে?

-নাহ, মসজিদে গেছে। আজকে একটু ছুটি নিয়েছে।

ঘরের মধ্যে তিন বাচ্চাকে সামলাতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে ভাবীকে। তিনটাই সমানে জ্বালাচ্ছে তাকে। ছোটটা রান্নাঘরে ঢুকেই দুইটা গ্লাস ভেঙে ফেলল। ওকে টেনে হিচড়ে ড্রইংরুমে আনল আপু। শব্দে ঘুম থেকে উঠেই এবার মেজোটার চিৎকার। মেজোটার স্বভাবই ঘুম থেকে উঠে কান্না জুড়ে দেয়া। তাকে থামানোর বৃথা চেষ্টা ছেড়ে তারস্বরে কান্না মেনে নিয়েছে ভাবী!

চিৎকার চেঁচামেচিতে কান জ্বালা করছে আনিকার।
ভাবী যে কীভাবে সামলায়!

বড়টা এবার শুরু করল, মা আমার কলম, মা সাদ আমার কলম নিয়ে গ্যাছে মা, ও মা….
.
কিছুক্ষণ চলার পর ভাইয়া এসে মেজোটা আর ছোটোটাকে নিয়ে একটু বাসার বাইরে নিয়ে গেলো। মেজোটা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করতে করতেই বাপের সাথে চলল!

হাহ! পরিবেশ এখন অনেকটাই শান্ত। ছোট দুইটা না থাকলে বড়টাও বেশী জ্বালাতন করেনা।

রেণুভাবী এবার একটা চেয়ার টেনে বসল।

সবকিছুর পরেও রেণুভাবীর ঠোঁটের কোণের একটু হাসিই যেন বলে দেয়, সে এক ছায়াঘেরা শীতল বটতলা! যার নিচে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে গা টা মেলে দেয়া যায়।
….

একথা ওকথা বলার পরে আনিকা জিজ্ঞেস করল,

-আচ্ছা ভাবী, ভাইয়া কি এত ব্যস্ততার মাঝে তোমাকে সময় দেয়?

-সময়তো আমিই তাকে বরং কম দেই। দেখলিনা, আমার বাহিনী! সারাদিন চলতেই থাকে ওদের সংগ্রাম। আর আমি হলাম ওদের কমান্ডার। কখনো ওদের মতোন করে চলতে হয়, কখনোবা একটু শাসন করা লাগে। এভাবেই চলছে…

-তাহলে তোমাদের নিজেদের পারসোনাল কোন টাইম নেই! একটা নিঃশ্বাস নিল আনিকা।

আমাদের তো একসাথে একটু গল্প করা কিংবা বসে একটু মুভি দেখাটা জীবন থেকে হারিয়েই গেছে।ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে গেছে দাম্পত্য জীবন, বুঝলে?
গলাটা ধরে আসলো আনিকার।

বর্ষার ভরা পুকুরের মত চোখ ভরে উঠেছে পানিতে, কখন জানি উপচে পড়ে!

একটু সময় নিল সে। ধরা পড়া আসামীর মত লজ্জিত হয়ে সারেন্ডার করল। ওড়নার আঁচল দিয়ে চোখটা মুছে নিল সে। মেকি একটা হাসি দিয়ে রেণুর দিকে তাকালো। কিন্তু সে হাসি তার বেদনাকে লুকোতে পারলনা বিন্দুমাত্রও। সত্যকে লুকোতে পারে এমন যোগ্যতা নেই সে হাসির।সেতো জাল, সে যে মিথ্যা, কপট!

-জানিসতো! একটা পলিব্যাগে একটা ছোট পারদের বোতল রেখে পলিব্যাগটা উঁচু করলেই সেটা ছিঁড়ে যাবে। কিন্তু ওই বোতলেই পানি রেখে এবার তুই পলিব্যাগটা উঁচু কর। দেখবি সেটা অক্ষত আছে। তাহলে কী হল?

কোথায় কোনটা রাখতে হবে, সেই উপযুক্ত স্থানটা আগে ঠিক করতে হবে।

বুকের বামদিকটায় হাত রেখে রেণু বলল, এখানে শুধুমাত্র আল্লাহকে রাখতে হবে। আর কাউকে রাখা যাবেনা। তাহলেই দুনিয়াতে কষ্ট কম হবে। ছোটখাটো কষ্টগুলোকে তুচ্ছ মনে হবে।
.
আর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা হল একটা সমবাহু ত্রিভুজের ন্যায়। উপরের কোণায় আল্লাহ।

নিচের দু’কোণায় স্বামী আর স্ত্রী।

তারা দুজন আল্লাহর যত নিকটবর্তী হয়, অর্থাৎ ত্রিভুজের যত উপরে উঠতে থাকে, তাদের নিজেদের মধ্যেকার দুরত্বও কমতে থাকে। তারা যত আল্লাহর নিকটবর্তী হয়, নিজেদেরও তত নিকটবর্তী হয়।

…….

আদিবাকে আনিকা একটা সমবাহু ত্রিভুজ এঁকে দিচ্ছে। চোখের মধ্যে তার ভাসছে, আল্লাহ উপরের কোণাটায়।

নিচের এক কোনায় সে, অপরকোণে ধ্রুব। তার ইচ্ছে করছে দ্রুত, খুব দ্রুত ত্রিভুজের বাহু বেয়ে উপরে উঠতে। না, একা নয়, ধ্রুবকে সাথে নিয়েই উপরে উঠতে, হাতে হাত রেখে, সহযাত্রী হয়ে…

সমবাহু ত্রিভুজ
-সুমাইয়া আলী
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮