চলো ইচ্ছা সাজাই

আমার আম্মু একবার নানীকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আম্মা, মানুষ দেখি কত সুন্দর হয়, আমি দেখতে এমন কেন?” উত্তরে নানী বলেছিল, “তোমার হাত পা চোখ নাক মুখ সব আছে। আল্লাহ্‌ তোমাকে জ্ঞান বুদ্ধি দিয়েছেন। কত মানুষের এসব নাই। তাহলে তোমার আফসোস কিসের?”

আমার নানীর একাডেমিক পড়াশোনা ছিল ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত। কিন্তু সরকারি চাকরিজীবী স্বামীর সংসারে নয় ছেলেমেয়ে সামলিয়েও উনার পড়ার ইচ্ছা মরে যায়নি। বইয়ের প্রতি উনার অদম্য আগ্রহ ছিল। যেখানে যা পেতেন তাই পড়ে দেখতেন।

এমনকি আমার মনে আছে, আমার বিয়ের আগে একবার আমাদের বাসায় বেড়াতে এসে আমার ইসলামিক অনলাইন ইউনিভার্সিটির বই নিয়েও নাড়াচাড়া করে দেখেছেন। বুড়ো বয়সেও বই-ই ছিল উনার সঙ্গী। এখন চোখে আগের মতো দেখতে পান না তাই পড়তে না পারায় একাকী বোধ করেন।

ঢাকার অদূরে নানাবাড়িতে যখন থাকতেন তখন সেখানে একটা দ্বীনী সার্কেল মেইনটেন করতেন। সমবয়সী কিছু মানুষের সাথে বসে দ্বীনের জ্ঞানের চর্চা করা, তাদের দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো, তাদের সাথে যোগাযোগ রাখা এবং ঢাকায় চলে আসার পরও সেই জায়গায় সাদাকা করা এসব করে গেছেন আমার নানা মারা যাওয়ার পরও।

আমার নানী একজন গৃহিণী কিন্তু নিজেকে ক্লাস ফাইভের পড়াশোনার মাঝেই আটকে রাখেননি বলেই আম্মুর ওই প্রশ্নের এত সুন্দর উত্তর দিতে পেরেছিলেন।

নানীর এই বই পড়ার স্বভাব আমার আম্মুর মাঝেও আছে। কিশোরী বয়সে বিয়ে হয়ে আব্বুর সাথে সিলেটের মফস্বল শহরে চলে যাওয়ার পর একাকী সময় পার করতো বই পড়ে। সেই যুগেই আম্মু শিশু প্রতিপালন, শিশুর মনস্তত্ব এসব নিয়ে পড়েছে।

এখন যখন সব ছেলেমেয়ে দূরে চলে গেছে তখনও আম্মুর প্রতিদিনের রুটিনের অনেকটা সময় কাটে বই পড়ে। আমার আম্মুর গুণের কথা লিখতে গেলে এই পোস্ট অনেক বড় হয়ে যাবে। শুধু একটা কথা বলি, আম্মুর মাঝে আমি সেলফ ডেভেলপমেন্টের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা দেখেছি। আমার আম্মু কিন্তু কখনো ইউনিভার্সিটি যায়নি। সমাজের চোখে আম্মু “জাস্ট অ্যা হাউজওয়াইফ”।

বিয়ের পর আমাকে যখন একজন বলেছিল “বাচ্চা-কাচ্চা হয়ে গেলে কিন্তু আর পড়তে পারবা না” তখন কথাটা ভালো লাগেনি, মানতেও পারিনি। মারইয়াম হওয়ার পরও IOUর দুই সেমিস্টার করেছিলাম। ইব্রাহীম হওয়ার আগ পর্যন্তও এখানে মসজিদের সানডে স্কুলে পড়াতে যেতাম।

এখন আরও কিছু জিনিসের সাথে সাথে এসবও বন্ধ আছে। সময়-সুযোগ হয়ে উঠলে IOU আবার শুরু করার ইচ্ছা আছে ইনশাল্লাহ। কিন্তু লেকচার শোনা, টুকটাক পড়াশোনা থামিয়ে দেইনি। স্ত্রী বা মা ছাড়াও আমার তো একটা স্বত্বা আছে!

কোন এক অদ্ভূত কারণে আমাদের সমাজের মানুষ মনে করে বিয়ে হয়ে গেছে, বাচ্চা-কাচ্চা হয়ে গেছে মানেই জীবন শেষ! এখন এই চক্রেই দিন পার হয়ে যাবে। এমনটা আমাদের সমাজের মানুষ ভাবে, পৃথিবীর সব সমাজের মানুষ কিন্তু এভাবে ভাবে না।

পশ্চিমা দেশের মানুষেরা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, সবসময় কিন্তু কোন না কোন গোল সেট করে এবং সেটা পূরণে ব্যস্ত থাকে। এই অভ্যাসটা কিন্তু মুসলিমদের মাঝেই সবচেয়ে বেশি থাকার কথা ছিল যেহেতু আমরা আখিরাত কেন্দ্রিক জাতি; আমরা জানি এই দুনিয়ার জীবনই শেষ না। কিন্তু আমরা পশ্চিমাদের থেকে ওদের খারাপ দিকগুলো যত সহজে শিখি ওদের ভালো জিনিসগুলো ততটাই এড়িয়ে চলি!

গোল সেট করা মানেই যে অনেক বড় কিছু হতে হবে এমন না। বারান্দায় ছোট একটা বাগান করা বা একটা নতুন সূরা মুখস্ত করা অথবা কোন বিশেষ টপিকের ওপর কোন লেকচার সিরিজ শুনে শেষ করা এটাও হতে পারে।

বাচ্চা যখন খুব বেশি ছোট থাকে তখন একরকম গোল হতে পারে আবার বাচ্চা কিছুটা বড় হলে আরেক রকম গোল হতে পারে। সময় সুযোগের ওপর নির্ভর করবে সবকিছু।

এক বোনের লেখায় পড়েছিলাম দুধের বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় কুরআনের কোন আয়াত মুখস্ত করা যেতে পারে। একদম ছোট বাচ্চা অনেক সময় নিয়ে দুধ খায়। এতে করে নিজের সময়টাও প্রোডাক্টিভ কাটবে আবার বাচ্চাও ছোট থেকে কুরআনের সাথে পরিচিত হতে থাকবে।

আমরা তো এখন জানি যে বাচ্চা পেটে থাকতেই শুনতে পায়! ফেসবুকে একটা ভিডিও দেখেছিলাম যে বাবা সুমধুর তিলাওয়াত করে বাচ্চাকে ঘুম পাড়াচ্ছে। মায়েদের জন্য এই কাজের সুযোগ তো আরও বেশি!

এক বোন সেদিন পোস্ট করেছিল যে প্রতি শুক্রবার আসলে ফেসবুকে সূরা কাহফ পড়ার ফজিলত নিয়ে পোস্ট দেখতে দেখতে তার খুব ইচ্ছা হতো এই আমলটা করার কিন্তু ছোট বাচ্চা তাকে সময় দিবে কিনা বুঝতে পারছিল না। কিন্তু যখন নিয়ত করে পড়তে শুরু করল দেখল যে ঠিকই পুরোটা পড়ে শেষ করতে পেরেছে ছোট বাচ্চা নিয়েও! এসব পোস্ট আমাকে অনেক ইন্সপায়ার করে!

প্রথম প্রেগন্যান্সী, প্রথম বাচ্চার সময় নতুন মা অনেক কিছুই বুঝতে পারে না। অনেক কিছুই বুঝতে বুঝতে সময় লেগে যায়। মারইয়াম হওয়ার সতের মাস পরে যখন ইব্রাহীম হোল, নার্স ওকে প্রথমবার ভিজিট করতে আসে যখন তখন আমি বলেছিলাম ইব্রাহীম মারইয়ামের চেয়ে তুলনামূলক সহজ মনে হচ্ছে।

শুনে নানী হয়ে যাওয়া কয়েক বাচ্চার মা নার্স বলেছিল এমনই হয় – প্রথমটার চেয়ে দ্বিতীয়টা সহজ এবং তারপরের গুলো আস্তে আস্তে আরও সহজ হয়ে আসে।

এটাই আসলে গোপন রহস্য! প্রথম বাচ্চার সময় অনেকদিনের অনেক অভ্যাসই এলোমেলো হয়ে যায়। কিন্তু সেই অভ্যাসকে আবারও শেপ দেয়া সম্ভব। “How to grow a reader” শিরোনামে একটা লেখায় পড়েছিলাম যে বাচ্চার সামনে বই পড়তে তাহলে সেও পড়তে আগ্রহী হবে। আমি যদি চাই আমার বাচ্চা কুরআন পড়ুক, ভালো বই পড়তে আগ্রহী হোক তাহলে আমাকেও তো সেটা তার সামনে করে দেখাতে হবে, তাই না? আর এভাবে আমিও পড়ার সুযোগ পেয়ে যাব!

যারা চাকরি করেন তাদের হয়ত নানা ট্রেনিং, কোর্স ইত্যাদি করতে হয়। কিন্তু সেটাও তো ক্যারিয়ারের খাতিরে। আল্লাহর বান্দা হিসাবে, রাসুলুল্লাহর(সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম) উম্মাহ হিসাবে আমাদের তো আরও অনেক কিছু জানার রয়ে যায়। ঘর-সংসারে ঢুকে যাওয়া বা গৃহিণী হয়ে ঘরে থাকা মানেই কী সেই জানায় সমাপ্তি টানতে হবে?

এখন অনলাইনে ফ্রী কত্ত কিছু জানা যায়, শেখা যায়। রান্না করতে করতেও তো একটা লেকচার শুনে ফেলা যায়। এমনকি স্ত্রী বা মা হওয়ার জন্যও অনেক কিছু জানা জরুরী।

সেক্যুলার পড়াশোনা করা নতুন বিয়ে হওয়া আমার এক ছোট বোন নতুন জীবনের নানা রকম ট্রায়ালের মাঝে পড়ে সেদিন বলছিল যে বিয়ে সম্পর্কে তার নিজের আরও ভালো ভাবে জানা দরকার। সে এখন বিয়ে নিয়ে আরও পড়তে চায়। অনলাইনে যে এই বিষয়ে কত কত চমৎকার বই আছে আমরা কী জানি? আমি এপ্রিশিয়েট করি ওকে ওর এই ইচ্ছার জন্য।

আরও একটা ব্যপার হচ্ছে, মায়েদের মন-মানসিকতা ভালো রাখা খুব জরুরী। প্রতিদিন ৫-১০ মিনিট ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ করে দেখুন কত্ত ভালো লাগছে!

নতুন জীবনের সাথে ধীরে ধীরে খাপ খাইয়ে নিয়ে ফেললে সময় ঠিকই বের হয়ে যায়। ভেবে দেখুন, কত সময় আমরা কাটিয়ে দেই ফেসবুকে, টিভি দেখে। সময়কে যদি একটা রুটিনে বেঁধে ফেলতে পারি তাহলে দুনিয়া এবং আখিরাত দুই দিকেই আমরা লাভবান হতে পারি, বাচ্চা-কাচ্চা সামলিয়েও! মেয়েদের নিয়ে আমাদের সমাজে কিছু কথা প্রচলিত আছে, যেমন মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু, মেয়েরা গীবত, নামীমাহ এসব বেশি করে। একটা রুটিনের মাঝে চললে, প্রোডাক্টিভ সময় কাটালে এসবের সময় কোথায়?

স্বপ্নগুলো, সুঅভ্যাসগুলো মরে যেতে দিবেন না। সেগুলোকে শেপ দিন। ভালো মা হওয়ার পথে আর এক ধাপ আগাই আসুন …

—————————
রাবেয়া রওশীন
চলো ইচ্ছা সাজাই