“বাচ্চা তো আমার কোন কথাই শোনেনা!”

★বাচ্চার ‘কথা শোনা’ বা ‘না শোনার’ পুরো ব্যাপারটা বেশ কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

১) বাচ্চার সাথে কথা বলার ক্ষেত্রে আমরা নিজেরা কতটা কৌশলী!

২) আমাদের নিজেদের রাগের বহিঃপ্রকাশ আমরা কতটুকু নিয়ন্ত্রন আনতে পারি এবং

৩) বাচ্চাকে ঠিক আচরণটা শেখানোর ব্যাপারে সত্যিই আমরা কতটুকু যত্নশীল।

★কথায় কৌশলী হওয়া বলতে বোঝাতে চাচ্ছি –

১) ওদের সাথে রেগে যেয়ে আমরা এমন ‘শব্দ’গুলো বলব না যা অপ্রয়োজনীয়। এমন ‘বাক্য’গুলো বলব না যেগুলো থেকে বাচ্চা আসলে তো কিছু শিখেইনা বরং সেই একই অগ্রহণযোগ্য কাজটাই সে বারে বারে করতে থাকে! আর আমরা রাগতেই থাকি।

এর পরিবর্তে,

২) শুধু সেটুকু কথাই বলব যেটা হবে ভীষণ ভীষণ স্পেসিফিক। মানে আমি বাচ্চার কাছে যা যা আশা করি সেটা যেন সে আমার কথা থেকেই সহজে ধরে ফেলতে পারে। কথায় কোন নাটক থাকবেনা বা ভনিতা থাকবেনা। ভুলটা সংশোধনের পুরো নির্দেশনাটা বাচ্চা পেয়ে যাবে।

বাচ্চাদের সাথে ভাব আদান প্রদানের ক্ষেত্রে এই সবগুলো উদ্দেশ্য যেই প্যারেন্টিং স্কিলটার মাধ্যমে পূরণ হওয়া সম্ভব সেটি হল I- Message।

★এই Message তৈরি করার ও কিন্তু একটা নির্দিষ্ট ফরম্যাট বা ছক আছে! চলুন প্রথমেই দেখে নেই একটা Message এ কি কি অংশ থাকে।

১) বাক্যটা শুরু হবে ‘আমি’ বা ‘আমার’ শব্দটি দিয়ে।

২) এরপর আসবে আপনার অনুভূতি (বাচ্চাকে জানাতে হবে রাগ হওয়া ছাড়াও মা/ বাবার আরও অনেক অনেক অনুভুতি আছে।)

২) এরপরে আসবে ঠিক যে অগ্রহণযোগ্য কাজটা বাচ্চাটা করছিল সেটা

৩) তারপরে আমরা জানাব, ওর সেই আচরণ টার জন্যে অন্যদের কি কি ভোগান্তি হচ্ছে

৪) সবশেষে বাচ্চাকে নির্দেশনা দেবো৷ কিভাবে সে সমস্যাটির সমাধান করবে।

★আমরা কিছু পরিস্থিতিতে চলুন এবার I- Message এর ব্যবহার দেখি।

## দৃশ্য -১ :

৬ বছরের বাচ্চাকে খেলনা গুছাতে বলছেন মা। কিন্তু সে গোছাচ্ছেই না।

যা বলে ফেলার সম্ভাবনা আছে-

“তোমাকে আর কতবার বলব আমি খেলনা গোছানোর কথা? কথা কানে যায়না তাই না? তুমি খেলবা আর আমি গুছাব তাই ভাবছ? আমাকে কি ভাব? তোমার চাকর? সব খেলনা ডাস্টবিনে ফালায় দিব। তখন বুঝবা। হতচ্ছাড়া একটা!”

এখানে সমস্যা টি কোথায় হল –

১) ‘তুমি এই’! ‘তুমি সেই’! – এই ‘তুমি বাক্য’ গুলো শুনলেই বাচ্চার রাগ উঠে যায়, জিদ বেড়ে যায়!

২) অভিযোগ আর অপমান – বাচ্চার কিন্তু ভাল লাগে না! সে বিদ্রোহ করে।

৩) আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগের অভাব- বাচ্চা হতাশ বোধ করে।

৪) বাচ্চা ঠিক কি করবে সেই ব্যাপারে দিক নির্দেশনার অভাব। – একই কাজ সে আবার করবে!

৫) বাচ্চা দেখছে – আপনার রাগ এবং রাগ – আপনার প্রতি শ্রদ্ধা দিন দিন কমতে থাকবে কারন ও বিশ্বাস করে আপনি ওকে ‘শুধু শুধু’ দোষারোপ করেন!

চলুন তো দেখি, অন্যভাবে কিভাবে বলা যায়। ‘তুমি বাক্য’ থেকে ‘আমি বাক্য’ দিয়ে!

“আমার (খুব খারাপ লাগে)…

(যখন) আমি দেখি তুমি সারা ঘরে খেলনা ছড়িয়ে রেখেছ!….

(কারন) এগুলো আমাকে একা গোছাতে হয়…

(আমার খুব ভাল লাগত) যদি তুমি আমাকে খেলনা গোছাতে একটু সাহায্য কর..”

ব্যস! এভাবেই তৈরি হয়ে যায় I-Message!

★আধিপত্য পুরোটাই আপনার! তফাৎ হল এক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্মানবোধটা বজায় আছে! খেয়াল করেছেন, আপনাকে অনেক কথা কিন্তু বলা লাগল না! কিন্তু আপনি ‘নির্দিষ্ট ‘ ভাবে ওকে –

১) ওর অগ্রহণযোগ্য আচরণটা কি ছিল সেটা শিখিয়ে ফেলেছেন,

২) ওর আচরণের ফলে যে কাউকে না কাউকে ভুগতে হয় সেই সমীকরণটা ও ওকে শিখিয়ে ফেলেছেন।

৩) আপনার অনুভূতির কথা ও জানল। ও আজ বুঝল ‘মা/বাবার শুধু রাগই হয় সেটা না। আমাদের আচরণে ওদের ‘কষ্ট হয়’ ‘খারাপ লাগে’! ‘

আবেগ কিন্তু ছোঁয়াচে। সে কারনেই কাউকে রাগতে দেখলে আমাদের ও ভেতরে রাগ রাগ লাগে। কাউকে কাঁদতে দেখলে আমাদের কষ্ট লাগে।

যদি তাই হয় তবে রাগ দিয়ে কেন বাচ্চার সাথে নেভিগেট করব আমরা?! অন্য অনুভূতিগুলো দিয়েই করি যেটা ওর সহানুভূতি বাড়াবে, আমাদের কথা শোনার একটা যুক্তিসংগত কারণ/প্রেরণা ওদেরকে দেবে।

৪) সবশেষে বাচ্চা এর মাধ্যমে এটাও শিখেছে যে, কিভাবে এই ঝামেলাটা সে সুরাহা করবে। অর্থাৎ ওকে কি করতে হবে! ওর কাছে ঠিক কি চাওয়া হচ্ছে।

★আসুন, আরো কিছু উদাহরণ দেখে নেই-

## দৃশ্য – ২

১৩ বছরের ছেলেকে খাবার টেবিলে খেতে আসতে বলা হচ্ছে কিন্তু সে আসছে না।

এভাবে বলে ফেলছি হয়তো-

” এই বেয়াদব! কয়বার ডাকছি তোরে খাইতে আসতে? কানে যায় কথা? দিন দিন ভাইয়ের মত ফাজিল হইতেছস না? নিজেকে কি ভাবেন আপনি হ্যাঁ? নবাব সিরাজউদ্দৌলা? খাটের উপর বসে থাকবেন আর এমনি এমনি খাবার চলে আসবে তাইনা?”

যা বলা যেতে পারে –

” আমি (খুব কষ্ট পেয়েছি)

( যখন) আমি দেখলাম বার বার ডাকার পড়েও তুমি খেতে আসছ না।

(কারন) সবাই তোমার জন্যে না খেয়ে অপেক্ষা করছিল

(আমার খুব ভাল লাগবে) যদি তুমি ডাক দেয়ার সময়টাতেই সবার সাথে খেতে আস।

### দুই ভাইবোনের খেলনা নিয়ে মারামারি।

যেভাবে বলি –

“তুমি কথায় কথায় মার কেন রিদাকে? ও ছোট না তোমার? সব সময় দেখি খালি মারামারি, খালি মারামারি! কে খেলবে তোমার সাথে এরকম করলে? কেউ খেলবে না? আরেকবার মারলে কিন্তু থাপড়ায় সব ক’টা দাঁত ফালায় দেব !”

যা বলতে পারি –

আমি (খুব কষ্ট পেয়েছি)

(যখন) আমি দেখলাম তুমি রিদাকে মেরেছ আর ওর খেলনাটা কেড়ে নিয়েছ।

(কারন) রিদা ব্যথা পেয়ে অনেক কেঁদেছে।

(আমি খুব খুশি হব) যদি ও তোমার খেলনা ধরলে তুমি সেটা শেয়ার কর/ও তোমাকে আগে মারলে তুমি আমার কাছে হেল্প চাও।

বাচ্চা কথা শুনতে শুরু করলে সাথে সাথে প্রশংসা করুন। ওকে উৎসাহ দিন। ও কবে কবে কথা শোনেনি সে জিনিস আর মনে করিয়ে দেবেন না!

★ভাবুন একবার, সারাদিনে বাচ্চারা কত ধরনের অগ্রহণযোগ্য কাজ করতে থাকে!! যদি আমরা ধৈর্য্য ধরে ওদের সাথে প্রত্যেক ক্ষেত্রে এভাবে কথা বলতে পারি তাহলে এই একটা স্কিল এর মাধ্যমেই একটা বাচ্চাকে কত কিছু শেখানো সম্ভব!

স্কিল টা পছন্দ হলে প্র‍্যাক্টিস শুরু করতে পারেন। প্রথমে বিভিন্ন সিচুয়েশন কল্পনা করুন যে সময়গুলোতে বাচ্চার সাথে আপনার Power Struggle বেড়ে যায়। প্রতি ক্ষেত্রে কি বলবেন সেই ক্ষেত্রে, তা না একটি Message এ দাঁড় করাতে চেষ্টা করুন।

বাচ্চাকে কিছুদিন সময় দিন আপনার এই নতুন এপ্রোচটার সাথে অভ্যস্ত হতে। আস্তে আস্তে দেখবেন আপনার প্যারেন্টিংও একটু একটু করে সহজ হচ্ছে।

বি.দ্র :

১. I – Message ‘একটা’ স্কিল, ‘একমাত্র’ স্কিল না। তাই বলছি না সব সমস্যার সমাধান এটা দিয়েই হবে।

২. যে উদাহরণগুলো দিয়েছি সেগুলো বেশ কিছু কেইস এনালাইসিস করে দেয়া। Over Generalized মনে হতে পারে। যদিও সেটা একদমই আমার উদ্দেশ্য না।)

“Don’t worry that children never listen to you; worry that they are always watching you” (Robert Fulghum)

———————————–
“বাচ্চা তো আমার কোন কথাই শোনেনা!”
ডাঃ সুষমা রেজা রাখী