মাতৃত্ব – এক মহান দায়িত্ব

সন্তান প্রতিপালন সম্ভবত পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন কাজ। অনেকেই মনে করেন বাচ্চাকে দিন-রাত খাওয়ানো, সময় মতো ঘুম পাড়ানো আর নাদুসনুদুস স্বাস্থ্য বানানোই বাবা মায়ের – বিশেষ করে মায়ের প্রধান কাজ। কিন্তু সন্তান পালনের ব্যাপারটা যে কত গভীর তা নিজের সন্তান না থাকলে কখনোই বুঝতাম না।

আমি আমার সন্তানকে প্রতিপালনের ক্ষেত্রে নিজের ছোটবেলার কথা মনে করার চেষ্টা করি। যেমন, আমাকে এটা করতে না দিলে অথবা এই কথা বলা হলে এই বয়সে আমার কেমন লাগতো? যেমন, দুই বছরের একটা বাচ্চার কাজ কী সারাদিন? শুধু খেলা। ঘর গোছানো রাখতে এখন যদি বাচ্চার এই খেলাটাও লিমিটেড করে দেই বাচ্চা সারাদিন করবে কী?

তাই অনেক ভেবে বাচ্চার খেলার জিনিস আমি দুই ভাগ করে দুইটা ঘরে আলাদা করে রেখেছি। সে যখন এক ঘরের খেলনা দিয়ে সেই ঘরে খেলবে, আমি তখন অন্য ঘরগুলো গুছিয়ে রাখি। আবার যখন আরেকদিন ঐ রুমে খেলবে এপাশের রুম গুছিয়ে রাখি। ফলে সম্পূর্ণ বাসা অগোছালো থাকেনা। কিন্তু বাচ্চাটাকে খেলতে না দিলে সে মোবাইল, ল্যাপটপ অথবা অন্য কোন স্ক্রিনের দিকে ঝুঁকে যা এই বয়সী শিশুদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। অথচ কিছু একটা তো তাকে করতেই হবে।

বাচ্চারা বাবা-মায়ের এত অনুকরণ করে যে বলার মতো না। আপনি কিভাবে কথা বলেন,কিভাবে রাগ দেখান, কিভাবে খান, ঘুমান সব বাচ্চারা খেয়াল করে। সবচেয়ে বেশি যেটা বাচ্চারা মনে রাখে তা হলো তার প্রয়োজনে আপনি তার সাথে কেমন আচরণ করেন। যেমন, আমি রান্নাঘরে কাজ করতে থাকলে আমার ছেলে সা’দ এসে ডাকলে আমি ওর দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিতাম। কখনো একবার তাকিয়েই আবার হাতের কাজে ফিরে যেতাম। আমি বুঝতে পারিনি যে ছেলে এই জিনিসটা শিখে ফেলবে। এরপর আমি ওকে ডাকলে ও তাকায় না। কিন্তু আমার কথা যে ও শুনছে তা আমি ঠিকই বুঝতে পারছি। অথবা আমি তাকে ডাকলে সে খেলা করতেই থাকে, শেষ না হলে আসে না।

যখন আমি চিন্তিত ছেলে কানে শুনে নাকি ঠিকমত তা নিয়ে – তখন একদিন খেয়াল করলাম সে ঠিক আমার অনুকরণ করছে। আমি হাতের জরুরী কাজ শেষ না করে আসতে পারি না। তাই সে-ও তার খেলা শেষ না হলে আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না!

আমরা অনেকসময় বাচ্চার মনের অবস্থা না বুঝেই বাচ্চাকে বকা দেই, রেগে যাই। দুই/তিন বছরের একটা বাচ্চা জানে না রাতে পানি দিয়ে খেললে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। পানি ধরলে আমরা বাচ্চাটাকে বকা দেই, কিন্তু দোষ তো আমাদের। আমরা বাথরুমের দরজা আটকে রাখিনা বা পানির পাত্র ওদের হাতের নাগাল থেকে সরিয়ে রাখিনা, ফলে বাচ্চা তো পানি সামনে পেলে ধরবেই। কিন্তু বকাও খায় সে কিছু না বুঝেই।

আপনি আপনার বাচ্চাকে বোঝালেন যে বেশি চকলেট খেলে দাঁত নষ্ট হবে। কিন্তু আপনি ফ্রিজে ওর সামনেই চকলেট এনে রাখলেন। ছোট বাচ্চার লোভ হবেই, সে হয়তো লুকিয়ে খেয়ে ফেলবে। আপনি তাকে বকবেন কথা শুনেনি বলে বা লুকিয়ে খেয়েছে বলে। কিন্তু বুঝতে হবে ও একটা অবুঝ বাচ্চা। ও কথা কেন শুনতে হবে না, তা না বুঝেই খেয়ে ফেলেছে। ওকে বকা দেয়ার আগে নিজে ভাবুন আপনি তো জানতেন বাচ্চারা চকলেট কত পছন্দ করে, আপন কেন লুকিয়ে রাখলেন না? তাকে বোঝান বড়দের কথা কেন শুনতে হবে, কেন লুকিয়ে না বলে খাওয়া ঠিক না। চকলেট এনে রাখাটা আপনার ভুল হয়েছে তা স্বীকার করুন। এতে সে নিজে ভুল স্বীকার করতে শিখবে।

বাচ্চাদের মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা না করা, তাদের অবহেলা করা, অযথা বকাঝকা দেওয়া, অন্যের সাথে তুলনা করা, একই বাড়ির দুই বাচ্চার মধ্যে পার্থক্য করা — এ সব যে বাচ্চাদের মনে কত প্রভাব ফেলে তা চিন্তার বাইরে। আপনি নিজেই ভেবে দেখুন তো ছোটবেলায় আপনার বাবা মা যখন কারণে-অকারণে আপনাকে বকতেন, আপনার সামনে অন্য ভাই বোনের প্রশংসা করতেন, আপনাকে অন্যদের মত হতে বলতেন — তখন আপনার কেমন লাগতো? আপনি হয়তো ভাবছেন আজ বকলাম, কাল আদর করে দিলেই সব শেষ। কিন্তু কিছু ঘটনায় বাচ্চাদের মনে গভীর দাগ কেটে যায়, কিছু ঘটনা বা কথা একটা মানুষের প্রতি বিরূপ ধারনা তৈরি করে দেয় মনে যা বড় হয়েও বাচ্চারা ভুলতে পারে না।

আমাদের সন্তান আল্লাহর পক্ষ থেকে আমানত, ওরা অবুঝ। ওদের বুঝদার বানানো, ওদের মধ্যে নৈতিকতা তৈরি করা, ওদের অন্তরে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও ভয় তৈরি করা বাবা মায়ের দায়িত্ব। এবং এটা কত যে কঠিন কাজ তা আল্লাহ ভালো জানেন। আমাদের একটা ভুল আচরণ, ভুল শিক্ষা, ভুল কথার ভার একটা বাচ্চাকে সারাজীবন বয়ে চলতে হতে পারে।

আমরা মানুষ, তবুও আমরা ভুল করি। হয়তো অন্যের রাগ বাচ্চাদের উপর ঝেড়ে ফেলি। নিজের সংসারের অশান্তি বাচ্চাদের উপর চাপিয়ে দেই। নিজের জন্য সময় পেতে বা নিজের কাজ করার জন্য বাচ্চাদের অবহেলা করে ফেলি। কিন্তু একজন মা’কে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। ভুল হতেই পারে কিন্তু সে ভুল কন্টিনিউ না করে ভুল শুধরে নেওয়াই কি উচিৎ নয়?

একজন ১০০% উত্তম মা হতে না পারি, চেষ্টা তো করতে পারি। চেষ্টা ও নিয়াত ঠিক থাকলে ইন শা আল্লাহ আল্লাহই সাহায্য করবেন এগিয়ে যেতে।

…………..

মাতৃত্ব – এক মহান দায়িত্ব

নাইলাহ আমাতুল্লাহ
৩০ অক্টোবর ২০১৮