মা হওয়াঃ কান্না রহস্য

আগের পোস্টের পদ্ধতিগুলো করে নায়ীমার নিয়মিত কান্নাগুলো থামানো যেত, কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ কি হতো, ও আবারও কান্না কাটি শুরু করতো। তখন পড়াশোনা করে বাচ্চাদের কান্নার দুইটা কারণ আবিষ্কার করলাম, ’গ্রোথ স্পার্ট’ আর ’ওয়ান্ডার উইক’।

প্রথমে ব্যাপারটা খেয়াল করলাম ওর তিন সপ্তাহ বয়সে। হঠাৎ কি হলো সারাক্ষন খেতে চাচ্ছে। মোটামোটি প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় তাকে খাওয়ালে একটু চুপ থাকতো। মুরুব্বীরা মোটামোটি সব সমস্যাকেই তখন ক্ষুধায় নিয়ে যেত.. মনে হচ্ছে দুধ পাচ্ছে না! বুকের দুধের সাথে ফর্মূলা বানিয়ে দাও!

আমি কিছুতেই ফর্মূলা দিতে চাচ্ছিলাম না। শুধু মনে হতো, আগের দিনে, যখন ফর্মূলা ছিল না, তখন মায়েরা কি করতো?

কি হচ্ছে কি হচ্ছে এই নিয়ে নেটে ঘাটাঘাটি করে দেখলাম যে বাচ্চারা জন্মের পরে প্রথম ৬ মাস নির্দিষ্ট কিছু সময়ে হঠাৎ হঠাৎ কান্নাকাটি বাড়িয়ে দেয়। সময়গুলো হচ্ছে—২ থেকে ৩ সপ্তাহ, ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ, ৩ মাস, ৪ মাস, ৬ মাস।

এই সময়গুলোর আগে পরে বাচ্চাদের ওজন করে দেখা গিয়েছে এই সময়ে ওজন হঠাৎ করে বেড়ে যায়, রাতারাতিই। একে বলে ’গ্রোথ স্পার্ট’। এরপরে আবার ধীরে ওজন বাড়ে। মনে আছে, প্রথম ছয় মাসে মেয়েটার ওজন প্রায় আড়াই গুণ বেড়েছিল।

’গ্রোথ স্পার্টের’ সময় আসলেই খাওয়ার চাহিদা বেড়ে যায়। তারপরে আবার কমে যায়। যারা বোতলের দুধ খাওয়ান বাচ্চাদের, তাদের কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু যেই হতভাগী (এবং অবশ্যই ভাগ্যবতী!) মায়েরা বুকের দুধ খাওয়ান, তাদের জন্য এই সার্বক্ষনিক খাই-খাই মেটানো খু্বই কষ্টকর এবং অপ্রীতিকর।

এই সময়েই অনেক মায়েরা হঠাৎ ভাবা শুরু করেন, বোধ হয় বুকের দুধ যথেষ্ট পাচ্ছে না, এবং অত:পর ফর্মূলা দিয়ে দেন। এখান থেকেই ভুলের শুরু হয়! বুকের দুধের ঘটনা হচ্ছে, যত বেশি দুধ খাওয়ানো হবে, দুধ তত বাড়বে, শেষ হবেনা। এখানে গ্ল্যান্ড আর হরমোনের কারসাজি তো, বাচ্চা যতক্ষন খেতে চায়, শরীর ততক্ষন বানিয়ে যেতে পারে।

এজন্যই একই মায়ের জমজ বাচ্চা হলেও মা দুই জনকেই দুধ খাওয়াতে পারে, একটা বাচ্চা হলেও একই মা দুধ খাওয়ায়, দুধ বেশি হয়ে যায় না। ডিমান্ড-সাপ্লাইয়ের এই চমৎকার ডিজাইনটা আল্লাহ করে দিয়েছেন যেন যতগুলা বাচ্চা হোক, যেই সাইজ বা চাহিদার বাচ্চা হোক, একজন মা-ই দুধ খাওয়াতে পারেন।

এই সময়ে যারা ফর্মূলা দেন, তাদের বুকের দুধ আর বাড়ার সুযোগ পায় না, এবং অত:পর এক সময় বুকের দুধ খাওয়ানোটাই কষ্টকর হয়ে যায়। সুতরাং মায়েরা যদি এই গ্রোথ স্পার্টের সময়টা একটু কষ্ট করে পার করে দিতে পারেন, ফর্মূলা না দিয়ে, তাহলে দুধের পরিমান বেড়ে যাবে, বাচ্চা আবার রাতে ঘুমানো শুরু করবে এবং দুধ-ফর্মূলায় প্যাঁচ খাবে না।

এ তো গেল মেয়ের খাওয়ার চাহিদার গল্প। এছাড়াও আরেকটা জিনিস খেয়াল করলাম। মেয়েটা কয়েক সপ্তাহ খুব হাসিখুশি থাকে, যেখানে রাখি সেখানেই থাকে, একা একা খেলে, ঘুরে ঘুরে দেখে। তিন মাস বয়সে আধা ঘন্টার মত শুধু একটা খেলনার দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিতে পারতো। বসতে শিখার পরে এটা সেটা টানে। হামাগুড়ি দিতে শিখার পর শুধু নতুন জায়গা এক্সপ্লোর করতে চায়, আমাকে এক ঘরে রেখে সে বাসার অন্য কোণায় চলে যায়। আমারই কিছুক্ষন পর পর গিয়ে ওকে উদ্ধার করে আনতে হয়। আর সে কি কথা! নিজের ভাষায় সারাক্ষন পটর পটর করছে। যে দেখে সেই বলে, ’ইশ কি মিশুক বাচ্চা! এত্ত হাসি খুশী!’

তারপরে হঠাৎই কি হয়, কয়েক সপ্তাহ সে পুরাপুরি উল্টে যায়। কোন কথা নাই, মুখ গোমড়া করে রাখে। শুধু মা মা আর মা। মা ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না। শুধু কোলে থাকতে চাইতো। কোথাও রাখা যাবে না। হামাগুড়ি শেখার পরে সারাক্ষন মাকে চোখে চোখে রাখে। মুহূর্তের জন্য ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না। অন্য মানুষের সাথে খেলবে, কিন্তু আমি চোখের সামনে না থাকলে। সহজেই ঘ্যানু ঘ্যানু করতো। হাসতো কম। কেমন উদাস উদাস! বাথরুমে যাওয়া আর নামাজ পড়া রীতিমত দু:সপ্নের মত ছিল।

এই সময়টায় কেউ দেখলে বলতো, ’প্রথম বাচ্চা বেশি আদর পায় তো, নষ্ট হয়ে গ্যাছে!’ কিংবা, ’খুব কোল চিনেছে! মেয়েকে তো পুরা কোলের অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছো!’

এমনি আমার মেয়ে সলিড শুরু করার পরে মা শা আল্লাহ সব কিছু খেতে চাইতো। আমি কখনও জোর করি না, যতক্ষন খেতে চায়। কিন্তু এই কয়েক সপ্তাহের জন্য দেখা যেত, সে কিছুই খেতে চাচ্ছে না। এক চামচ মুখে দিয়েই খাওয়ার চাহিদা শেষ। কি যে খারাপ লাগতো! মা হয়ে বাচ্চা না খেলে কেমন যে লাগে! অনেক শুভাকাংখী বলেছেন ওই সময়টায়, ’জোর করবা না বলো? বাচ্চারা না খেলে মায়েরা জোর না করলে তো বাচ্চারই ক্ষতি!’

এই সময়ের আরেকটা খুব খারাপ ব্যাপার ছিল যে রাতে ঘন ঘন উঠতো। আমাকে শুভাকাংখীরা শুধু বলতো, বুকের দুধ রাতে খাওয়াও বলে দুধের নেশায় উঠে। বোতলে করে পানি খাওয়ায় দিও আর উঠবে না।

যখন মন টন বেশ ভালোই খারাপ হয়ে যেত, মনে হতো, এরকম ঘ্যানু ঘ্যানু বাচ্চা কেন হবে আমার? আসলেই কি কোলের পঁচা অভ্যাস হয়ে গিয়েছে? আসলেই কি খাওয়ার সময় জোর না করে ভুল করি? আসলেই কি রাতে বুকের দুধ দিয়ে পঁচা অভ্যাস করে ফেলেছি? আমি এসব কি করলাম? আমি কি একটা পঁচা মা? রীতিমত হতাশ টতাশ হয়ে ফেইসবুকের শিশু লালন পালন গ্রুপে নানা রকম প্রশ্ন করতাম।

তারপরে কি হতো, হঠাৎই মেয়ে আবার পুরা ঠিক! সেই আগের মত হাসি খুশি, চিৎকার, সারা বাসা ঘুরে বেড়াচ্ছে, নতুন মানুষ দেখে খুশিতে চিৎকার করছে, অন্য কারো কোলে গেলে আমার কোলে আর আসতে চাচ্ছে না, ঘন্টার পর ঘন্টা একা একা বাসা এক্সপ্লোর করে যাচ্ছে, কোনো বিরক্তি নেই, মন খারাপ নেই! মনে হতো কেউ একজন যাদুর লাঠি দিয়ে মেয়েকে বদলে দিয়েছে!

কি হলো এসব??

সেই সময়টায় একটা চমৎকার কনসেপ্টের সাথে পরিচিত হলাম। ওয়ান্ডার উইক।

নবজাতক শিশুরা তাদের চারপাশের পৃথিবীর খুবই সীমিত জ্ঞান নিয়ে জন্ম নেয়, কারণ তাদের মাথার সাইজ তখন খুব ছোট থাকে। মাথার সাইজ ধীরে ধীরে বাড়ে না, হঠাৎ হঠাৎ বাড়ে। হঠাৎই মনে হয় রাতা রাতি এক সে:মি: বেড়ে গিয়েছে মাথার সাইজ। এবং ফলে তারা তাদের চারপাশের পৃথিবীকে নতুন করে দেখতে শিখে।

আপনি একটা দুই মাসের বাচ্চাকে হাজার চেষ্টা করেও টুকি-ওয়া খেলে হাসাতে পারবেন না। আপনি যে লুকাচ্ছেন, আবার আসছেন, এগুলোই সে বুঝতে পারবে না। তিন মাসে আপনি হাজার চেষ্টা করেও বাই-বাই দেয়া শিখাতে পারবেন না। এত কঠিন জিনিস শিখার জন্য তার মাথাই তৈরি হয় নি!

জন্মের পর থেকে দেড় বছর পর্যন্ত, কয়েক সপ্তাহ পর পর মাথার সাইজ হঠাৎ বেড়ে যায় এবং রাতারাতি শিশুরা নতুন ভাবে চারপাশের পৃথিবী দেখা শুরু করে। যেমন সাত মাসের দিকে প্রথমবারের মত একটা বাচ্চা বুঝতে পারে যে মায়ের শরীর থেকে সে পুরাপুরি আলাদা নিজের মত করে একজন আস্ত মানুষ, মা ইচ্ছা করলেই তাকে রেখে যেখানে খুশি চলে যেতে পারবে, সে কিছুতেই কিছু করতে পারবে না।

এই বোধটা আসার পর থেকেই ’সেপারেশন এংজাইটি’ শুরু হয়, মাকে পাগলের মত আকড়ে ধরে থাকতে চায়, রাতে ঘুমাতে পারে না মা নাই এই ভয়ে।

শিশু লালন পালন সংক্রান্ত একটি চারট এ দেখলাম, এই সপ্তাহগুলোতে বাচ্চারা এক একটা নতুন পদ্ধতিতে পৃথিবীকে দেখা শুরু করে। যেহেতু তাদের চেনা জানা পৃথিবীটা রাতারাতি বদলে যায়, সে জন্য ওরা কয়েক সপ্তাহ খুব ভয়ে থাকে। মন খারাপ করে থাকে। মায়ের কোল চায়। খাওয়া নিয়ে ঝামেলা করে। ঘুমাতে গেলেও দুশ্চিন্তায় থাকে!

আমি আমার মেয়ের বেলায় চার্টটা ফলো করেছি, একেবারে সত্যি সত্যি মিলে গিয়েছে ওর ক্ষেত্রে! আশার কথা হচ্ছে, বিশেষ সময়/সপ্তাহটুকু শেষ হওয়ার পরেই দেখা যেত মেয়ে আমার এত হাসিখুশি! হাসছে, খেলছে! নতুন জিনিস করতে চাচ্ছে!

মনে আছে, নয় মাসের দিকে এক সপ্তাহের মধ্যে সে বাই-বাই দেয়া শিখলো, সবাইকে চুমু দেয়া শিখলো, গানের সুর শুনেই সামনে পিছে দোলা শিখলো। মনে হতো প্রতিদিনই সে নতুন কিছু করছে! ওই সময়ে ওকে দেখে এত আনন্দ হতো!

এটা জানার পর থেকে আমার মেয়ের ’পরিবর্তনের’ সময়গুলোতে আমি চেষ্টা করি ওর যা দরকার তা দেয়ার। কোলে থাকবি? থাক। রাতে বার বার উঠবি? ঠিক আছে মা আছি। খেতে ইচ্ছা করছে না? আচ্ছা, সলিড না খেলে মরে যাবি না, বুকের দুধটা ঠিক মত খাইস।

কারণ, জানতাম, মেয়েটার আমার এখন একটা কঠিন সময় যাচ্ছে, ইনশাআল্লাহ সময়টা পার হলে ঠিক হয়ে যাবে। আমরা যদিও ভাবি শিশুরা খুবই নিশ্চিন্তে দিন কাটায়, কিন্তু আসলেই ওদের এত নতুন কিছু শিখতে হয়, শরীরের এত পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়, যে এটা আল্লাহর রহমত, এই সময়গুলো, এই সময়ের কষ্ট, ভয়গুলো আমাদের মনে থাকে না!

সব মানুষেরা যেমন এক রকম না, সব বাচ্চারা এক রকম না। অনেক মানুষের আবেগ বেশি থাকে, যা অনুভব করার তা বেশি করে করে। আমি দেখেছি, যাদের আবেগ টাবেগ কম, প্র্যাকটিকেল আর যুক্তিবাদী মানুষ, তারা ছোটবেলা খুবই ’লক্ষী বাচ্চা’ থাকে, পরিবর্তনের সময়ও তেমন একটা বিচলিত থাকে না, মায়েরা খুশি থাকে। কিন্তু দুনিয়ার সবাই যুক্তিবাদী হলে তো ব্যালেন্স থাকবে না! যেসব বাচ্চাদের পরিবর্তনের সময়গুলোতে বেশি মন খারাপ করে, মায়েরা যদি ভাবে যে জোর করে কাঁদিয়ে রেখে কোলের অভ্যাস ছুটাবো, তাহলে অনেক সময়ই উল্টা এফেক্ট হয়।

এইতো, মাত্রই একটা পরিবর্তনের সময় পার করলো মেয়ে আমার। দুই সপ্তাহ আগেই দুই চামচের বেশি খাওয়ানো যাচ্ছিলো না, এখন বাটি ভরে খাচ্ছে। তখন আমার পিছনে পিছনে ঘুরতো, বাথরুমও করতাম ওকে নিয়ে, নামাজ পড়ার সময় কোলে রাখতাম। এখন ওর পিছন পিছন আমি দৌঁড়াই! শপিং সেন্টারে গিয়েও দেখা যায় সে সুযোগ পেলেই তাড়াহুড়া করে হামাগুড়ি দিয়ে কোন অজানা অ্যাডভেঞ্চারের দিকে রওনা দেয়!

———————————-

মা হওয়াঃ কান্না রহস্য

সাদিয়া হোসাইন