মা হওয়া ২: প্রথম তিন মাস

অনেক বাচ্চারা জন্মের পর থেকেই দারুণ ঘুমায়, খায় চো চো করে, সারাক্ষন হাসে। বাবা মা খুশি হয়ে বলে, ’খুব ভালো বাচ্চা’। আবার অনেক বাচ্চারা কিছুতেই ঘুমাতে চায় না, ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে, নিয়মিত লম্বা সময় ধরে কান্না কাটি করে, খেতে সমস্যা করে। বাবা মা এবং আশে পাশের মানুষেরা বলে ’খুব জ্বালায়, দুষ্টু হইছে’।

কিন্তু মুশকিল হচ্ছে নবজাতক শিশুরা ফিতরাতের উপর জন্ম হয়, পুরাপুরি নিষ্পাপ। তখন ওরা দুষ্টু হতে জানে না, ইচ্ছা করে জ্বালাতেও পারে না। আমার মেয়েটা দ্বিতীয় প্রকারের ছিল। জন্মের পর বড় জোড় এক সপ্তাহ ঘুমিয়েছে বেঘোরে। তারপর থেকে শুরু হয়েছে তার ঘুমের সমস্যা, ঘুম পাড়াতে ঘন্টাখানেক লেগে যেত, ঘরে কেউ হাঁটলেই ঘুম ভেঙে যেত, সন্ধ্যার পর থেকে এক টানা কান্না শুরু করতো, কেঁদেই যেত কেঁদেই যেত।

আমাদের প্রজন্ম খুব দুর্ভাগা যে আমরা আশে পাশে বাচ্চা দেখতে দেখতে বড় হই না। আমাদের নিজেদেরও যেহেতু হাতে গোণা অল্প সংখ্যক ভাই বোন (আমরা তিন ভাই বোন) তাই আমাদের মায়েরাও এ ব্যাপারে সবজান্তা নন, যেমনটা নানুদাদুদের সময়ে বা আরও আগে ছিল। তখন দেখা যেত একটা মেয়ে ১৫ বছর থেকে ৪৫ বছর পর্যন্ত যতগুলো পারছে সন্তানের জন্ম দিচ্ছে আর পালছে। বড় মেয়েটার বড় সন্তান হওয়ার সময় মায়ের ছোট সন্তান আতুঁর ঘর থেকে বের হচ্ছে মোটে। মা-মেয়ে মিলে অনেক কিছু ভাগাভাগি করে সন্তান বড় করতেন।

সে জন্য মেয়েটাকে আল্লাহ যখন হাতে দিলেন, তখন আমি আকাশ থেকে পড়েছিলাম। আমার মায়ের সাথে অনেক পার্থক্য ছিল আমার অভিজ্ঞতার, যদিও অনেক উপদেশ কাজে লেগেছে, অনেক কিছু নিজেও করেছি। তাছাড়া মা আমার চাকুরিজীবি, তাই সব সময় উৎসাহ দিতেন আমাকে স্বাবলম্বী হওয়ার, নিজের মেয়ের যত্ন নিজেই করা শিখতে। শিখেছিও তাই আলহামদুলিল্লাহ। এখন অভিজ্ঞতাগুলো লিখে রাখার প্রয়োজন বোধ করছি, যদি কারো কাজে লাগে!

আমাদের মেয়েটা যখন ঘুমাতো না, সন্ধ্যা হলেই কাঁদতো, তখন আমার ডাক্তার জামাই আমাকে কয়েকটা উপদেশ দিলেন,

১. এটা কলিক হতে পারে, মনে হয় পেট ব্যাথা করে, তাই গ্যাসের ওষুধ খাওয়ানো যায়। কলিক সাধারনত ৩-৪ মাস পর্যন্ত থাকে, তারপরে সেরে যায়।

২. নবজাতক শিশুরা চার মাস পর্যন্ত দিনে ২-৩ ঘন্টা পর্যন্ত কাঁদতেই পারে, এটা খুব স্বাভাবিক। শুধু দেখো ওর

– গরম বা ঠান্ডা লাগছে কি না

– ক্ষুধা লেগেছে কি না বা

– ঘুম পাচ্ছে কি না

– খাওয়ার পরে ঢেকুর তুলেছে কি না

যদি দেখো এগুলো সব ঠিক থাকে, তাহলে চিন্তা কোরো না, কোন অসুবিধা হচ্ছে না, ওর শরীর সুস্থ আছে। কান্না কাটি করা তো ভালো, কাঁদতে পারছে মানে শরীর সুস্থ আছে!

মুশকিল হচ্ছে, মা হিসেবে আমি বুঝতাম এটা পেট ব্যাথা না। পেট ব্যাথা করলে এরকম ঘড়ি ধরে সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথেই শুরু হতো না।

আর ২-৩ ঘন্টা পর্যন্ত কাঁদতেই পারে! কান্নাকাটি করা সুস্থতার লক্ষন! ডাক্তাররা যখন মর-মর রুগী বাঁচানোর চেষ্টা করে, তাদের জন্য এই কথাটা বলা স্বাভাবিক, কিন্তু আমরা তো আমাদের গন্ডির সমস্যাগুলো নিয়েই আপ্লুত থাকি। হ্যাঁ আলহামদুলিল্লাহ ও অসুস্থ না, কিন্তু ও তো তবু কাঁদছে! আমি তো সহ্য করতে পারছি না!

তখন একটা আপুর উপদেশ মত একটা বই পড়েছিলাম, যেটা আমার খুব কাজে লেগেছিল। সেখান থেকে কি শিখেছি তাই বলি।

বাচ্চারা জন্মের সাথে সাথে পুরাপুরি ভিন্ন একটা পৃথিবীতে চলে আসে। এতদিন উষ্ণ পানিতে ভাসতো, সেই পানিতে মা-মা গন্ধ (সেই পানির গন্ধ আর শালদুধের গন্ধে অনেক মিল! আল্লাহর ডিজাইন বলে কথা!)। অস্তিত্বের শুরু থেকেই সে এভাবেই ভাসছে, যেখানে নিজেকে ভারশূণ্য মনে হতো, হাত পা সব বুকের কাছে জড়ো করে গুটিশুটি মেরে ঘুমাতো।

জন্মের পর থেকে চারিদিকে শূন্যতা, হাত পা নাড়ালে কোথাও থই পাওয়া যায় না! মা-মা গন্ধটা নাই। পেটের ভিতরে নিকষ অন্ধকার, কিন্তু দুনিয়ায় এত আলো! আর পেটে কিন্তু এক মুহূর্তের নি:শব্দতা নাই! মায়ের হৃদপিন্ডের শব্দ, রক্ত প্রবাহের শব্দ, খাবার হজমের শব্দ। পেটে কান পাতলে দেখুন কত জোড়ে মনে হয় এগুলো! এসবেই বাচ্চাটা অভ্যস্ত হয়ে থাকে।

দুনিয়াতে এসে সব চুপচাপ! প্রথম দু’এক সপ্তাহ লাগে একটু ধাতস্থ হতে, তারপরেই বুঝে মায়ের পেটের ভিতরে কত মজা ছিল! আর খুব মিস করা শুরু করে সেসব!

সারাদিন অবশ্য দেখার জিনিস থাকে অনেক, দেখতে দেখতে ভুলে থাকে একরকম, কিন্তু দিন শেষে আস্তে আস্তে ক্লান্তি বাড়তে থাকে। এমনিতে নতুন জায়গাটায় সে যতই অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছিল এতক্ষন, ক্লান্তিতে আর ইমোশনকে ধরে রাখতে পারে না। শুরু করে চিৎকার। একবার দু:খ শুরু হয়ে গেলে, সহজে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারে না, তাই ঘন্টার পর ঘন্টা চিৎকার চলতে থাকে।

সে জন্য ডাক্তাররা যখন বলেন, দিনে দুই তিন ঘন্টা কান্না স্বাভাবিক, আসলেই তাই। স্বাভাবিকই। আমরা নতুন কোন দেশে মাইগ্রেইট করলে প্রথমদিকে চোখের পানি ফেলি না? তারপর তো ঠিক হয়ে যায়। সারাক্ষন হয়তো চোখের পানি ফেলি না, কিন্তু রাতের বেলা ঘরে একা হলেই চোখে পানি জমে। আপনি কিছুই না করলেও, বাচ্চাকে কানতে দিলেও ৩-৪ মাসের মাথায় ইনশাআল্লাহ সত্যিই সব ঠিক হয়ে যাবে। কান্নাকাটি বন্ধ হয়ে যাবে, বাচ্চা দুনিয়ায় অভ্যস্ত হয়ে যাবে।

কিন্তু মা হিসেবে আসলে সেই অনবরত কান্নাটা সহ্য করা খুব কঠিন।

আমরা আমাদের বাচ্চাকে দুনিয়ায় অভ্যস্ত করার জন্য যা করতে পারি তা হচ্ছে পেটের পরিবেশের যেই যেই জিনিসগুলো ওরা পছন্দ করতো সেগুলো দুনিয়ায় ওর জন্য তৈরি করে দিতে। যেমন—

১. সোয়াডেল করা, শরীরটাকে একটা কাপড় দিয়ে ভালো করে মুড়িয়ে রাখা। এতে সে পেটের সেই হাত পা বাঁধা পরিবেশের কিছুটা পাবে।

২. হালকা দুলানো—দোলনায় হোক বা কোলে হোক, প্র্যামে হোক। মা হাঁটলে বা নি:শ্বাস নিলে যেমন দুলুনিতে থাকতো সেরকম দুলুনিতে একটু শান্তি পাবে।

৩. নি:শব্দতা কমিয়ে এনে হালকা কিংবা অনবরত শব্দের মধ্যে রাখা, পেটের মত। মুখে “শশশশ” করা যায়, জিকির করা যায়, সূরা পড়া যায়, সূরা ছেড়ে রাখা যায়। অনেকে ভ্যাকুয়াম ক্লীনার, হেয়ার ড্রায়ার কিংবা সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ ডাউনলোড করে ছেড়ে রাখেন।

৪. বেশি কান্নাকাটি করতে থাকলে রাত বারোটা বাজলেও উষ্ণ গরম পানিতে গোসল করানো। নবজাতক শিশুরা সাধারনত গোসল খুব পছন্দ করে।

আমি উপরের ব্যাপারগুলো শুরু করার পরে আলহামদুলিল্লাহ মেয়েটার কান্নাকাটি একেবারে নাটকীয় ভাবে অনেক কমে গিয়েছিল।

যেহেতু সন্ধ্যার সময়ই তার ক্লান্তি শুরু হতো, তাই সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে কান্নাকাটি শুরু করার আগেই আমি হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করাতাম। তখন শীতকাল ছিল, তবু সন্ধ্যায় গোসলটা বাদ দিতাম না। ঘরটাকে হীটার দিয়ে একটু গরম করে রাখতাম, গায়ে গরম তেল মেখে দিতাম। তারপরে সূরা পড়তে পড়তে দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়ানোর ব্যবস্থা করতাম। এভাবে মাগরিবের নামাজ পড়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই দেখা যেত মেয়ে আবার ঘুম। এরকম শুরু করার পর থেকেই অনবরত কান্নাটা ওর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আলহামদুলিল্লাহ।

আরেকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল ওকে ওভারটায়ার্ড হতে না দেয়া। নবজাতক শিশুরা, চার মাস পর্যন্ত এক থেকে দেড় ঘন্টার বেশি এক টানা সজাগ থাকতে পারে না। ওদের ছোট শরীরে অনেক ঘুম দরকার হয়। এর বেশি যদি সজাগ রাখা হয়, তাহলে ওভারটায়ার্ড হয়ে যায়।

আমরা যেমন খুব বেশি ক্লান্ত হয়ে গেলে অনেক সময় বিছানায় এপাশ ওপাশ করে আর ঘুমাতে পারি না, ওদেরও তাই হয়। তখন আর কিছুতেই ঘুমাতে পারে না। ওভারটায়ার্ড অবস্থায় আর কিছুই ভালো লাগে না, খাওয়া ভালো না, কোন কথা ভালো লাগে না। কান্না একবার শুরু হলে তখন সহজে থামাতেও পারে না।

শুরুর দিকে, যখন কান্না থামাতে কোলে নিয়ে হাঁটতাম বা কোলেই দুলাতাম, আমাকে অনেক মুরুব্বীরা বলতেন, মেয়েকে দুলালে, নিয়ে নিয়ে হাঁটলে, বেশি বেশি কোলে রাখলে অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে। আমি একমত হতাম না। আমরা নতুন দেশে গেলে বাংলা শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু প্রথম দিকে যেই আকুতি থাকে, সময় যেতে যেতে সেটা কিন্তু ঠিকই ঠিক হয়ে যায়।

মেয়েটা যেখানে পেটে ২৪ ঘন্টা উষ্ণতায় জড়িয়ে থাকতো মা মা গন্ধে, ভারশূন্য হয়ে দুলতে থাকতো, এভাবে থেকেছে তার অস্তিত্বের শুরু থেকে, নয়টা মাস, সেখানে আমি যদি দিনে ২/৩ ঘন্টাও ওকে কোলে রাখি, বুকের কাছে জড়িয়ে রাখি, তবুও তো তুলনামূলক ভাবে অনেক কম!

মোটামোটি তিন চার মাস থেকে বাচ্চাদের সত্যিই একেবারে নাটকীয় পরিবর্তন হয়। প্রথম দিকে যেমন মনে হতো মাথা ভেদ করে অন্য দিকে তাকাচ্ছে, অন্য গ্রহের প্রানীর মত ধীরে ধীরে মাথা নাড়াচ্ছে, তিন-চার মাসের পর থেকে সেরকম থাকে না। হাসে, টুকি-ওয়া খেললে মজা পায়, ঘাড় শক্ত হয় কিছুটা। সেই সময় থেকে আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে ঘুম পাড়ানো ইত্যাদি কমিয়ে আনার চেষ্টা করলে কোন সমস্যা হয় না আর।

প্রথম তিন মাসে আমার মূলনীতি ছিল মেয়েকে দুনিয়াতে আগমনের শক অ্যাবজর্ভ করে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত করে তোলা। আলহামদুলিল্লাহ মেয়ে আমার এখন ১১ মাসের চঞ্চল মেয়ে। কোলে রাখা যায় না, অসুবিধা না হলে কান্নাকাটি করে না মাশাআল্লাহ, ঘুমায়ও সহজে।

————————————–
মা হওয়া ২: প্রথম তিন মাস

সাদিয়া হোসাইন