মা হওয়া ৬: সন্তান এবং দাম্পত্য

মা হওয়ার আগে অনেক শুনেছি সন্তান হওয়ার পরে ’সব কিছু বদলে যাবে’, অভিজ্ঞজনেরা বার বার বলেছেন দু’জনের সম্পর্ক আর একরকম থাকবে না। সত্যি বলতে কি, এই নিয়ে একটু ভয়েই থাকতাম, তারপরেও ভাবতাম যে প্রস্তুতি যেহেতু আছে, তাই আমাদের এরকম হবে না।

কিন্তু মা হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরে সত্যি সত্যি আবিষ্কার করলাম, ঘরের মানুষটাকে ’অসহ্য’ লাগছে! শুধু দোষ চোখে পড়ছে, বেচারা মুখ বুঁজে আমার বকা খেয়ে যাচ্ছে।

এমনিতে তো শরীরে নানা রকম কেমিক্যাল ইমব্যালেন্সের ব্যাপার স্যাপার আছেই, কিন্তু অতটুকুই সব না। বাবু হওয়ার আগে যেই ব্যাপারটা একেবারেই বুঝতে পারি নি, সেটা হচ্ছে–একটা বাবু ১০০% সময় নিয়ে নেয়।

নবজাতক শিশু যখন প্রতি দুই তিন ঘন্টা, ভাগ্য ভালো থাকলে চার ঘন্টা পর পর খায়, তাও মুখ আর পেট ছোট বলে খেতে এক ঘন্টা লাগিয়ে দেয়। তারপরে আবার সাথে সাথে বমি করে জামা ভরিয়ে ফেলে, যেটা পরিষ্কার করতে করতেই ন্যাপি বদলানোর সময় হয়ে যায়। এই করতে করতে আবার খাওয়ানোর সময় হয়ে যায় কিংবা ঘুমের সময় পার হয়ে যায় সুতরাং কান্নাকাটি শুরু করে দেয় খুব…

যখন আমাদের সমাজে একান্নবর্তী পরিবার ছিল, কিংবা এখনও, যখন বাবু হওয়ার পরে বয়স্কা আত্মীয়রা আর কাজের মানুষেরা, অন্তত: একজন মানুষ সাহায্যের জন্য থাকে সার্বক্ষনিক, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু যারা বিদেশে থাকেন, পরিবার পরিজন থেকে অনেক দূরে, কিংবা যাদের মায়েরা, শাশুড়ীরা আমার মা-শাশুড়ীর মত চাকরিজীবি, তাদের জন্য সবেধন নীলমনি হচ্ছেন বাচ্চার বাবা। কিন্তু বাচ্চার বাবারাও তো সারাক্ষন বাসায় থাকে না, বাইরের কাজ আছে।

তার উপর যখন সাথে থাকে আমার মত সিজারিয়ানের সেলাই, দেড় মাস পর্যন্ত নানা কাজে নিষেধাজ্ঞা, উঠতে বসতে ব্যাথা! এর সাথে যোগ হয় নির্ঘুম রাত… ঘুমহীন, ক্লান্ত, অসুস্থ শরীরে, স্বাভাবিক কাজগুলোও অনেক বেশি কঠিন লাগে।

আগেও দুই জন মানুষই ছিলো, কিন্তু সন্তান হওয়ার পরে, কাজের পরিমান যখন একশ’ গুণ বেড়ে যায়, তখন দুই জন মানুষের মধ্যেই নতুন কাজগুলো ভাগ হয়ে যেতে হয়। এবং তারপরে, বেশির ভাগ সময়ই বাবারা সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ’কাজ খুঁজে পায় না’।

আপনি ঠিকই দেখছেন ন্যাপির বিন উপচে পড়ে যাচ্ছে, ধোওয়া কাপড়গুলো শুকিয়ে দুই দিন ধরে বাইরে ঝুলছে, কিংবা পড়ানোর কাপড় শেষ হয়ে যাচ্ছে কাপড় ধোওয়া দরকার, কিন্তু বাবারা ব্যাপারটা দেখতে পারবেন না।

একদিকে তো কাজের প্রেশার, তারপরে নানা ব্যস্ততায় একটা কাজের কথা একবার মনে হলে সেটা সাথে সাথে করতে না পারলে আবার ভুলে যেতে হয়। কাজের কথা এত ভেঙে বলার মুড থাকে না, সেজন্যই রাগারাগি।

অন্য দিকে কিন্তু বাবারাও খাটছে প্রচুর, আপনি হরমোন চুবানো ব্রেইন নিয়ে বাজারের লিস্টিতে জিনিস যোগ করতে ভুলে যাচ্ছেন বলে বাবাকে বার বার বাজারে দৌড়াতে হচ্ছে। যা বলছেন তাই করছে। এরকম সিচুয়েশন অনেক রিস্ক থেকে যায় দুই জনের দুই জনের প্রতি রাগ জমা হওয়ার।

ওই কঠিন সময়টায় কিছু জিনিস আমাদের খুব কাজে লেগেছিল:

১. কাজের তালিকা – দুইজনই যখন মাথা নিচু করে কাজ করে যাচ্ছি সারাদিন, তখন কিন্তু খুব অন্তর্মুখী হয়ে যেতে হয়। অন্য জনের চোখ থেকে ব্যাপারটা দেখার ক্ষেত্রে খুব কাজে দেয় অন্যজনের মুখ দিয়ে শোনাটা।

একবার দুইজন মিলে বসে আলাদা আলাদা খাতায় কাজের লিস্ট করে ফেললাম—একটা ২৪ ঘন্টার দিনে কি কি কাজ করি। কি কি কাজ ’আছে’, যেটা দু’জনের একজনের করতে হবে। এটা করার পরে দু’জনেই বুঝতে পারলাম আসলে দুই জনেই কাজে হাবুডুবু খাচ্ছি। তারপরে কাজগুলো ভাগাভাগি করে নিলাম, কোন কাজগুলো কে করার চেষ্টা করবে (না পারলে সে বলে অন্য জনকে দিয়ে করাবে)।

এই কাজটা করার পরে দেখলাম যেহেতু মেয়ের বাবা জানে যে ওর ঠিক কি কি করতে হবে, ও নিজের সময় অনুযায়ী সেগুলো করে ফেলছে, আমার বলার জন্য অপেক্ষা করছে না। আমিও সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামানো বন্ধ করে দিয়েছি, নিজের সময় মত তো করবেই!

২. ওয়াইটবোর্ড/অ্যাপ – একটা এ-৪ (ডিমাই) সাইজের ছোট ওয়াইটবোর্ড কিনে ফেললাম দশ ডলার দিয়ে। তারপরে সেটা সেঁটে দিলাম দেয়ালে। সাথে ম্যাগনেটিক মার্কার, যেন হারিয়ে না যায়।

আমি যেহেতু ভুলে যাই ঠিক কি কি লাগবে, অনেক বারে ভেঙে ভেঙে মনে পড়ে, তাই সেগুলো মনে পড়া মাত্র লিখে রাখা শুরু করলাম। মেয়ের বাবাকে বলা থাকলো বাইরে বের হওয়ার সময় শুধু ওখানে চোখ বুলিয়ে বের হবে। এই কাজ করার পরে দু’জনের স্ট্রেসই অনেকটুকু কমলো।

এর কিছু মডার্ন ভ্যারিয়েশন আছে—কিছু অ্যাপআছে, যেগুলোতে একজন লিখলে অন্যজনের মোবাইলে লিস্ট আপডেইট হয়ে যাবে। এটাও আমার খুব কাজের মনে হয়েছে।

৩. পালা করে ঘুম – দুধ খাওয়ানোটা বাবারা করে দিতে পারে না। কিন্তু এছাড়া বাকি সব, ঘুম পাড়ানো, ন্যাপি বদলানো, এগুলো বাবারা করতে পারে। দু’জনেরই তো না ঘুমিয়ে লাভ নেই।

সাধারনত ওকে বাইরে যেতে হবে, তাই নাইট-ডিউটি থেকে অব্যাহতি দেয়ার চেষ্টা করতাম, কিন্তু মাঝে মাঝে যখন ঘুমের অনেক বেশি সমস্যা হয়ে যেত, তখন নিজ থেকে বলতাম যেন ওই রাতটা আমাকে ঘুমাতে দেয়।

যখন নিজে অনেক কষ্টে আছি এরকম মনে হয়, তখন কিন্তু ইচ্ছা করে না প্রয়োজনের কথাটা আরেকজনকে বলতে। মনে হয়, বুঝবে না কেন? ঘুমাতে পারছি না, দেখবে না কেন? কিন্তু আসলেই না দেখার বা না বুঝার অনেক জেনুইন কারণ থাকতে পারে। তাই বলতে হবে।

৪. বাচ্চার সাথে কাজ করা, বাচ্চার সাথে ঘুম – যখন ঘুমের সময়ের টানাটানি, তখন অনেক মায়েদের দেখি বাচ্চারা ঘুমানোর সাথে সাথে ঘরের কাজ নিয়ে উঠে পড়ে লাগতে। এভাবে আসলে নিজের শরীর আর মনকে রেস্ট দেয়ার কোন সময়ই পাওয়া যায় না।

সবচেয়ে ভালো হয় বাচ্চাকে সাথে নিয়ে নিয়ে কাজ করা গেলে আর বাচ্চার ঘুমের সময় রেস্ট নেয়া গেলে। অনেক সময় দেখা যেত ওকে পাশে বাউন্সারে রেখে কাজ করতে পারছি, অনেক সময় দেখা যেত ’স্লীঙে’ নিয়ে, কোলে নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু তবু সাথে রাখতাম। এভাবে মেয়েটা নিজেও ব্যস্ত থাকতো নানা জিনিস দেখতে দেখতে, আমিও পরে ওর ঘুমের সময় রিলাক্সের সময় পেতাম।

৪. দুই জনের সময়, নিজেস্ব সময় – গত এক বছরে মায়েদের বিভিন্ন ভার্চুয়াল এবং রিয়েল গ্রুপের সদস্য হিসেবে দেখলাম অনেক মায়েদের অনেক রকম ইনসিকিউরিটি।

কেউ বলছে স্বামীর সাথে সম্পর্ক আর আগের মত নেই, কারো স্বামী নিজে থেকেই বলে যে আগের মত আর আকর্ষনীয় মনে হয় না স্ত্রীকে। এই ব্যাপারগুলোর প্রতিকার একটাই, দুইজনের একটু নিজেস্ব, সুস্থির সময় কাটানো, ’দাম্পত্যময়’ সময় কাটানো। প্রতিদিন।

একেবারে সত্যি কথা হচ্ছে, বেশির ভাগ পুরুষ এবং নারী, একজন ’সঙ্গী/সঙ্গিনী’ চান। যখন বন্ধুত্বের জায়গায় স্বামী/স্ত্রীকে নিয়মিত দেখতে পারেন না, প্রয়োজনের কথাগুলো মন খুলে বলতে পারেন না, তখনই নানা খুঁত চোখে পড়ে।

সেজন্য এক সাথে সময় কাটিয়ে এই সম্পর্কটা জারি রাখা খুব দরকার। পাঁচ মিনিট হোক, দশ মিনিট হোক, আধা ঘন্টা হোক। দুই জনে এক সাথে এক কাপ চা খাওয়া, ’আগের মত’ নানা বিষয়ে কথা বলা, এক সাথে কোন বইয়ের দুই পাতা পড়া, আশে পাশের রাস্তা থেকে একটু হেঁটে আসা। একটুখানি হাত ধরে বসে থাকা।

এই ব্যাপারটা খুব, খুব জরুরি, যত সময়ের টানাটানিই থাকুক না কেন, কারণ সন্তানের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার বাবা মায়ের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক। আর অনেক ঝামেলা এড়ানো যায় শুধু নিয়মিত একটু খানি রিলাক্সড সময় কাটিয়ে এক সাথে।

মেয়েটার মোটামোটি তিন মাস থেকে আমি সাতটার সময় ঘুম পাড়িয়ে দেয়া শুরু করেছিলাম। তারপরে অন্তত: তিন চার ঘন্টা ঘুমাতো টানা। এই তিন চার ঘন্টা সময়কে তিনটা কাজে ব্যবহার করতাম। একটা হচ্ছে পারিবারিক সময়। বাবা, মা, ভাই, বোন, জামাই, সবার সাথে এক সাথে খাওয়া, গল্প করা।

তারপরে দাম্পত্য সময়। দুইজনে এক সাথে বসে এক কাপ চা খাওয়া, দিনের সব কিছু নিয়ে গল্প করা।

আর তারপরে নিজেস্ব কিছু সময়। একটু পিএইচডির কাগজপত্র উল্টে দেখা, একটু একা বসে কোন বই পড়া বা কিছু লিখা। কিংবা একটু সময় নিয়ে গোসল করা!

এই যে নিজের, নিজেদের জন্য কিছু সময় আলাদা করে নেয়ার জন্য শরীর মন প্রতিদিন দিনের শেষে একেবারে ঝরঝরে হয়ে যেত, দিনের ক্লান্তি কেটে যেত একদমই, সে জন্যই কিন্তু দিনগুলোকে যত কঠিন মনে হতে পারতো, তত কঠিন মনে হয় নি। তাই আপাত: দৃষ্টিতে স্বার্থপর মনে হলেও, এরকম কিছু সময় আসলে দু’জনের জন্য, পুরা পরিবারের জন্যই খুব দরকার।

৫. হলিডে – প্রকৃতির কাছে গেলেই মন ভালো হয়ে যায়। একটা ছোট বাচ্চাকে নিয়ে বের হওয়া একেবারেই অন্যরকম, কিন্তু সত্যি সত্যি হলিডেতে যেতে পারলে, সেটা এক দিনের জন্যই হোক কিংবা কয়েক দিনের জন্যই হোক, সব কিছু অনেক বেশি সুন্দর হয়ে যায়।

৬. দোআ করা – দোআয় চাওয়া যায়, ইন্ট্রোস্পেকশনের সময় পাওয়া যায়। চাইলেই যেহেতু পাওয়া যায়, এই সুযোগটা হাতছাড়া করা উচিত না মোটেও!

সব মিলিয়ে একটা অদ্ভূত ব্যাপার খেয়াল করলাম। হ্যা, অভিজ্ঞ আপুদের ওই কথাটা ঠিক, ’সব কিছু বদলে যাবে’, কিন্তু বদলানোটা নিয়ে যে ভয়ে থাকতাম, আসলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

দুইজন মিলে একটা শেয়ারড রেসপনসিবিলিটি পালন করে, একটা কঠিন সময় এক সাথে পার করে, পৃথিবীতে একজন মানুষকে এনে সেই মানুষটাকে পৃথিবীর আলো বাতাসে অভ্যাস করে তোলার অসাধ্য সাধন করে, এক বছর পরে অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, এর আগের তিন বছরে মানুষটা যত কাছে আসতে পেরেছে ভেবেছিলাম, এই এক বছরে তার চাইতেও অনেক আপন হয়ে গিয়েছে! আলহামদুলিল্লাহ।

তারপর মনে হলো, এতদিনে বুঝলাম শেইখ আলা আল সাঈদের সেই কথাটা, যেটা শুনে আগে একটুও বিশ্বাস করি নি–’সন্তান হওয়ার আগ পর্যন্ত তোমরা বিবাহিত জীবন কাটাচ্ছো না, তোমরা হানিমুনে আছো!’ সন্তান হওয়ার পরে আসলেই সব কিছু বদলে যায়, জীবনের একেবারেই নতুন একটা সময় শুরু হয়, কিন্তু সন্তান হওয়ার আগে যদি দু’জনের সম্পর্ক সুন্দর থাকে, আর সদিচ্ছা থাকে, তাহলে একটু চেষ্টা করলেই দাম্পত্যটা দারুণ কিছু হয়ে উঠতে পারে!

———————————–

মা হওয়া ৬: সন্তান এবং দাম্পত্য

সাদিয়া হোসাইন