হবু-শাশুড়ির কাছে পত্র

আসসালামু আলাইকুম, 

কেমন আছিস রে? আমরা ভালোই আছি। জানিসই তো, আমার মেজো নাতিটার ডেংগু হয়েছিল। এখন একটু ভালোর দিকে, তবে শারীরিক দুর্বলতার কারণে ওকে নিয়ে কোথাও বের হওয়া যাচ্ছে না। আমারো হাটুর ব্যাথাটা বেড়েছে, আগামী সপ্তাহে হিজামা করাতে যাব। তোর বড় ছেলের বিয়েতে যেতে পারছি না বলে খুবই দুঃখিত। 

তবে আমি সিনিয়র শাশুড়ি হিসেবে একজন হবু শাশুড়িকে কিছু উপদেশ দেয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। জানিসই তো ক্যাম্পাসে আমি উপদেষ্টা নামে পরিচিত ছিলাম, সবাইকে ফ্রি ফ্রি উপদেশ দিয়ে বেড়াতাম। কী দিনগুলিই না ছিল…। যাক, কথা না বাড়িয়ে শুরু করা যাক। 

ছেলের বিয়ে নিয়ে প্রথম প্রথম খুব আনন্দিত আর উত্তেজিত থাকলেও বিয়ের দিন থেকে অন্যরকম একটা কষ্ট গলায় দলা পাকিয়ে উঠতে থাকে। জানি না তুই কিভাবে সামলাতে পারবি। কী এক অজানা কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল আমার, অধিকার হারানোর ভয় হয়তো। তারপরও হাসি হাসি মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। শত ব্যস্ততার মাঝেও ফ্ল্যাশব্যাকের মত অতীতের দিনগুলি একের পর এক চোখের সামনে চলে আসছিল – প্রথম মা হওয়া, প্রথম মা ডাক শোনা, আমার হাত ধরে হাটতে শেখা, প্রথম অক্ষর শেখানো, অসুস্থতায় আগলে রাখা থেকে শুরু করে পঁচিশ বছরের যত হাসি-কান্নার দিনগুলি। 

ছেলের মা হয়ে যদি আমার এমন অনুভুতি হয় তাহলে মেয়ের মার না জানি কেমন লাগছিল। ছেলেতো আমার কাছেই থাকবে, আর মেয়েকে নিজের পরিবার ছেড়ে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশ, নতুন পরিবারে চলে আসতে হয়েছে। প্রথম থেকে তুইও এই কথাটা মাথায় রাখিস – ওকে মানিয়ে নিতে সময় দিস।

প্রথমেই আশা করবি না যে নতুন বউ তোর মত বাসার রান্নাবান্নাসহ সংসারের সব কাজে পারদর্শী হবে। এখন আর আমাদের মত সেই দিন নাই যে মেয়েরা ছোট থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি রান্নাঘরেও সক্রিয় থাকবে। এখনকার মেয়েরা বটি দিয়ে পেঁয়াজ কাটার মত সামান্য কাজটাও জানে না।

শোন, বউয়ের মত তোকেও কিছু বিষয় মানিয়ে নিতে হবে। প্রত্যাশা রাখলেই অহেতুক অশান্তি তৈরি হবে। ঘর সংসারের কাজ তো দূরের কথা, এখনের মেয়েরা দেখবি নিজের পরনের জামাটাও বুয়াকে দিয়ে ধোয়ায়। ভাত খেয়ে নিজের প্লেইটটা অন্য কেউ ধুবে বলে রেখে দেয়। তোর কাছে খারাপ লাগলেও এটাই এখন স্বাভাবিক। সুতরাং প্রত্যাশা রেখে কোন লাভ নেই। দু-চার বছর সময় দে, দেখবি ইউটিউব দেখে তোর চাইতেও ভালো রান্না করে পরিবারের সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে। 

বউয়ের কোন স্বভাব বা আচরণ তোর মন মত না হলে ভুলেও কখনো তার বাবা-মা-কেন-শেখায়নি এধরনের কথা বলা যাবে না। এটা সত্যি যে বাবা-মার কারণেই তারা এমন হয়, তারপরও এসব ব্যাপারে চুপ থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। 

বিয়ে করানোর পর ছেলে-বউ দুইজনকেই অনেক বিষয়ে ছাড় দিতে হয়। তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার-স্যাপারে কখনোই নাক গলাতে যাবি না, তোর নিয়ত যত ভালোই হোক না কেন। তোর পরিবারে তাদের প্রাইভেসির দিকটা খেয়াল রাখবি। 

জেনে রাখ – বউয়ের ঘর অগোছালো থাকলে, দরজা-জানালা সারাদিন বন্ধ করে বসে থাকলেও তোর মুখ বন্ধ রাখবি। উভয়পক্ষের শান্তি রক্ষার্থে এসব ব্যাপারে টু শব্দ করা যাবে না। অধিকার খাটিয়ে কিছু বলতে গেলে হিতে বিপরীত না হয়ে যায়। এরচেয়ে ইগনোর করাটাই বেটার। 

আর অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বউয়ের সাথে অতিসাবধানে চলবি। হরমোনাল ইমব্যালেন্সের কারণে এসময় তোর যে কোন সদুপদেশকেও সে অন্য দৃষ্টিতে দেখবে, কারণে-অকারণে কষ্ট পাবে, ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিবে। এতে কিন্তু ওর কোন দোষ নেই, সব দোষ ওই হরমোনের। 

সন্তান জন্মের পর খুঁটিনাটি যে কোন বিষয়ে সে তোর মত অভিজ্ঞ মাকে বাদ দিয়ে অনলাইনে নতুন অথবা হবু মা’দের কাছে পরামর্শ চাইবে, এতে মনে কিছু নিস না। আজকালকার মেয়েরা নিজের মা, খালা, বড় বোনকেও বিশ্বাস করে না যতটা না ফেসবুকের অচেনা কাউকে করে। নাতি-নাতনীকে ভালোবাসবি, তবে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলবি। বেশি আদর করলে আবার কী না কী ভেবে বসে ঠিক নাই। 

বউকে কখনো, আই রিপিট কখনোই নিজের মেয়ের মত ভালোবাসবি না। নিজের মেয়েকে যা খুশি বলে ঝাড়ি দিয়ে দেখ, দিন শেষে সে সব ভুলে আগের মতই তোকে ভালোবাসবে। অথচ বউকে রাগের মাথায় সামান্য বকাঝকা করলেই তোর ছেলে নিয়ে আলাদা হয়ে যেতে চাইবে, এমন কি তোর মৃত্যু পর্যন্ত কামনা করতে পারে!

মনে করে দেখ, নিজের আদরের সন্তানকে ছোটবেলায় রাগের মাথায় অতিরিক্ত শাসন করে পরে নিজেই কত কষ্ট পেতিস। আমিও কি এক কারণে একদিন বউকে আপন ভেবে শাসন করে পরে খুব অনুতপ্ত হয়েছিলাম। তোর সাথে এমন হলে বেশি ভালো ব্যাবহার দিয়ে বুঝিয়ে দিবি তুই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিস। এতে ছোট হবি না বিশ্বাস কর, বরং তার চোখে অনেক বড় হয়ে যাবি।

মেয়েরা স্বভাবগতভাবে দুর্বল হয়। সামান্য ভালো ব্যবহার, মা বলে সম্বোধন, একটু হাসিমুখে কথা বললেই সব মান-অভিমান ভুলে ভালোবেসে আপন করে নেয়। বউয়ের সাথে সুন্দর ব্যবহার করবি, তার ছোটখাটো চেষ্টার প্রশংসা করবি, উৎসাহ দিবি। দেখবি দু’জনের মধ্যে সম্পর্কটা কত মধুর হয়ে যায়।

মনে রাখিস, বউকে শুধু তোর পরিবারের একজন সম্মানিত মেহমান হিসেবে না – তোর সন্তানের বেটার হাফ; বংশধরদের জন্মদাত্রী, প্রতিপালক হিসেবে ট্রিট করবি। তাই বলে একেবারে মাথায় তুলে রাখতে হবে তা বলছি না। তাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিবি, দেখবি তোর সম্মান কোন অংশে কম হবে না। 

ছেলের কাছে কখনো তার নামে কম্পলেইন করবি না। কোন অভিযোগ থাকলে সরাসরি কথা বলে মিটিয়ে নেয়াই ভাল। “কমিউনিকেশন গ্যাপ” হলো বউ-শাশুড়ির মধ্যকার যত ঝামেলার অন্যতম কারণ। 

পরিশেষে আরো একটা কথা বলতে চাই। নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সিদ্ধান্ত তার উপর চাপিয়ে দিবি না। যেমন, তুই জব করিস বলে তাকেও জব করতে হবে, অথবা তুই চাস না বলে সে জব করতে পারবে না – এমন যেন না হয়। তোর ইচ্ছার কথা অবশ্যই বউয়ের সাথে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে জানিয়ে দিতে পারিস, মানা না মা তার ব্যাপার। 

বউ-শাশুড়ির কোন্দল সেই প্রাচীন যুগ থেকে চলে আসছে। একই সংসারে দুই পরিবারের দুই নারী একসাথে থাকলে ঝামেলা বাধবেই। একটু সচেতন আর সতর্ক হয়ে চললেই কিন্তু শান্তিতে থাকা সম্ভব।

এক গাদা উপদেশ দিয়ে ফেললাম রে। বিয়েটা হয়ে গেলে তোর বউকে নিয়ে একদিন আমার এখানে বেড়াতে চলে আসিস। খুব খুশি হব। এই সুযোগে আমার বউমার কাছ থেকে তোর বউও কিছু টিপস আদায় করে নিতে পারবে, কি বলিস?

মাসালাম,
ইতি
সালমা

“হবু-শাশুড়ির কাছে পত্র “
বিনতে আদাম
(১৬ নভেম্বর ২০১৭)