আজ শুভ্রর ঈদ

১.
“আব্বা শুভ্রর অবস্থা কিন্তু দিনকে দিন বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে। ওকে হলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।”

দুলাভাইয়ের গলা খুব সতর্ক, তবু কথাটা কানে চলে এল। সকাল সাতটায় কেউ কথা বললে পুরো বাড়ি কেমন গমগম করে ওঠে। সে যত নিচু গলাতেই হোক।

ডাইনিং রুমে বাবা আর দুলাভাই নাস্তা সারছে। মা খাবার বেড়ে দেবার দায়িত্বে। এই তিনজন একসাথে হলেই আমার অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন৷ তাদের কথা শুরু হয় আমার বিপদ নিয়ে। শেষও হয় বিপদ নিয়ে।
এরমাঝে দুলাভাই সবচেয়ে সক্রিয়। বাবা দুলাভাইয়ের সব কথার সাথে একমত। আর মা সহনীয় মাত্রা পর্যন্ত আমার বিরুদ্ধে, এরপর আমার বদনাম শুনলেই প্রতিবাদ করে ওঠেন। বাবা আর দুলাভাই অবুঝ মাকে নিয়ে ঝামেলায় আছেন। একটু আয়েশ করে আমাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হবেন, সেই জো নেই।

আমার বিপজ্জনক অবস্থার শুরু গত বছর। তখন পড়ি ভার্সিটির সেকেন্ড সেমিস্টারে। কোথায় যাচ্ছি, কার সাথে ঘুরছি কারো কোনো খেয়াল নেই তাতে। একদিন বাবা দেখলেন এশার নামায শেষে মসজিদ থেকে বের হচ্ছি। বেশ হকচকিয়ে গেলেন।

“কী রে তুই মসজিদে কী করছিলি?” এই ছিল বাবার প্রথম কথা। এরপর বাড়িতে নানান গোপন মীটিং, প্রকাশ্য জেরা। মীটিং এর সভাপতি আমার বাবা খালেকুজ্জামান। চীফ গেস্ট দুলাভাই সবুজ খান। তার ফেসবুক নাম “নিরাসক্ত অনির্বাণ”।

এই নামের অর্থ কী তা দুলাভাই নিজেও জানে না। এটা তার রক্তের অণু থেকে, অন্তরের গহীন থেকে উৎসারিত। এসব নামের অর্থ হয় না, উপলব্ধি হয়, অচিন এক অনুভূতি হয়।
আমার আবার অত উপলব্ধি, অনুভূতি হয় না। শুধু এটুকু জানি এমন নাম রাখতে হলে কোনো এক বৃক্ষের পাতা পুড়িয়ে ধোঁয়া সেবন করতে হয়। তাছাড়া এসব নামেই বোঝা যায় দুলাভাই মুক্তচিন্তার পথিকৃৎ গোছের কেউ।

আমার খোঁচা খোঁচা দাড়ি যখন সুন্নতি দাড়ি হয়ে গেল তখন তো গৃহযুদ্ধ হয় হয় অবস্থা।

প্রথম প্রথম ভীষণ রেগে যেতাম। রাগ দেখে সম্ভ্রান্ত মুসলিম বাবা মা আরো নিশ্চিত হতেন ছেলে জংগী হয়ে গেছে। ভাল মুসলিম হলে অমন চেঁচাবে কেন? তাও আবার মা বাবার সাথে! ভাল মুসলিমদের আচরণ সুন্দর হয়। তাছাড়া তারা তো জুমার নামাযে, ঈদের নামাযে বাধা দিচ্ছেন না। প্রতিদিন কেন পাঁচবার মসজিদে যেতে হবে?

আমিও বুঝতাম মা বাবার সাথে রাগারাগি করা ঠিক না। কিন্তু নিরাসক্ত অনির্বাণ দুলাভাইয়ের উস্কানিতে মাথা নষ্ট হয়ে যেত।

এখন রাগ নিয়ন্ত্রণ শিখে গেছি। সব কথায় পাত্তা দেয়া যাবে না। তবে চান্স পেলে নিরাসক্ত ভাইকে ছাড়ি না। আজ এত সকালে নিরাসক্ত ভাইকে বাবা ডেকে তুলেছেন। গরু কিনতে দু’জন মিলে হাটে যাব আমরা। যাদের সাথে ভাগে কুরবানি দিচ্ছি, তারাও যাবেন হাটে। নিরাসক্ত ভাই না গেলেও হয়। কিন্তু প্রতি ঈদে এই ঝামেলাকে বাবা আমার কাঁধে তুলে দেন।

২.
কুরবানির হাট থেকে মাত্র ফিরলাম। দুলাভাই মাঝ রাস্তাতেই কাট্টি মেরেছেন। যতক্ষণ ছিলেন আমার সাথে, ইসলামের অসারতা প্রমাণ করে ছেড়েছেন। ভাই কিন্তু নাস্তিক নন। ধর্ম তার অন্তরে। শবে বরাতের বাজি পটকা, আর রুটি গোশতে তার ভীষণ টান। কেবল ‘নৃশংস পশু হত্যার’ সময় এলেই তার অন্তরে গ্যাস্ট্রিক হয়ে যায়।

আমি চাইলেই যাবার পথে তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে পারতাম। বলতাম, গরুর ঢুশ খেয়ে পড়ে গেছে। তা করি নি। নিরাসক্ত ভাইকে নিয়ে আমার সুদূরপ্রসারী প্ল্যান আছে।
হাট থেকে গরু নিয়ে এলাকায় ঢোকার সময় দুলাভাইকে ফোন দিলাম। উনি এতক্ষণ হাওয়া খেয়েছেন। এখন আমাদের সাথে জয়েন করবেন। বরাবর এমনই হয়। বাবা জেনেও না জানার ভান করেন। মেয়ের জামাইকে কিছু বললেও মেয়ে কষ্ট পাবে, আবার হাটে না পাঠালেও মেয়ের অভিমান হবে। এ এক উভয় সংকট।

বাসায় ফেরার পর ছোটখাটো একটা নাটক মঞ্চস্থ হয়ে গেছে। নাটকের পরিকল্পনা আমার প্রাণপ্রিয় দুলাভাইয়ের। তিনি কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বাবাকে বললেন,
“আব্বা যে দেশে মানুষ না খেয়ে মরছে, সে দেশে এত হাজার হাজার টাকা খরচ করে কুরবানির কী দরকার? এই টাকা একটা মানুষকে দিয়ে দিলেও তো তার কর্মসংস্থান হয়ে যায়। সময় এসেছে মনের পশুকে কুরবান দেয়ার”
জানি বাবা কিছু বলবেন না। আমিই বললাম,
“ভাইয়া, যাকাতের ব্যবস্থা তো আছেই। আর মনের পশু কুরবান দিতে রমজানে টানা একমাস রোযা রাখলাম। তখন রোযা রাখলে আপনার মনের পশুও কুরবান হয়ে যেত। কী যে মিস করলেন!”

দুলাভাই এবার অন্য পথ ধরলেন।
” এই শুভ্র, তুমি কি প্রেম কর? প্রেম তো কর না। তোমার বয়েসী একটা সুস্থ স্বাভাবিক ছেলে ঘুরবে, ফিরবে, প্রেম করবে। তবেই না জীবনের শাশ্বত রূপ জানবে! জীবনে যে কোনো মানবীর প্রেম পায় নি সে কী করে মানবতা বুঝবে! মানুষ হতে হলে, মানুষের কষ্ট বুঝতে হলে প্রেম করতে হবে।”
হুট করে প্রেম ভালবাসার কথায় মা বাবা ভীষণ অপ্রস্তুত। তাদের আধুনিকতা মধ্যযুগীয় বর্বরতা মেনে না নেয়ার মাঝেই আটকে আছে। মেয়ের জামাইয়ের মুখে প্রেমের জয়গান শোনার মত আধুনিক এখনও হতে পারেন নি।
বাবা দুই একবার গলা খাঁকারি দিয়ে আমাদের বললেন ফ্রেশ হয়ে আসো। মা কে তাড়া দিলেন দুপুরের খাবার রেডি করতে।

প্রেম ভালোবাসা মানবতা ওখানেই শেষ।

৩.
আজ ঈদ। কসাই ভাইদের সাথে হাত লাগিয়ে সাড়ে দশটার মাঝে মাংস বানিয়ে ফেলেছি। মা গরম গরম কলিজা ভুনা আর পরটা এনে টেবিলে রেখেছেন। দুলাভাই কলিজা ভুনার পাগল। ঘ্রাণেই দৌড়ে এসেছেন ডাইনিং রুমে। আমিও তক্কে তক্কে আছি।

ভাইয়া কলিজা মুখে পুরে সেই চিরাচরিত নাটক শুরু করলেন, “আম্মা, শুভ্র কীভাবে মাংস কোপালো দেখেছেন? এগুলো কিন্তু ভাল লক্ষণ না।”

নিচে যখন মাংস বানাচ্ছিলাম, তখন হাই তুলতে তুলতে বারান্দা থেকে সেই পৈশাচিক দৃশ্য দেখেছিল ভাইয়া।
আমি জবাব দিলাম না। এই মুহূর্তে অন্য একটা কাজে ব্যস্ত আছি। এখন জবাব দেবার সময় না।

“ঐভাবে মাংস না কোপালে, বিছানা থেকে মোচড় মেরেই কলিজা ভুনা জুটতো না তোমার।”

জবাবটা আম্মুই দিয়ে দিল। সবসময় তার আবার ছেলের বদনাম সয় না।

পাশেই আপু ছিল। সে আবার স্বামীর অপমানে এক চুল ছাড় দেয় না। নিরাসক্ত অনির্বাণের আদর্শ স্ত্রী শিখা অনির্বাণ। আপুর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল আমার উপর।

“এই শুভ্র! মোবাইল গুতাচ্ছিস কেন? তোর ইসলাম কি খাওয়ার সময় মোবাইল গুতাতে বলে!”

আপুকেও জবাব দিলাম না। মোবাইলটা চুপচাপ রেখে খাওয়ায় মন দিলাম। আমার কাজ আপাতত শেষ। এতক্ষণ ফেসবুকে ব্যস্ত ছিলাম।

নিরাসক্ত অনির্বাণ আজ মর্মস্পর্শী, হৃদয়গ্রাহী স্টেটাস দিয়েছে,”সারাদেশে আজ রক্তের হোলিখেলা। আজ বিশ্ব পশু হত্যা দিবস। হে প্রকৃতিমাতা ক্ষমা কি করবে মোদের?”

এমন স্টেটাসই চাচ্ছিলাম। বেশ কয়েকটা ফটো কমেন্ট করলাম। ঈদের পাঞ্জাবি পরে পরটা দিয়ে কলিজা ভুনা খাচ্ছেন নিরাসক্ত অনির্বাণ। পাঞ্জাবিটা যে ঈদের তাতে কারো সন্দেহ নেই। “স্ত্রীর ঈদ উপহার” ক্যাপশনে আগের রাতেই সবাইকে পাঞ্জাবি দেখানো হয়ে গেছে। এমন এভিডেন্সের পর প্রকৃতিমাতার ক্ষমার আশা নেই।

৪.
পুরো ফেসবুক দুলাভাইয়ের ছবিতে তোলপাড় হয়ে গেছে। ভাইয়া আমাকে ব্লক করেছেন, কমেন্ট ডিলিট করেছেন, আগের রাতের পাঞ্জাবির ছবিটাও সরিয়ে ফেলেছেন। গরম পানি দিয়ে প্রোফাইল ধোয়া বাকি কেবল।

বন্ধু মারফত ভাইয়ার নতুন স্টেটাসের স্ক্রীনশট পেয়েছি।
” যারা ব্যক্তি আমার সাথে আদর্শিক আমাকে গুলিয়ে ফেলছে, তাদের প্রতি আমি ভয়ানক অনুভূতি শূন্য। নির্মমভাবে সবাইকে ব্লক করে দিব”

হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পড়ে যাবার দশা। অনলাইনে খেলা শেষ। এখন অফলাইনে খেলা হবে।

দুপুরে খাবার টেবিলে কথা শুরু করলাম। আমার কথায় কেউ তেমন পাত্তা দেয় না। তবে আজ শুরুই করলাম এমনভাবে যে সবাই পাত্তা দিতে বাধ্য হল।
“আমি প্রেম করব”

এটুকু বলতেই টেবিলে যেন ভূমিকম্প হয়ে গেল। সবার দৃষ্টি আমার দিকে।

“আমি জীবনের শাশ্বত রূপ বুঝতে চাই। মানবীর প্রেমে পড়ে মানবতা শিখতে চাই। অসহায়ের পাশে দাড়াতে চাই।”

“কী আবোল তাবোল বকছিস? ইসলামে না প্রেম হারাম?” আপু ধমকে উঠল। বাকিরা নির্বাক।

” সেটা তো বিয়ের আগের প্রেম। আমি বিয়ে করব। মসজিদের ইমাম সাহেব মহিলা মাদ্রাসার মুহতামিম।
সেখানে অনেক এতিম মেয়ে আছে। ইমাম সাহেবের সাথে আমার কথা হয়েছে। আজ আসরের সালাতের পরই…”
কথা শেষ না করে বাবার দিকে তাকালাম। বাবা হুংকার দিয়ে উঠলেন। আজ তোর মসজিদে যাওয়া বন্ধ!

এমন হুমকি আগেও শুনেছি। আমাকে ঘরে আটকে রাখা সোজা কম্ম নয়। আমি যে আসরের সালাত মসজিদেই পড়ব এটা সবাই জানে। তবু বাবার বৃথা আস্ফালন।

“বাবা, তুমি কি চাও সেবারের মত আজও জানালা দিয়ে বাড়ি থেকে বের হই?”

এবার বাবা ভীষণ রাগলেন। আমার উপর না, দুলাভাইয়ের উপর। এসব প্রেম ভালোবাসা মানবতার ফর্মুলা তারই আবিষ্কার কি না! হইচই চিৎকারে সারাবাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছেন বাবা। আমি চুপচাপ মজা দেখছি। ইমাম সাহেবের সাথে আমার কথা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিয়ে নিয়ে কোনো কথা হয়নি। নিজ বাড়িতে নিজেরই প্রাণ ওষ্ঠাগত। এর মাঝে কোনো এতিম মেয়েকে ঘরে তুলে তার হক্ব আদায় করতে পারব না। উলটো যুলুম হয়ে যাবে৷

বিয়ের নাম মুখে নিয়েছি কি নিই নি তাতেই এমন ম্যাজিক হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি৷ ম্যাজিকের আরো কিছু বাকি ছিল। আসরের আযান দিতেই বাবা আমাকে ডাকলেন।
“শুভ্র তোর সাথে আমিও মসজিদে যাব। একা বের হতে পারবি না”

পাহাড়া দেয়ার জন্য বাবা আমার সাথে মসজিদে গেলেন। জীবনের এই প্রথম বাবার পাশে দাড়িয়ে নামায পড়লাম। আজ আমার ঈদ!

———————————
উম্ম মারঈয়াম
২২ আগষ্ট ২০১৮