পার্ফেক্ট ম্যাচ

“গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতে ট্যালট্যালে ডাল। সাথে একটা ডিম ভাজা। ব্যস! অল্পতেই তুষ্ট যে মন, সুখে থাকতে তার যে আর কিছুই লাগে না!

ও হ্যাঁ, পাশে একজন মানুষ থাকা চাই। পরম নির্ভরতায় যার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়া যায়….”

স্ট্যাটাস পড়ে সামিরের হার্টবীট কি একটু বেড়ে গেল? যেতে পারে। বয়সটাই এমন। অল্পতেই হৃৎপিন্ডটা ধড়াক করে ওঠে।

মেইলে আসা বায়োডাটা এখনও ভালমত পড়া হয় নি। শারিকা হোসেন নাম লিখে ফেসবুকে সার্চ দিতে একদম প্রথমেই মাননীয়া হাজির।

তারপর এই স্ট্যাটাস থেকে ঐ স্ট্যাটাস নিরীক্ষণ। ব্লার করে দেয়া হিজাবি ছবিতে চেহারা বোঝার আপ্রাণ চেষ্টা। অত:পর পরম নির্ভরতার স্ট্যাটাসে এসে একদম মুখ থুবড়ে পড়া। একটা মানুষের চাওয়া এত সীমিত হতে পারে!

সামির আর দেরি করল না। রুমন ভাইকে ফোন দিল। 
ভাইয়া, প্রোফাইল ভীষণ পছন্দ হয়েছে আমার।
– প্রোফাইল?
– প্রোফাইল মানে বায়োডাটা আর কি!
– আচ্ছা। আংকেল আন্টি কে দেখাও। তোমার ভাবি শারিকার সাথে ডীল করছে। তোমার সাথে পরে কথা হবে।

ফোন রেখে সামির এবার বায়োডাটাটা ভাল করে দেখলো। বয়স একটু বেশি। কিন্তু বয়স ব্যাপার না, মনটাই আসল। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আসল কথা মাথায় আসলো। শারিকা কি তার বায়োডাটা পছন্দ করবে? অবশ্য না করার কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছে না সে। ফেসবুকে টুকটাক লেখালেখির কল্যাণে অনেকেই ওকে চিনে। হয়ত মেয়েটাও চিনে।

আসলেই তাই। শারিকা অনেক আগে থেকেই সামিরের ফলোয়ার। নিতু আপু বায়োডাটা পাঠানোর পর বাড়তি কিছু তথ্য জানতে পেরেছে এই যা! 

বাবা মা বায়োডাটা পছন্দ করেছেন। শারিকা এখনও দ্বিধান্বিত। সব ভালোই লাগছে। আবার মন কেমন কেমন জানি করছে।

নিতু আপুর সাথে কথা বলতে ফোন দিল শারিকা। কুশল বিনিময় শেষে কীভাবে কথাটা তুলবে ঠিক বুঝতে পারছিল না। নিতু আপুই উদ্ধার করলেন।

শারিকা বায়োডাটা দেখেছো? কেমন লেগেছে?
– আপু আমি বুঝতে পারছি না ঠিক…
– তাড়াহুড়ার কিছু নেই। ইস্তিখারা করে জানিও আমাকে।
– আচ্ছা আপু, ছেলে তো কুয়েটে পড়ে…
– কুয়েট না, চুয়েটে পড়েছে
– আল্লাহ আপু! চুয়েটে? মানে চিটাগং এ? র‍্যাংকিং এ কোনটা এগিয়ে? চুয়েট না কুয়েট?
– জানি না তো! র‍্যাংকিং দিয়ে কী করবে তুমি?
– না মানে অনেকে জিজ্ঞেস করতে পারে চুয়েটের র‍্যাংকিং কেমন। বোঝেনই তো আপু সমাজের অবস্থা।

– অনেকের জিজ্ঞেস করার মত সময় তো এখনও আসে নি। তোমার কি র‍্যাংকিং নিয়ে কোনো সমস্যা আছে?
– না না আপু কী যে বলেন! আমার এসব ব্যাপারে কোনো মাথাব্যাথা নেই। 
– তোমার ছেলের সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে বলতে পারো। আমি তোমার ভাইয়ার মাধ্যমে জেনে তোমাকে জানাব।
– আপু আমি আসলে খুব অল্পতেই খুশি জানেন! মা ভীষণ বকে আমার চাওয়া এত কম কেন। আমার তো একটাই চাওয়া বিয়ের পর স্বামীর সাথে হজ্বে যাব।
– মা শা আল্লাহ। খুব সুন্দর চাওয়া। আল্লাহ পূরণ করে দিক। তবে ছেলের মনে হয় এখন হজ্বে যাওয়ার সংগতি নেই।

– কী বলেন আপু! আমার তো ছোটবেলার শখ বিয়ের পর হানিমুনের বদলে হজ্বে যাব।
– হানিমুনের বদলে হজ্ব! হজ্ব তো শখের ব্যাপার না শারিকা!
– কিন্তু ছেলের সংগতি নেই কেন আপু? স্যালারি কম?
– শারিকা, এগুলো কথা তোমার বাবা আলোচনা করবেন তোমার ভাইয়ার সাথে। আমি যতদূর জানি ছেলের বউকে নিয়ে হজ্ব করার মত সামর্থ এখনও হয় নি।
– আপু তাহলে তো ওয়ালিমাও অনেক সাদামাটা হবে! একবার মাত্র বিয়ে করব…ফ্রেন্ডরা দেখলে কী বলবে?
– তোমার সাথে ছেলের বিয়ে ঠিক হলে না ওয়ালিমার প্রশ্ন। তুমি ইস্তিখারা করে আমাকে জানিও।

শারিকার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। বিয়ে নিয়ে সব মেয়ের মনেই কিছু সাধ আহ্লাদ থাকে। ইসলাম কি সাধ আহ্লাদ মেটাতে নিষেধ করে নাকি! চুয়েট থেকে পাশ করে কী ছাতার চাকরি করছে আল্লাহই জানেন। চুয়েটের র‍্যাংকিংটা একবার জানতে পারলে ভাল হত। সে নিজে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়েছে। আগে যখন জাহেল ছিল তখন বুয়েটের পাত্র ছাড়া কিছু ভাবতেই পারতো না। এখন এসবে ছাড় দিতে শিখেছে। তাই বলে এত ছাড়! সে তো আর বাড়ি গাড়ি ব্যাংক ব্যালেন্স চাচ্ছে না…!

সামির মেয়ের সাথে দেখা করতে আগ্রহী। কিন্তু শারিকা সময় নিল এক সপ্তাহ। এর মাঝে ক্লোজ ফ্রেন্ডদের সাথে অনেক আলোচনা পর্যালোচনা হয়ে গেছে। পক্ষে বিপক্ষে যে যা বলছে তাতেই যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। শেষমেষ দেখা করার সিদ্ধান্ত হল। অনেক মাধ্যম ডিংগিয়ে কথা চালাচালির থেকে সরাসরি দেখা করা ভাল। 

এই ক’দিন সামিরের খুব কঠিন সময় গেছে। ফেসবুকে সে সবসময় বলে এসেছে একটা মেয়ের চেহারা কোনো ব্যাপার না, দ্বীন টাই আসল। তারপরও কেন যে সেই ব্লারি হিজাবি ছবিটা নিয়ে তুমুল গবেষণা! এর থেকে দেখা করলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়!

অবশেষে দেখা হল দুজনার। পাশার দানও উলটে গেল। এক দেখাতে শারিকা পছন্দ করে ফেলল সামিরকে। চাকরি, র‍্যাংকিং কিছু নিয়েই আর দ্বিধা নেই। ফেসবুকের মত বাস্তবেও ছেলেটা বেশ সুন্দর করে কথা বলে। তাছাড়া কোথায় পড়েছে, কী জব করছে এসব এমন কোনো বড় ব্যাপার না। একজন মানুষের আখলাকই আসল। 

কিন্তু সামিরের মন সায় দিল না। সেই ঝাপসা মুখখানা দেখে মানসপটে যে ছবি এঁকেছে তার সাথে মিললো কই! হ্যাঁ, এখনও সে মনে করে চেহারা ব্যাপার না। দ্বীনটাই আসল। কিন্তু মেয়েটা কেমন দ্বীনদার যে প্রোফাইলে নিজের মুখের ছবি দিয়ে রাখে!
রুমন ভাইয়ের সাথে কথা হল। ভাই ভীষণ রেগে গেছেন ওর উপর।

সামির, তুমি আগে কেন বললে না মেয়েটা ফেসবুকে ছবি দিয়ে রেখেছে? দেখা করতে গেলে কেন?
– ভাইয়া আমার ভুল হয়েছে। কিন্তু এখনও তো ভুল শোধরানোর সময় শেষ হয়ে যায় নি। তাছাড়া আমার আম্মু ফর্সা মেয়ে পছন্দ করে।

– বিয়ে কে করছে? তুমিই না বলেছিলে তোমার পছন্দের উপর ফ্যামিলির কোনো কথা নেই?
– ভাইয়া আসলেই তাই। কিন্তু আমার ভাবি ফর্সা। আমার স্ত্রী যদি ফর্সা না হয়, মা তো দুইজনকে সমান চোখে দেখবেন না।
– তুমি তাহলে দেখা করতে গেলে কেন কালো ফর্সা না জেনে?

– ঐ প্রোফাইল পিকচারের ছবিতে ফর্সা লাগল, তাই না দেখা করতে রাজি হলাম! ভাইয়া তাও কোনো সমস্যা ছিল না। দ্বীনদারিতা কম সেটাও না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু আমাদের ফ্যামিলিতে সবাই হাইলি এডুকেটেড। মাস্টার্স ছাড়া কেউ নেই। আমার ভাবি এখন এমফিল করছেন…এই অবস্থায় একজন অনার্স পাশ মেয়ে ফ্যামিলিতে মানিয়ে নিতে পারবে বলেন?

রুমন ভাই আর কথা বাড়তে দিলেন না। কড়া গলায় বললেন, স্পষ্ট করে একটা কথা বল। এই প্রোপোজাল আগাবো নাকি না করে দিব?
সামির মিনমিন করে না করে দিল।

পাত্র পক্ষের ফীডব্যাক অবশ্য শারিকা পর্যন্ত পৌঁছাতে হল না। ঘটনা একটু জটিল, কিন্তু দুই পক্ষের জন্যই হজমযোগ্য। এক বান্ধবীর কথা শুনে শারিকার মন আবার ডিগবাজি খেয়েছে। মিষ্টি কথা আর একদিনের আখলাক্ব দেখে মানুষ চেনা যায় না। বুয়েট কিংবা ঢাকা ইউনিভার্সিটি ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কথা ভাবছে কী করে শারিকা! কুফু মিলতে হবে না? 
বান্ধবীর কথায় যুক্তি আছে। যেনতেন নয়, একেবারে অকাট্য ইসলামিক যুক্তি। 

নিতু যখন ভাবছিল ওকে কী করে পাত্রপক্ষের রিজেকশনের কথা বলবে, তখন শারিকাই না করে দিল। কুফু মেলে নি, বিয়ে হবে কী করে! 

নিতু আর রুমন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কোনো পক্ষই অপর পক্ষের রিজেকশনের কথা জানল না, জানল কেবল ঘটকরা।

সামির নতুন উদ্যোমে পাত্রী দেখা শুরু করেছে। অবশ্যই রুমন ভাইয়ের মাধ্যমে না! এর মাঝে তিনটা পাত্রী দেখা হয়ে গেছে। দুইজন ফর্সা। একজন মাস্টার্স পাশ। কিন্তু বয়স একটু না, অনেক অনেক বেশি। 

একজনের মোটামুটি অনেক কিছুই ভাল লেগেছে। অন্তত ফ্যামিলির সাথে যাবে। ফর্সাও আছে, কিন্তু চেহারায় কোমলতা বলে কিছু নেই। অদ্ভুত রকমের কাঠিন্য চেহারায়। রাতে সামিরের ঘুম হয় না ঠিকমত।

গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত দেখলেও শারিকার কথা মনে পড়ে। সব মেয়েদের সাথে সেই ব্লারি ছবি মেলাতে ইচ্ছে করে। একদিনের দেখায় যে মুখ দেখেছে তাতে কি ভুল থাকতে পারে না? ফর্সা না হলেও শারিকার চেহারায় একটা স্নিগ্ধতা ছিল। অস্বীকার করার উপায় নেই।
বেশ কয়েকটা বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে সামিরের মনে হল তার পছন্দের উপর ফ্যামিলির কোনো কথা থাকতে পারে না। এরপর রুমন ভাইকে ফোন দিয়ে হড়বড় করে যা বলল তার ভাবানুবাদ রুমন ছাড়া অন্য কেউ করতে পারতো না। গত পাঁচ বছরে বারোটা বিয়ে দিয়ে রুমন ঠিকই বুঝেছে সামির কী বলতে চায়।

ঝামেলা এখন পোহাতে হবে নিতুকে। শারিকাকে কুফুর মারপ্যাঁচ থেকে বের করে এনে আবারও সামিরের প্রস্তাব উত্থাপন…ঝামেলা বটে!

কিন্তু পরম করুণাময়ের অসীম দয়া ছিল নিতু আর রুমনের উপর। শারিকা এতদিনে বুয়েট ডিইউ চষে একটা পাত্রও খুঁজে পায়নি। যে বান্ধবী পরামর্শ দিয়েছিল সে দিব্যি সুখে ঘর সংসার করছে। আর শারিকা কুফু মেলাতে কুংফু লড়ছে! এভাবে চলা যায় না। তাছাড়া আখলাক আর দ্বীনই তো আসল!
সেদিন নিতুর ফোন পেয়ে শারিকাও হড়বড় করল ঠিক সামিরের মত।

পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতায় নিতুরও বুঝতে বেগ পেতে হয়নি। তবু মানুষ মাত্রই ভুল। তাই মুখ ফসকে বলে ফেলল, তোমার ভাইও বলছিলো বিয়েটা হলে ভালই হত। দু’জনের খাসলত একই রকম!
– খাসলত? 
– না মানে তোমাদের দুজনের আচার আচরণ, ফ্যামিলি স্ট্যাটাস খুব সুন্দর মিলে যায়।
খাসলতের ব্যাখ্যা শারিকার মন:পুত হয়েছে সে-ও খুশি, নিতুও খুশি।

পরবর্তী ঘটনা বেশ দ্রুত ঘটল। নিতু রুমনের তত্ত্বাবধানে বিয়েটা হয়ে গেল। সত্যিই এই পাঁচ বছরে ওরা এমন জুটি পায় নি! একেবারে পার্ফেক্ট ম্যাচ!

——————————-
পার্ফেক্ট ম্যাচ
আনা আমাতুল্লাহ
(৩ মার্চ ২০১৮)