প্রশ্নপত্র ফাঁস

২০১৪ সালের কথা। এইচএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়ার জন্য আদা জল খেয়ে নেমেছি। আমি ছিলাম কলেজের সেকেন্ড বয়। আর পলাশ ফার্স্টবয়। ও গতানুগতিক ফার্স্টবয়দের মত উন্নাসিক ছিল না। সবার সাথে মিশত, হই হুল্লোড় করত। নিজ হাতে নোট বানিয়ে সবাইকে বলত, “নোট রেডি, কে কে ফটোকপি করবি কর”। 

এ কারণে ওকে আমার ঠিক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হত না। তবে একটা ব্যাপারে আমরা, মানে যারা হোস্টেলে থাকতাম তারা সবাই একমত ছিলাম যে আমরা পলাশের সাথে মিশি না, পলাশই আমাদের সাথে মিশে। এত হই হুল্লোড়ের মাঝেও পলাশ তার চারপাশে প্রাইভেসির একটা বলয় তৈরি করে রেখেছিল। ঈদ পূজার বন্ধে আমরা পালা করে বন্ধুদের বাড়িতে ঘুরতে যেতাম। পলাশ যেত না। 

পলাশকে বলতাম এবার তোদের বাড়িতে ঈদ করব। ও হেসে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলত। আমার রুমমেট সাজিদ বলেছিল পলাশ মনে হয় নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে। এরা নানারকম কমপ্লেক্সে ভোগে। হয়ত নিজের বাড়িতে কাউকে নেয়ার সঙ্গতি নেই তাই অন্যের বাড়িতেও যেতে চায় না।আমার কাছে অবশ্য সেরকম কিছু মনে হয়নি। কেন মনে হয়নি তা বলতে পারব না। 

যাই হোক, এইচএসসি পরীক্ষার ঘটনায় ফিরে যাই। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে সেবারই প্রথম মুড়ি মুড়কির মত সব জায়গায় প্রশ্ন পাওয়া যাচ্ছিল। এত গোপনীয়তা, কড়া নিরাপত্তা সত্ত্বেও কীভাবে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে আমি জানতাম না। জেনেছি অনেক পরে। তবে প্রশ্ন সবার হাতে হাতে পৌঁছে দেয়ার কাজে আমি জড়িত ছিলাম। আচ্ছা, ঘটনাটা খুলেই বলি।

পরীক্ষার কিছুদিন আগে হোস্টেলের বারান্দায় বসে কেমিস্ট্রি পড়ছি। রাত ১২টার পর রুমমেট সবাই ঘুমিয়ে যায়। তাই বারান্দায় টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে বসেছি। জৈব যৌগতে আমি বরাবরই কাঁচা। পলাশ আবার জৈব যৌগের বস। সে কীভাবে যেন কিছু চার্ট বানিয়েছে যেগুলোতে চোখ বুলালেই জৈব যৌগের সব চ্যাপ্টার সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা হয়ে যাবে। এমনি এমনি হবে না, ট্রিকস জানতে হবে।

ভাবছিলাম পলাশ যদি এখন বারান্দায় আসত, তাহলে ট্রিক্স জেনে নিতে পারতাম। ভাবতে না ভাবতেই পলাশ হাজির। আমার বই খাতা সব বন্ধ করে দিয়ে বলল, “এখন পড়া বাদ দে। জরুরী কথা আছে।”

– “কী কথা?”

– “তুই ফেসবুকে একটা পেইজের এডমিন না?”

– “হ্যাঁ। কিন্তু পরীক্ষার সময় আমি ফেসবুকে যাই না। একবার ফেসবুকে ঢুকলে আর বের হতে ইচ্ছে করে না।”

– “এবার ফেসবুকে যাবি। প্রতি পরীক্ষার আগেরদিন ফেসবুকে যাবি।”

– “কী বলছিস এসব! তোর মাথা ঠিক আছে?”

-” মাথা ঠিক আছে। যা বলছি মনযোগ দিয়ে শোন। আমি তোকে ঢাকা বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন এনে দিব। তুই প্রতি পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্নগুলো পেইজে পোস্ট করে দিবি।”

– “প্রশ্ন তুই কোথায় পাবি?”

– ‘এটা তোর জানা লাগবে না। তোকে বিশ্বাস করি বলে তোকেই এই কাজ করতে বললাম। নইলে সাজিদেরও তো পেইজ আছে। ওখানে ৬ হাজার লাইক। ওকেই তো বলতে পারতাম!”

– “আচ্ছা ঠিক আছে। প্রশ্ন না হয় পাওয়া গেল। কিন্তু সবাইকে বিলিয়ে দিতে হবে কেন? আমি প্রশ্ন পেলে কখনোই কাউকে দিতাম না।”

– “এখানেই তোদের সমস্যা। তোরা শুধু নিজের কথা ভাবিস। তুই ঢাকার সবচেয়ে নামকরা কলেজের সেকেন্ড বয়। তোর প্রশ্নের কী দরকার? আমার প্রশ্নের কী দরকার? আমাদের কোনো দরকার নেই। কিন্তু যাদের পাশ ফেইল নিয়ে টানাটানি তাদের দরকার আছে। এদের খুঁজে খুঁজে বের করা সম্ভব না। তুই ফেসবুকে প্রশ্ন দিয়ে দিলে ওরা নিজে থেকেই খুঁজে নিবে।”

– ‘কিন্তু গোল্ডেনরাও যে পেয়ে যাবে?”

– “পেলে কী সমস্যা? এইচএসসিতে কি কোটা আছে? তুই এ প্লাস পেলে আমি পাব না, এরকম?”

– “না, তা বলছি না। কিন্তু…”

– “মন বড় করতে শেখ। ভেবে দেখ তোর পেইজে প্রশ্ন দিলে রাতারাতি পেইজের লাইকসংখ্যা বেড়ে যাবে। আজকের রাতটা ভেবে দেখ।”

পেইজের লাইকসংখ্যার কথা শুনে আমার ভেতরে কী যেন হয়ে গেল। আমি আর ভাবলাম না। রাজি হয়ে গেলাম। পলাশকে বললাম, “আমি তোর সাথে আছি। মানুষের উপকারে তো দোষের কিছু নেই। আসলে স্রোতের বিপরীতে চলতে শিখিনি এখনও। তুই যা বলবি তাই হবে।”

এরপর থেকে পলাশ প্রতি রাতে আমাকে প্রশ্ন দেয়, আমি ফেসবুকে আপলোড করে দেই। কমেন্টে মানুষ দোয়ার বন্যা বইয়ে দেয়। ওদের দোয়াতে আমার এক্সামগুলোও বেশ ভাল হচ্ছিল। 

ভাগ্য ভাল ফ্রেন্ডরা কেউ জানে না যে এই পেইজের এডমিন আমিই। এক একটা পরীক্ষা শেষ হয় আর বন্ধুরা উল্লাস করতে করতে হল থেকে বের হয়। ওদের উল্লাসে শুধু দোয়া আর দোয়া। হে আল্লাহ অমুক পেইজের এডমিনকে বেহেশতে নসীব কইরো। নেক সন্তান দিও। ভাল সুন্দরী বউ দিও। আমিও দোয়ায় শামিল হই। নিজের জন্য দোয়া আমি করতেই পারি!

আসলে দিনগুলো ভালই কাটছিল। দীর্ঘমেয়াদী বোর্ড পরীক্ষা দেয়ার যে বিরক্তি, সেটা আমাকে একেবারেই স্পর্শ করছিল না। তবে কথায় আছে না, সুখে থাকতে ভুতে কিলায়? আমাকে ভুতে কিল দিল। সারাক্ষণ মাথায় একটাই চিন্তা পলাশ কী করে প্রশ্ন পায়? প্রশ্ন-ফাঁস রোধে প্রশাসনের আন্তরিকতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাহলে পলাশ কী করে সব ম্যানেজ করছে? এর মাঝে পলাশকে আমি দুই তিনবার এই প্রশ্ন করে ফেলেছি। 

প্রথম প্রথম পলাশ কিছু বলেনি। শেষবার সে ভীষণ রেগে গেছে। আমাকে রীতিমত হুমকি দিয়েছে আর যদি এ কথা জিজ্ঞেস করি তাহলে সে আর আমাকে প্রশ্ন দিবে না। প্রশ্ন না পেলে আমার পেইজের অবস্থা কী হবে ভেবে চুপ হয়ে গেছি। কিন্তু মনকে মানাতে পারি না। মাথার ভেতর শুধু ঐ একই কথা কুটকুট করে। একটা বিহিত না করলে এর প্রভাব এক্সামের উপর গিয়ে পড়বে। পুরো ফেসবুকবাসীর দোয়াতেও কাজ হবে না তখন।

ভেবে চিন্তে ঠিক করলাম গণিত প্রথমপত্র পরীক্ষার আগেরদিন পলাশকে চোখে চোখে রাখব। ওকে বুঝতে দেয়া যাবে না কিছুতেই। এর মাঝে বেশকিছু পরিকল্পনা আঁটলাম। কীভাবে কী করলে পলাশ বুঝতে পারবেনা আমি ওর পিছু নিয়েছি তা নিয়ে বেশ চিন্তা ভাবনা করলাম। ভাবতে ভাবতে আবিষ্কার করলাম আমার চিন্তা ভাবনার গভীরতা ব্যাপক। নিজেকে এতদিন অবমূল্যায়ন করে এসেছি, অথচ আজ মনে হচ্ছে পলাশের থেকেও আমি বেশ বুদ্ধিমান। 

অনেক অপেক্ষার পর অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এল। সেদিনের কথা আমি জীবনেও ভুলতে পারবো না। পরীক্ষার আগেরদিন রাতের খাওয়া শেষে পলাশের পিছু নিলাম। আমার মন বলছিল পলাশ এখনই প্রশ্নের ব্যবস্থা করবে। আসলেও তাই।

আমার সিক্সথ সেন্সও বেশ প্রখর সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম পলাশ হোস্টেলের বাইরে যাবে। কিন্তু না, আমাকে অবাক করে দিয়ে ও সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠল। ছাদের চাবি ওর কাছে আছে এতদিন জানতামই না! অবশ্য ওর ব্যাপারে কত কিছুই তো জানি না, ছাদের চাবি তো মামুলি ব্যাপার! 

আমি দূরে দূরে থাকছি যাতে পলাশ টের না পায়। ওর হাবভাবে মনে হচ্ছে ও আমার উপস্থিতি একেবারেই বুঝতে পারেনি। আপনমনে হাঁটতে হাঁটতে ছাদের কিনারায় চলে গেল। এখন আমার বেশ ভয় করছে। ছাদের কিনারায় কেন? সুইসাইড করবে না তো? 

সাজিদ বলেছিল নিম্নবিত্তরা অনেক কমপ্লেক্সে ভোগে। কমপ্লেক্সের কারণে যদি সুইসাইড করে বসে? আমার কি ছাদ থেকে নেমে যাওয়া উচিৎ? নাকি ওকে থামানো উচিৎ? মন একবার বলছে পালিয়ে যা, আরেকবার বলছে এই ছেলেটা সবার জন্য এতকিছু করে, ওকে রেখে চলে যাবি? কিন্তু শরীর নড়ছে না। পায়ের নিচে যেন শিকড় গজিয়ে গেছে।

ঐ অবস্থাতেই প্রশ্ন-ফাঁসের আসল রহস্য দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে। পলাশ অন্ধকারে হাত বাড়ালো। ওর হাত লম্বা হতে থাকল, হতে থাকল, হতে থাকল…। আর আমি জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান ফিরল রাত ১২টার দিকে।

সিড়িঘরে পড়ে আছি। হাতে দুমড়ানো প্রশ্ন। গণিত প্রথমপত্র প্রশ্ন। প্রশ্নের নিচে চির পরিচিত পলাশের হাতের লেখাঃ 

“তোকে আগেই বলেছিলাম, কীভাবে প্রশ্ন পাই জানতে চাইবি না। অতিরিক্ত কৌতুহলে গণিত দ্বিতীয়পত্রের প্রশ্নটা হারালি, আমাকেও হারালি। ভাল থাকিস।”

আমি টলতে টলতে নিচে নেমে এলাম। হাতে সময় নেই। ফেসবুকে নিশ্চয়ই এতক্ষণে প্রশ্নের জন্য গালিগালাজ শুরু হয়ে গেছে। আমার পেইজ বাঁচাতে হবে। বাকি চিন্তা পরে করলেও হবে।

পরদিন পরীক্ষা কীভাবে দিয়েছি নিজেও বলতে পারব না। প্রথমপত্র পরীক্ষা শেষে আসল চিন্তা মাথায় আসল। দ্বিতীয়পত্রের প্রশ্ন কীভাবে ম্যানেজ করব? ওদিকে হোস্টেলে কলেজে একটাই আলোচনা পলাশ কই? ও আজ পরীক্ষা দেয়নি।

হোস্টেলে ওর রুম একদম ফকফকা। জিনিসপত্র কিছু নেই, পলাশও গায়েব। সবাই ঘুরেফিরে আমাকেই জিজ্ঞেস করছে পলাশ তো আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড। আমি কিছু জানি কিনা। স্যাররাও আমাকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে। এক স্যারের সাথে কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছি। পলাশের দুঃখে নাকি নিজের বোকামির দুঃখে তা আমি আজও জানি না। তবে কান্নাকাটি বেশ কাজে দিয়েছিল।

স্যার নাকি পরে সব ছাত্রকে বলে দিয়েছিল আমাকে পলাশের ব্যাপারে কিছু যেন জিজ্ঞেস না করে। এক পলাশ গেছে তো গেছেই, এখন যদি আমিও দুঃখের চোটে এক্সাম খারাপ দেই তাহলে কলেজের মান সম্মান ডুববে।

দ্বিতীয়পত্র পরীক্ষার আগের দিন। ক্যালকুলাস বলবিদ্যা সব আমার নখদর্পণে। পড়ালেখা নিয়ে আর চিন্তা করি না। আমার একমাত্র চিন্তা কীভাবে দ্বিতীয়পত্র প্রশ্ন যোগাড় করব। প্রশ্ন আপলোডের সময় এগিয়ে আসছে। কিন্তু আমার মাথা কাজ করছে না। শেষমেষ টেস্ট পেপারে ঘেঁটে একটা অখ্যাত কলেজের প্রশ্ন বের করে পোস্ট করে দিলাম। কালকে যে গালির বন্যা বয়ে যাবে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আপাতত ঠ্যাকার কাজ চালাই। পরের চিন্তা পরে।

পরদিন পরীক্ষা দিলাম। আমার পরীক্ষা ভালই হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগের অবস্থাই শোচনীয়। এবার আর কেউ পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল না। হলের ভেতরেই অমুক পেইজের এডমিনকে গালি দিতে লাগল। আমি গালিতে শামিল হলাম না। ওইদিনের পর নিজেকে আমি অনেক গালি দিয়েছি। আর না। কেউ কেউ শিক্ষামন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলল ওস্তাদের মাইর শেষ রাইতে। ক্যামনে কইরা শেষ পরীক্ষায় প্রশ্ন-ফাঁস আটকায় দিল!

ওরা জানে না। আমি জানি প্রশ্ন ফাঁসে তাঁর কোনো হাত ছিল না, প্রশ্ন ফাঁস রোধেও তাঁর কোনো হাত ছিল না। হাত ছিল পলাশের। অনেক লম্বা হাত।

প্রশ্নপত্র ফাঁস
আফিফা আবেদীন সাওদা
(২৬ নভেম্বর ২০১৭)