ওয়াসিয়াহ নামা

সংসারের নানান ব্যস্ততায় আর নিজের ব্যক্তিগত অলসতায় ভালো করে একটা লেকচার শোনা হচ্ছিল না অনেকদিন। সেদিন তাই বেশ মনোযোগ দিয়ে শেইখ মঞ্জুর এলাহী সাহেবের ওয়াসিয়াহ্ বিষয়ক একটা লেকচার শুনলাম। গতানুগতিক ধারার যেটা প্রচলিত বা যা সাধারণ মানুষের ধারণা এই ওয়াসিয়াহ নিয়ে , আমারও ধারণা তেমনি ছিল। অর্থাৎ আমি ভাবতাম অংশনামা , উইল বা ওয়াসিয়াহ একই কথা।

আমাদের দেশে ওয়াসিয়াহ কে অবশ্য ওসিয়ত বলে। কিন্তু আমি যেটা জানলাম আর যা জানতাম তার বিস্তর পার্থক্য খুঁজে পেলাম। অংশনামা / উইল এ উত্তরাধিকার গণ ব্যক্তির মৃত্যুর পর কে কত টুকু সম্পদের অংশ পাবেন সেটা উল্লেখ থাকে, যেটা ইসলামে নিষিদ্ধ। মৃত্যুর আগে কখনই অংশ ভাগাভাগি করা ইসলামের দৃষ্টিতে সম্মত নয়। বরং শরীয়াহ্ অনুযায়ী যার যতটুকু প্রাপ্য সে ততটুকুই পাবে আর সেভাবেই সম্পত্তি ভাগ হওয়া আল্লাহ্ ভীতির নিকটবর্তী।

ওয়াসিয়াহ , অংশনামা বা উইল নয়; এটা হল ইচ্ছা নামা। লিখিত ওয়াসিয়াহ ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার আপনজনদের জন্য একটা অতি মূল্যবান দলিল হিসেবে কাজ করতে পারে। ওয়াসিয়াহ তে মোট সম্পদের ১/৩ অংশ বা তার কম কাউকে বা কোন প্রতিষ্ঠানকে বা আল্লাহের পথে দিয়ে যাওয়ার অপশন রয়েছে। তবে এই ১/৩ অংশ বা তার কম সম্পত্তি কোন উত্তরাধিকার দের দিয়ে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করা যাবে না। অর্থাৎ ওয়াসিয়াহকৃত সম্পদ যারা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পর্কিত নয়, শুধু তারাই পেতে পারে বা তাদের দিয়ে যাবার ব্যাপার ওয়াসিয়াহ নামা তে উল্লেখ থাকতে পারে। এছাড়া ব্যক্তির দাফন সংক্রান্ত , মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যদের উপদেশ প্রদান, ব্যক্তির কোন ঋণ থাকলে তার পরিমাণ, কারো আমানত থাকলে তার উল্লেখ ইত্যাদি বিষয়াদি ওয়াসিয়াহ নামা তে উল্লেখ থাকতে পারে। আমাদের প্রত্যেকেরই নিজেদের ওয়াসিয়াহ নামা তৈরি করে রাখা প্রয়োজন। কারণ মৃত্যু যে কোন সময়ই এসে উপস্থিত হতে পারে। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি ও মৃত্যুর কথা স্মরণ মানুষকে ভাল কাজে উদ্বুদ্ধ করে। নিজের হিসাব নিজেই নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়।

নিম্নে ওয়াসিয়াহ নামার একটা শরীয়াহ্ সম্মত নমুনা সংযোজন করা হল। আশাকরি আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন আমাদের সবাইকে দ্বীনের পথে চলার, দ্বীনের কথা বলার ও শোনার তৌফিক দান করেন আমীন।

নমুনা:

বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম

ওয়াসিয়াহ (ইচ্ছানামা)

আস্সালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। ইন্নাল হামদুলিল্লাহ রাব্বিল আলামিন ওয়াস্সালাতু ওয়াস্সালামু আলা রাসূলিল্লাহ (সা) , অতঃপর:

আমি ——————————————————————————,

পিতা ——————————————–

ঠিকানা : ——————————————————————————————————————————
এই বলে সাক্ষ দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই , তিনি একক , তাঁর কোন শরিক নাই। আমি আরো সাক্ষ দিচ্ছি , মুহাম্মদ (সা) তাঁর বান্দা ও রাসূল।
আমি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় , কোন প্রকার বাহ্যিক চাপ বা প্রভাব ব্যাতিত এই ওয়াসিয়াহ প্রকাশ করছি। এই ওয়াসিয়াহ আমার স্ত্রী/স্বামী , সন্তান , আত্মীয় এবং প্রিয় মুসলিমদের উদ্দেশ্যে লিখছি।

১. আমার মৃত্যু সংবাদ শোনা মাত্র সকলেই আমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও রহমত কামনা করে দোয়া করবেন। আমাকে আন্তরিকভাবে ক্ষমা করে দিবেন। কাউকে জেনে , না জেনে, বুঝে – না বুঝে কষ্ট দিয়েছি, গীবত করেছি। আল্লাহের দরবারে আমার বিরুদ্ধে বিচার দিয়েন না , ক্ষমা করে দিয়েন ইনশা আল্লাহ।

২. আমার মৃত্যুর পর আমার মৃতদেহে যেন কোন প্রকার কাটাছেঁড়া বা পোস্ট মর্টেম না করা হয়। আমি আমার পরিবারের সকল সদস্য , আত্মীয় স্বজন ও শুভাকাঙ্খীদের বলছি , আমার মৃত্যুর পর যেন অতি শোকে উচ্চস্বরে কান্নাকাটি করা না হয়। কেননা মৃত্যু একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। আল্লাহ বলেন , ” প্রত্যেককে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। ” ( সূরা আম্বিয়া :৩৫)

৩. আমার মৃত্যুর পর মরদেহ ধৌত করার জন্য সম্ভব হলে আমার স্বামী/স্ত্রী —————————————————————— নিজেই অথবা উনি অপারগ হলে ————————————————————————————কে দায়িত্ব দেওয়া হল। কিংবা আমার মৃত্যুর স্থান অনুযায়ী তারা যেন দ্বীনের সহীহ সুন্নাহ অনুযায়ী নিয়মকানুন জানা কোন ব্যক্তি/ আলেম/ আলেমা কে অনুরোধ করেন। আমার দাফন যেন যত দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন করা হয়। কোন আত্মীয় স্বজন , বন্ধু -বান্ধবের উপস্থিতির জন্য যাতে অপেক্ষা করা না হয়। এ ব্যাপারে আমি আমার আত্মীয় স্বজন এবং সকল কে অনুরোধ করছি , মৃতকে একনজর দেখে আত্মতৃপ্তির যে রেওয়াজ প্রচলন আছে , সেই প্রচলন থেকে বের হয়ে আসার জন্য। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা) এর নির্দেশ হচ্ছে তাড়াতাড়ি দাফন কাজ সম্পন্ন করা।

৪. আমার মৃত্যু উপলক্ষে যেন পরিবার , চাকুরিস্থল , এলাকাবাসী, রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক কোন দেশ বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোন সম্মাননা অনুষ্ঠান ,স্মরণ /সুনাম সভা অথবা আলোচনা সভার কোন ব্যবস্থা না করা হয়। আমি অসুস্থ থাকাকালীন আমার পাশে বা আমার মৃত্যুর পর মরদেহের পাশে বা দাফনের পর কবরের পাশে কুরআন বা কুরআনের বিশেষ কোন সূরা পাঠ , অথবা কুরআন খতম, কালেমা খতম ইত্যাদি যা রাসূলুল্লাহ (সা) বা সাহাবী (রা) এর সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয় , এরূপ কোন কাজ যেন না করা হয়। আমার মৃত্যুর সময় যদি কেউ পাশে থাকেন , তিনি যেন আমাকে আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ দেওয়ার জন্য অনবরত উৎসাহ প্রদান করেন।

৫. আমার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বা আমার পারলৈকিক কল্যাণের কথা ভেবে , অর্থ, খাদ্য বা অন্য কোনো অনুগ্রহের বিনিময়ে দোয়া,যিয়াফত, কুলখানি , মিলাদ, ৪দিন, ৭ দিন , চল্লিশা ,মৃত্যুবার্ষিকী , মাজার জিয়ারত ইত্যাদি যেন আয়োজন করা না হয়। তবে কোন ব্যক্তি স্বপ্রণোদিত হয়ে রাসূল (সা) এর সুন্নাহ মেনে আমার জন্য আল্লাহের কাছে দুআ করতে পারেন। যদি আমি ঢাকায় মারা যাই তাহলে যেন আমাকে ———————————————————————————– জায়গায় দাফন করা হয়। আর যদি অন্যত্র মৃত্যু হয় তাহল————————————-জায়গায় দাফন করে দেয়া হয়। আমার কবরে যেন কোন প্রকার বাঁধাই , সমাধি ফলক নির্মাণ বা স্থাপন করা না হয়। কবরে যাতে পুষ্পস্তবক , আগরবাতি , মোমবাতি ইত্যাদি দেওয়া না হয়। সম্মান প্রদর্শন , কৃতজ্ঞতাবোধ, স্মৃতিচারণ বা অন্য কোন কারণে আমার কোন ছবি , মূর্তি বা স্মরণিকা যাতে স্থাপন করা না হয়।

৬. আমার জানা মতে , আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা নিম্নলিখিত স্থাবর / অস্থাবর সম্পত্তি আমার তত্ত্বাবধায়নে রেখেছেন :

ক ————————————————————————————

খ ————————————————————————————

গ ———————————————————————————–

ঘ ————————————————————————————

রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে প্রথমে আমার দাফন ও জানাজার খরচ মিটাতে হবে। অতপর আমার ——————————– ঋণ আছে। তা পরিশোধ করতে হবে। আমার ———————————————————————————————- যাকাত বকেয়া আছে তা পরিশোধ করতে হবে। আমার কাছে ————————————————————————————
————————————— আমানত গচ্ছিত আছে , তা তাদের দিয়ে দিতে হবে।

৭. মৃত্যুর সময় রেখে যাওয়া সম্পত্তির ( ১/৩ অংশ ) নিম্ন লিখিত খাতে যেন ব্যয় হয় :

ক ————————————————————————-

খ ————————————————————————-

গ —————————————————————————

ঘ ————————————————————————-

৮. অবশিষ্ট সম্পত্তি আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহ মোতাবেক ওয়ারিশদের মধ্যে বন্টন করতে হবে। এক্ষেত্রে আমার স্বামীর/ স্ত্রীর প্রতি অনুরোধ রইলো ,তিনি যেন ———————————————————————– এর সাথে পরামর্শ করে ইসলামী শরীয়ত মত ওয়ারিশদের মধ্যে বন্টনের ব্যবস্থা করেন। বন্টনের ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করবেন। মনে রাখবেন এই সম্পদ আমার সাথে যেমন যাবে না তেমনি আপনাদের সাথেও যাবেনা। আর রিজিকের ব্যাপারে আল্লাহের উপর ভরসা করুন। আল্লাহই সর্বোত্তম রিজিকদাতা।

৯. আমার অবর্তমানে ————————————————-, ——————————————————-আমার স্ত্রীর / সন্তানদের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করবেন।

১০. আমার সন্তানদের বলছি , যেকোনো মূল্যে নিজের ঈমানকে নষ্ট হতে দিবে না। আল্লাহর দেওয়া কুরআন ও রাসূলের (সা) সুন্নাহ কে আমৃত্যু আঁকড়ে ধরে থাকবে। কোন ধরণের লোভ-লালসা, দুনিয়ার মোহাব্বত যেন তোমাদের ইসলাম থেকে দূরে ঠেলে না দেয়। সালাত কায়েম রাখবে , যাকাত দিবে পাই পাই হিসাব করে , রামাদানে রোজা রাখবে, হজ্জ্ব পালন করবে ইনশা আল্লাহ। আল্লাহের রাসূল (সা) বলেছেন যে মিজানের পাল্লায় সবচেয়ে ভারী হবে সুন্দর চরিত্র। অতএব , সুন্দর আচরণ চর্চা করবে, বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করবে। সালাম প্রতিষ্ঠা করবে। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে না। তোমাদের বাবা/ মা এর যত্ন নিবে। তার কথা যদি ইসলাম কে অগ্রাহ্য করার মত না হয় তাহলে মান্য করবে।

সদা সর্বদা আল্লাহ কে ভয় করে চলবে। কারণ তুমি তাঁকে না দেখলেও তিনি তোমাদের ঠিকই দেখছেন। আল্লাহ তোমাদের নেক হায়াত দেন , রিজিকে বারাকাহ দেন , ঈমান ও আমলে বারাকাহ দেন আর তোমাদের আমার জন্য সাদাকায়ে জারিয়া হিসেবে কবুল করেন ইনশা আল্লাহ।

১১. আমি আল্লাহের দেওয়া অসংখ্য নিয়ামতের জন্য বিশেষ করে আমার হিদায়াতের জন্য শুকরিয়া আদায় করছি। আমার কারো প্রতি কোন রাগ , ক্ষোভ বা অভিযোগ নেই এবং সবাইকে আমার পক্ষ থেকে ক্ষমা করে দিলাম। একই ভাবে আমাকেও ক্ষমা করে দেওয়ার অনুরোধ করে গেলাম। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাঁর একত্ববাদের উপর বিশুদ্ধ ঈমান সহ পৃথিবী থেকে প্রত্যাবর্তন করার সৌভাগ্য দান করেন। আমিন

তারিখ :————————————————————————–

নাম :—————————————–

সাক্ষীগণ :

১# নাম : ——————————————————-

পিতা :——————————————————

ঠিকানা :————————————————–

তারিখ :————————————————–

২# নাম :————————————————–

পিতা : —————————————————

ঠিকানা : ——————————————————

তারিখ: ———————————————————-

বি.দ্র: ওয়াসিয়াত করা সম্পত্তি উত্তরাধিকারগণ পাবেন না বা তাদের দিয়ে যাওয়ার বিধান নাই। জীবিতাবস্থায় উত্তরাধিকারদের প্রাপ্য অংশ নির্ধারণ করে অংশনামা লিখে যাওয়া আরেকটা ভুল। তবে সম্পত্তির মালিক চাইলে গিফট বা হিবা করে দিয়ে যেতে পারেন। সন্তানদের দিলে সমানভাবে বা সর্বসম্মতি ক্রমে যার প্রয়োজন বেশি তাকে বেশি দিয়ে যেতে পারেন। এক্ষেত্রে নিয়ত ঠিক রাখা জরুরী। অন্য হকদারদের হক নষ্ট করার নিয়তে গিফট করা যাবে না। এটা মীরাস বা উত্তরাধিকারদের সম্পদের অংশ বণ্টন সম্পর্কিত বিষয়। যেটা ভিন্ন আলোচনার স্কোপ রাখে। ওয়াসিয়াহ এবং মিরাস একই বিষয় নয়।

ওয়াসিয়াহ নামা
সামান্থা সাবেরিন মাহী

অগাস্ট ২৫, ২০১৯ইং