নারীদের হজ্জ


শরীফা বেগম তিন ছেলেকে ডেকেছেন জরূরী ভিত্তিতে। ছেলেরা বুঝতে পারছে না তলবের কারন। উনি অনেক বছর আগে বিধবা হয়েছেন। তিন ছেলে, দুই মেয়ে রেখে ওদের বাবা যখন মারা যান, তখন ভয়ানক কষ্টে এদের নিয়ে দিন কেটেছে তার। এখন ছেলেরা সবাই যার যার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। শরীফা বেগমের কষ্টের দিন কেটে গেছে।

ছেলেদের প্রতি তার কোন অভিযোগ, আপত্তিও নেই। তবে কেন এই হঠাৎ তলব…….

-আমার বেশ বয়স হয়েছে। জানি না কবে তোমাদের বাবার মত চলে যাব। এতদিন সময়, সুযোগ, অর্থ কোন ভাবেই সব মেলেনি। এখন আমি হজ্জে যেতে চাই। আর আমি এও জেনেছি, মহিলাদের হজ্জে যেতে হলে মাহরাম আবশ্যক। তোমাদের বাবা যেহেতু নেই, তোমাদের কাউকেই আমার সাথে যেতে হবে। এখন কে যাবে সেটাই আমার জিজ্ঞাসা।

বড়ছেলের বক্তব্য ঃ মা, আপনিতো জানেন, আমার ব্যবসার অবস্থা, এক মুহূর্তও আমি সময় পাইনা। আমার পক্ষে সম্ভব না এক মাসের জন্য হজ্জে যাওয়া। আমি আপনার যাবার সমস্ত ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, কিন্তু আমার যাওয়া হবেনা।

মেজ ছেলের বক্তব্য: “আমার চাকরিটা নতুন, এটাতেই আমার সংসার চলে। এই মুহুর্তে এক মাসের ছুটি নেয়া সম্ভব না। আর আপনিতো জানেন বৌমায়ের অবস্থা, এ রকম সময়ে তাকে ফেলে কিভাবে যাই।

ছোট ছেলের বক্তব্য: “আমার দেশের বাইরে চাকরি। বছরে এক দুবার দেশে আসি, আমিতো হজ্জের সময়ে ছুটি পাবো না।”

তিন ছেলেই মায়ের সাথে যাবার ব্যাপারে না সূচক, দায়সারা বক্তব্য দিয়ে গেল।

এবার মা বলতে শুরু করলেন, তোমাদের বাবা যখন মারা যান, আমার বয়স কিন্তু বেশ কম ছিল। আর আমি ছিলাম যথেষ্ট সুন্দরি এবং ভালো বংশের মেয়ে। আমি চাইলেই মন মত একটা বিয়ে করে নতুন সংসার শুরু করতে পারতাম। কিন্তু তোমাদের জন্য সেটা করিনি। আমি চাইনি আমার সন্তানরা সৎ বাবার কাছে লালিত পালিত হোক।

কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আমি ভুল করেছিলাম। এই বয়সে তোমাদের একজনকে আমার মাহরাম হয়ে হজ্জে যাবার অনুরোধ করেছি মাত্র, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। তবে হজ্জে আমি যাবোই, প্রয়োজনে তোমাদের জন্য সৎ বাবার ব্যবস্থা করে হলেও।

ছেলেদের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। তারা তাদের মাকে চেনে। শক্ত, কঠিন প্রানের মানুষ! কি থেকে কি করেন বিশ্বাস নেই। ছেলেরা মিটিং এ বসলো। কি করা যায়! মায়ের জন্য মাহরাম চাই। মাহরামের সংজ্ঞায় ফেলা যায় এমন কাউকে চাই।

তারা পেয়ে গেল তাদের এক মামাকে, যার সাথে যোগাযোগ নেই বললেই চলে, কিন্তু তার হজ্জে যাবার মত সামর্থ্য নেই বলে তিনি যেতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। ছেলেরা মামাকে আশ্বস্ত করলো, হজ্জের সমস্ত খরচ তারা বহন করবে, তিনি যেন শুধু মায়ের সাথী হন। ভদ্রলোক বোনের সাথে হজ্জে গেলেন।


অল্পবয়সী মেয়ে তুলি। আল্লাহ কি বুঝ দিলেন, জামাইকে বোঝাতে লাগলেন, হজ্জে যাবেন। জামাই বলেন, একটা মাত্র বাচ্চা, ওকে রেখে কিভাবে যাব? কিন্তু স্ত্রী একগুঁয়ে, সে যাবেই। তাও স্বামী রাজি হয় না। শেষমেষ স্ত্রী স্বামীকে বললেন, উনি যেতে না চাইলে, সে তার ভাইয়ের সাথে হজ্জে চলে যাবে। তখন স্বামী অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও যেতে রাজী হন। স্বামী থাকার পরেও ভাইয়ের সাথে গেলে লোকে নানান কথা বলবে। বউকে বোঝাতে না পেরে নিজেই তার সাথে চলে গেলেন হজ্জে।


সুফিয়া স্বামীর সাথে হজ্জে যাবেন, সবকিছু ঠিকঠাক। কিন্তু শেষ মুহুর্তে এজেন্সির কোন গাফিলতির জন্য তার রেজিস্ট্রেশন, ভিসা কিছু হয়নি। কিন্তু তার স্বামীরটা হয়ে গেছে। ভদ্রলোক কি করবেন, একাই চলে গেলেন। সুফিয়ার মনে কষ্টের অন্ত নেই। অনেক কষ্ট করে হজ্জের টাকা জোগাড় হয়েছিল দুজনের।

এখন স্বামী একা চলে গেলেন। ওনার সাথে যাবার জন্য মাহরাম চাই, আরেকজনের হজ্জের টাকা জোগাড় নেই। উনি বসে বসে কাঁদেন। স্বামী হজ্জ থেকে ফিরে আসেন। সুফিয়ার কান্না থামেনা। আল্লাহ তার কান্নার জবাব দেন। তারই ছেলে, সে মায়ের কান্না দেখে মাকে নিয়ে হজ্জে যাবার প্ল্যান করে এবং পরের বছরেই তারা হজ্জে যেতে পারেন, আলহামদুলিল্লাহ্‌।


ভদ্রমহিলার বেশ বয়স হয়েছে, বিধবা, অনেক সন্তানের জননী। তারই কন্যা, জামাতা হজ্জে যাচ্ছেন। তিনি চুপ করে থাকেন, কাউকে কিছু বলেন না। তার হজ্জে যাবার খুব ইচ্ছা। কিন্তু এত টাকা কড়ি নেই তার।

একদিন মন খারাপ দেখে মেয়ে মাকে জিজ্ঞাসা করেন, কি হয়েছে তার? বলবেন না বলবেন না করেও মেয়েকে বলে ফেললেন ইচ্ছার কথা। তার স্বামী প্রচুর সম্পদের মালিক ছিলেন। দুজনার উপরেই হজ্জ ফরজ ছিল, কিন্তু না জানার কারনে সময়মত হজ্জ করা হয়ে ওঠেনি, স্বামীও মারা গেছেন। মেয়ে ভাবতে থাকে, কিভাবে মায়ের ইচ্ছা পূর্ণ করা যায়। মেয়ে, জামাতা নিজেদের উদ্যোগে তাকে নিয়ে হজ্জে যান।


শায়লা ওয়েটিং রুমে বসে অপেক্ষা করছে অনেকক্ষণ। এই ডাক্তারের চেম্বারে অসম্ভব ভীড় থাকে সবসময়। ওকে দেখে ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছো এখন?

জী, আলহামদুলিল্লাহ, অনেক ভালো। এবার হজ্জে যাচ্ছি আমি, তাই সে সময় ঔষধ গুলো কি ডোজে চলবে, আর কিছু পরামর্শ নিতে আজকে আসা।
ডাক্তার চোখ তুলে তাকালেন ওর দিকে, তুমি হজ্জে যাচ্ছো, সত্যি! আমার জন্য একটু দুয়া করবে?

শায়লা অবাক হয়ে যায়, ইনি তার কাছে কি দুয়া চান? ইনি একজন স্বনামধন্য ডাক্তার, না তার অর্থের অভাব, না সম্মানের। তার ক্যারিয়ার আর ক্ষমতা বহু নারীর ঈর্ষার কারণ।

ভদ্রমহিলা বলে চললেন, এত বয়স হয়েছে আমার, আমি জানি আমার হজ্জ ফরজ। আমার খুব ইচ্ছা হজ্জে যাবার, কিন্তু আমি যেতে পারছি না। আমি জানি, মেয়েদের হজ্জে যেতে মাহরাম লাগে। আমার কোন মাহরাম নেই যাবার মত। আমার স্বামীকে বহুবার বুঝিয়েছি, ওনাকে রাজি করাতে পারিনি। আমার ভাই মারা গেছেন। আর একমাত্র ছেলে সে এসবের ধারে কাছেও নেই।

প্রতিবার হজ্জ আসে আবার চলে যায়, কিন্তু আমার যাওয়া হয়না। টাকার পাহাড়ে বসে থেকেও হজ্জে যাবার ক্ষমতা নেই আমার। ভদ্রমহিলা ইমোশনাল হয়ে পরেন। একটু দুয়া করবে আমার জন্য, আল্লাহ আমার এই আশা যেন পূরণ করেন!

শায়লার বিস্ময়ের শেষ হয় না। হায়রে কপাল। সব আছে, কিন্ত হজ্জে যাবার সুযোগ নেই তার!!


রাহেলা বেগম, স্বামী হারিয়েছেন সদ্যই। ঘটনা এত দ্রুত ঘটেছে, তিনি এখনো ঘোরে আছেন। ইদানিং মৃত্যু ভয় তাকেও পেয়ে বসেছে। এখন তিনি হজ্জে যেতে চান। পয়সার অভাব নেই, স্বামী ঢের রেখে গেছেন। হজ্জ নিয়ে খুব বেশি ধারনা নেই তার, কিন্তু ইচ্ছা প্রকাশের পরেই জানতে পারেন, মাহরাম লাগবেই।

না তার কোন ভাই আছে, না পুত্র। আছে শুধু মেয়ে জামাই। এখন মেয়ে জামাইদের মুখের দিকে চেয়ে আছেন। যেখানে নিজের ছেলে মায়ের সাথে হজ্জে যেতে রাজি হয়না, সেখানে অন্যের পুত্রের কাছে এই ইচ্ছা পূরনের দাবী শুধু দাবিই থেকে যাবে, ভাবাটা খুব ভুল কিছু নয়।

উপরের প্রতিটা ঘটনা সত্য (কিঞ্চিত পরিবর্তিত)।

এখানে মহিলাদের জন্য একটা মেসেজ আছে, সক্ষম অবস্থায় (শারীরিক, আর্থিক, মাহরাম) হজ্জ পালন করে ফেলবেন যত দ্রুত সম্ভব। বিশেষ করে স্বামী থাকা অবস্থায়। তবে অনেকেই স্বামীকে রাজি করাতে পারেন না সত্যি! তাদের জন্য দুয়া কবুলের সময়গুলোতে বেশি বেশি দুয়া করতে থাকেন।

আর যাদের সবকিছু ঠিক আছে, তারা যদি বিষয়টাকে পিছাতে থাকেন বিভিন্ন অজুহাতে, যখন আপনার যাবার ইচ্ছা হবে, আপনাকে হয়তো অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকতে হবে। তাই বোনেরা, আমরা নিজেদের স্বার্থে চলুন হজ্জ পালনে উদ্যোগী হই, মাহরামকে বোঝাই, ইন শা আল্লাহ।

আল্লাহর কাছে চাইলে তিনি ফিরিয়ে দেন না, তার কাছে চাইতে কার্পণ্য করবেন না, অবশ্যই তিনি আপনার আমার মনের খবর রাখেন। তাই মন থেকে চান, শুধু কবুলের অপেক্ষা মাত্র।

আর বহু বোন আছেন, যাদের আর্থিক সংগতি নেই, কিন্তু মনটা কাবার চারপাশে ঘুরপাক খায়, তাদের কথা ভাবুন। নিজের যে নেয়ামত আছে তার শুকরিয়া আদায় করুন, সময়মত হজ্জ পালন করুন।

—————————
নারীদের হজ্জ
ফাহমিদা হুসনে জাহান