ভালোবাসার হজ্ব যাত্রা

কখনো কখনো কোন কিছু না চাইতেই মহান রাব্বুল আ’লামীন তা দিয়ে দেন এবং সেই দেওয়াটা এতই এতই স্পেশাল হয় যে রবের প্রতি কৃতজ্ঞতায় বারবার চোখদুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে৷ কতই না পরম ভালোবাসায় তিনি আগলে রেখেছেন! এই ভালোবাসার কথা চিন্তা করে মনে হয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কি আদৌ কিছু করেছিলাম! এই ছোট্ট জীবনের ক্ষুদ্র পরিসরে যা পেয়েছি, তা এতই স্পেশাল যে বাকি জীবন আর কিছু না পেলেও কোন চাওয়া থাকবে না৷ নিশ্চয় আমার রবকে ডেকে আমি কখনোই ব্যর্থ হব না!

গত বছরের এই সময়ে আমাদের পরিবারের সবার মাঝে খুব আনন্দ-উদ্বিগ্ন একটা ভাব৷ ফ্লাইটের আর মাত্র দু’দিন আছে৷ উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ক্লাস করেছি সবে মাত্র ১ মাস ২০ দিনের মতো। কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে নিলাম৷ আত্নীয় স্বজনদের বিদায় জানিয়ে নির্দিষ্ট দিনে আল্লাহর নামে প্লেনে উঠলাম৷ প্লেনে উঠেও বুঝতে পারছিলাম না আসলেই আমরা যাচ্ছি তো! কেমন যেন ঘোর ঘোর একটা ভাব। জেদ্দা এয়ারপোর্টে যখন ল্যান্ড করি তখন দুপুর ১.৩০৷ এরপর ইমিগ্রেশন ফরম্যালিটিস আর অন্যান্য সবকিছু করতে করতে রাত এগারোটা বেজে যায়৷ মক্কার উদ্দেশ্যে আমরা রওনা হই৷ মক্কায় পৌছাতে পৌছাতে ভোর চারটা৷

সেদিন সন্ধ্যেবেলায় আমরা ওমরাহ‌র উদ্দেশ্যে রওনা হই৷ পথে যেতে যেতে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক পড়ছিলাম এবং আলাদা কেমন এক অনুভূতি যেন ভর করছিলো৷ চোখ বারবার ঝাপসা হচ্ছিলো আর রাব্বুল আলা’মীন এর নিকট কৃতজ্ঞতায় অশ্রুসিক্ত হচ্ছিলো দু’চোখ৷ মাসজিদুল হারামে ঢুকতেই দুচোখ স্থির হয়ে গেলো কা’বার উপর৷ সবাই দুই রা’কাত মাসজিদের সালাত আদায় করে তিনতলায় গেলাম ভালো করে কা’বা দেখার জন্য৷ সামনে দাঁড়িয়ে আমি আমার নিজেকে আর থামাতে পারলাম না! পৃথিবীতে এর চাইতে সুন্দর আর আবেগঘন মুহূর্ত আর হয় না৷ এরপর আমরা ওমরাহ্ করলাম৷ সেই সারাটা দিনের অনুভূতি আমার এমন ছিল যে, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সুন্দর শব্দ একত্রিত হলেও আমার অনুভূতির গাঁথুনি শেষ হবে না৷

এক সপ্তাহ পরই শুরু হয়ে গেলো আমাদের বহু প্রতীক্ষিত সময়গুচ্ছ৷ ৮ ই জিলহজ্জ সকালে মিনার উদ্দেশ্যে রওনা হই৷ অসহনীয় গরমের মাঝে, মাথা ঠাণ্ডা রেখে ইবাদাত করাটা ছিলো কঠিনতম কাজ৷ আম্মু বারবার আমাদের তিন ভাইবোনকে শিখিয়ে দিচ্ছিলেন এই দুয়া করতে “হে আল্লাহ, আমাদের জন্য তুমি সহজ করো”৷ মিনায় একদিন একরাত অবস্থান করে ফজর সালাতের পর আমরা আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওনা হই৷

সেদিন ছিলো প্রচণ্ড গরম৷ আরাফাতে যখন পৌছাই তখন সকাল ১০.৩০ এরও বেশি৷ আমাদের কাফেলার তাবু খুঁজতে খুঁজতে অনেক সময় লেগে যায়৷ সেদিনের স্মৃতির পাতা ওল্টালে এখনো চাপা এক ধরণের কষ্ট হয়৷ মনে হয় কিছুই মনে হয় করা হয়নি৷ তবে সেদিনের কিছু জিনিস খুব দৃঢ়ভাবে মনে দাগ কাটে৷ এই অতিষ্ঠ হওয়ার মতো গরমের মধ্যেও দুজন আন্টিকে দেখি একটানা ইবাদাত করেই যাচ্ছেন৷ তাবুর পিছনের এক কোণায় আমার এক আন্টি তার রবের নিকট অনবরত কেঁদেই যাচ্ছেন৷ এই সুন্দর দৃশ্যটা আমার মনে খুবই নাড়া দেয়৷

আসরের সময় কাঠফাটা রোদ বিদায় হয়ে, হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে যায় প্রকৃতি, আরামদায়ক বাতাস বইতে থাকে৷ আমার বাবা তখন আমাদের নিয়ে বাইরে এক কোণায় চলে আসেন৷ আমাদের নিয়ে আল্লাহর কাছে হাত তুলেন৷ এইটা হলো আরেকটা মুহুর্ত যা চিন্তা করে করে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে ৷ গুড়িগুড়ি হালকা বৃষ্টি হচ্ছিলো সেদিন৷

সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ আগে আমরা মুযদালিফার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম৷ অর্ধেক পথ গাড়িতে গিয়ে বাকি অর্ধেকের মতো হেঁটেছি ৷ মুযদালিফার পরিবেশ ছিলো সম্পুর্ণ ভিন্ন৷ ঠান্ডা, রাতের স্নিগ্ধ হাওয়া, খোলা আকাশ সব মিলিয়ে সুবহানাআল্লাহ খুব সুন্দর পরিবেশ৷ মাগরিব আর ঈশার সালাত একসাথে পড়ে আমরা তিন ভাই বোন খুব আনন্দ নিয়ে পাথর কুড়ানো শুরু করি৷ সে কী মজা পাথর কুড়ানোতে! ছোট ছোট বোতলে আমরা পাথর জমাতে থাকি ৷ রাত ১.৩০টা বাজলে মুযদালিফা থেকে জামারাতের উদ্দেশে রওনা হই৷ শয়তানকে পাথর মারার যে প্রচলিত ধারণা আছে তা আসলে ঠিক নয়। জামারাতে পাথর মারার উদ্দেশ্য আল্লাহকে স্মরণ করা এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসাল্লাম এর সুন্নাত পালন করা। এই পাথর মুজদালিফা থেকে সংগ্রহ করা নিয়েও কোন বাধ্যবাধকতা নেই। যে কোন স্থান থেকে পাথর নেয়া জায়েয আছে। সাতটা পাথর মারার সময় প্রতিবার “আল্লাহু আকবার” বলে পাথর ছুড়তে হয়।

মুযদালিফা থেকে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পথ পায়ে হেঁটে আমরা জামারাহ এসে পৌছাই। এই দু’দিন অনেকরকম সহ্যসীমা অতিক্রম করে আসি৷ আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে খিটখিটে মেজাজকেও আয়ত্তে এনেছি, কিন্তু হঠাৎ করেই মাথা এলোমেলো হয়ে যায় যখন দেখি আমার পাথরের বোতল নেই এবং আমার ভাইয়েরটাও গায়েব৷ দুঃখে, কষ্টে আমার চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারিনি৷ আমার এত সাধের পাথর কুড়ানো, সব চলে গেলো৷ আমার ছোট ভাই-বোন দু’জনেরই মন খারাপ৷ কিন্তু কিছুক্ষণ পর কয়েকজন আন্টি আমাদের মন খারাপ দেখে তাদের পাথর আমাদের সাথে শেয়ার করেন৷ আলহামদুলিল্লাহ! পাথর মারা হয়ে গেলে আমরা মক্কার উদ্দেশ্যে হাঁটতে থাকি৷ ফজরের সালাতের পর থেকে হাঁটা শুরু সেই হাঁটা শেষ হয় সকাল ৭ টায়!

১০ ই জিলহজ্জ্ব কুরবানী শেষে, কুরবানীর নিয়ম নীতি পালন করে, সন্ধ্যায় আমরা তাওয়াফ করি, সাঈ করি৷ এরপরই আবার মিনায় ফিরে যাই। দ্বিতীয় দিন, তৃতীয় দিন জামারাতে পাথর মেরে আমরা মক্কায় পুনরায় ফিরে আসি৷ বিদায়ী তাওয়াফ করি। এইভাবে আমাদের হজ্জ্বের দিনগুলি শেষ হয়৷ বাকিটা কবুল করে নেওয়ার মালিক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা।

আমাদের এই সফরটা ছিলো পুরোই ভালোবাসায় পরিপূর্ণ৷ আমাদের সহযাত্রী আন্টিরা এত আদর ও ভালোবাসা দিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ! সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, জীবনের এই অধ্যায়ে আল্লাহ আমাকে তাঁর পবিত্র কা’বা তাওয়াফ করার তৌফিক দিয়েছেন, আরাফাহ্ এর ময়দানে দু’হাত তুলে তাঁকে অনুভব করার সুযোগ করে দিয়েছেন, আমার জীবনে আর কীই বা চাওয়া পাওয়ার আছে! আমার ঘুমন্ত উপলব্ধি জাগ্রত হয়েছে, আমি আমার দ্বীনকে চিনেছি, আমি নতুনভাবে আমার সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবেসেছি।

আলহামদুলিল্লাহ, কৃতজ্ঞতায় দু’চোখ ভিজে আসে যখন ভাবি আমি আসলেই অনেক সৌভাগ্যবতী। এখন শুধু ছোট্ট একটি চাওয়া আবার যেন সেই শান্তিপূর্ণ জায়গায় গিয়ে দু’হাত তুলতে পারি৷

আল্লাহ আমাদের সবাইকে তার দ্বীনের পথে অবিচল রাখুন৷
আমীন।

……………………..

বুশরা ইসলাম
১৯ আগষ্ট ২০১৮