হজ্জের প্রস্তুতির কিছু জরুরী বিষয়-১

ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের একটি হলো হজ্জ। হজ্জ ফরজের অন্যতম দুটি শর্ত হলো সুস্থ থাকা এবং সম্পদ থাকা। অনেক সম্পদশালী ব্যক্তি আছেন যাদের ভাগ্যে হজ্জ নসীব হয় না। আবার এমন অনেক লোক আছেন যারা অসুস্থ বা তেমন কোন সামর্থ্য নেই, তবুও তাদের আল্লাহর রহমতে হজ্জ করার সৌভাগ্য হয়ে যায়।

একজন হাজী আল্লাহর মেহমান। আল্লাহর মেহমান হয়ে যাওয়া যা তা ব্যাপার না। আল্লাহর মেহমান হয়ে যাওয়ার সময় যাতে কোন ভুল না হয় সেদিকে অবশ্যই নজর দিতে হবে। তাই হজ্জে যাওয়ার আগে ভালো মত হজ্জ সম্পর্কে জেনে বুঝে গেলে ভুল কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। হজ্জ এমন একটি ইবাদত যা জীবনে মাত্র একবারই ফরয। বেশিরভাগ মানুষ তার জীবনের সব সঞ্চিত অর্থের বিনিময়ে হজ্জে যান।

হজ্জের সময় কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি হলে আজীবনের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। সবাই দ্বিতীয়বার হজ্জ করতে পারেন না। হজ্জের সময় যেন কোন ত্রুটি বিচ্যুতি না হয় সেদিকে নজর রাখা জরুরী। তাই যারা হজ্জের নিয়ত করে ফেলেছেন এবং হজ্জে যাবেন বলে প্রাথমিক কার্যক্রম শেষ করে ফেলেছেন, তাদের অনেক আগে থেকেই হজ্জের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া দরকার।

আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে হজ্জ সম্পর্কে কিছু খুঁটিনাটি বিষয় জানাতে চাচ্ছি —-

# বেসরকারীভাবে হজ্জে যাওয়ার আগে যে এজেন্সীর মাধ্যমে যাবেন, সেই এজেন্সীর খোঁজ খবর নিবেন। তারা ‘হাব’ এর সদস্য কিনা, মক্কা মদীনায় কোথায় রাখবে, কতদুর রাখবে, কয় বেলা খাবার দিবে জেনে নিবেন। পারলে ঐ এজেন্সীর মাধ্যমে আগে যারা গিয়েছেন তাদের কাছ থেকে রিপোর্ট নিবেন।

# এজেন্সীর যে মোয়াল্লেম থাকবেন, অবশ্যই তিনি যেনো একজন আলেম হন। দেখা গিয়েছে সেখানে অনেক এজেন্সী তাদের হাজীদের নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেন। হাজীরা জানেনও না কোথায় কি করতে হবে। অনেক মোয়াল্লেম আলেম না হওয়ার কারনে নিজে ভুল করেন এবং হাজীদেরকেও ভুল করিয়ে দেন।

অনেক সময় হজ্জের নিয়ম কানুন পালনের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা দেখা দিলে মোয়াল্লেম কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলে দিতে পারবেন। মোয়াল্লেম আলেম না হলে সমস্যা হতে পারে। যেমন ধরা যাক, তাওয়াফ করার সময় যদি ফরয নামায শুরু হয়ে যায় তখন হাজী কি করবেন? তিনি কি নামাজ পড়বেন, নাকি তাওয়াফ করবেন? যদি নামাজ পড়েন তাহলে কি প্রথম থেকে তাওয়াফ শুরু করবেন নাকি তাওয়াফ যেখানে শেষ করেছিলেন সেখান থেকেই শুরু করবেন? অথবা সায়ী করার সময় অযু না থাকলে তখন কি হবে? ইত্যাদি এমন ধরনের সমস্যা হতে পারে।

# যখনই আপনি নিয়ত করলেন যে আপনি হজ্জে যাবেন, তখন থেকেই কিন্তু আপনি আল্লাহর মেহমান। তাই হজ্জে যাওয়ার আগে খুব ভালো মত হজ্জের নিয়ম কানুন শিখে নিবেন, প্রশিক্ষন নিবেন এবং তখন থেকেই আপনি আল্লাহর রাস্তায় বের হচ্ছেন সে রকম মন মানসিকতা লালন করতে শুরু করবেন।

মাসলা মাসায়েল গুলো ভালো মত জেনে নেয়ার চেষ্টা করবেন। বিভিন্ন বইপত্র ঘাঁটুন। এ ব্যাপারে ইউটিউবে বিভিন্ন ভিডিও দেখে শিখে নিন। পারলে কোনো ভালো আলেমের কাছ থেকে জেনে নিন। যারা আগে হজ্জ করেছেন, তাদের কাছ থেকে শিখে নিন, তাদের অভিজ্ঞতার কথা শুনুন। ছোট ছোট দু’আগুলো মুখস্ত করে ফেলতে পারেন।

# হাঁটা প্র‍্যাক্টিস করুন। দৈনিক ২/৩ কি:মি: হাঁটুন। হাঁটার জায়গা না পেলে বাসায় হাঁটুন। সেটা না পারলে বাসায় জগিং করুন। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না যে শুধু হজ্জের সময়টুকু অর্থাৎ মূল হজ্জের ৫/৬ দিন আপনাকে কতটা পথ হাঁটতে হবে।

একটু নমুনা দেই। আরাফা থেকে মুযদালিফা- ৫ কি:মি: মুযদালিফা থেকে মিনা- ২ কি:মি: মিনা থেকে জামারাহ- ৩ কি:মি: জামারাহ থেকে হারাম শরীফ- ৮ কি:মি: হারাম শরীফ থেকে মিনা- ৮ কি:মি: এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আপনাকে কতটা হাঁটতে হবে।

যদিও প্রথম দিন মিনায়, আরাফায় যাওয়ার সময় বাসে করে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু মুযদালিফা থেকে মিনা, মিনা থেকে জামারাহ, জামারাহ থেকে হারাম শরীফ আবার হারাম শরীফ থেকে মিনা আপনাকে হাঁটতেই হবে। এছাড়া মূল হজ্জের সময় তাওয়াফ আর সায়ী করতে হবে।এছাড়া আপনার হোটেল যদি হারাম শরীফ থেকে অনেক দূরে হয় তাহলে হারাম শরীফে নামাজ পড়তে আসতেও অনেক হাঁটতে হবে। প্রতিদিন যদি ২/৩বার নফল তাওয়াফ করেন, তখনো অনেক হাঁটা লাগবে। তাই হাঁটা প্র‍্যাক্টিস করে নিজেকে ফিট রাখুন।

# খুব ভালো মত জেনে নিন ইহরাম অবস্থায় কি কি কাজ করতে পারবেন না। কারণ ইহরামের নিয়তের পর থেকেই আপনার সামনে কোন না কোন পরীক্ষা আসবে। যেমন, ইহরাম অবস্থায় কোন পশু-পাখি মারতে পারবেন না বা কাউকে মারার জন্য দেখিয়ে দিতে পারবেন না।

# ইহরাম অবস্থায় অনেক স্বামী-স্ত্রী ঝগড়া করেন বা একে অন্যের সাথে ঝগড়া করেন। আবার অনেকে গীবত করেন। সাবধান ! ইহরাম অবস্থায় এসব নিষিদ্ধ। অবশ্য এটা সবসময় নিষিদ্ধ।

# অন্য হাজীর যেন কোন কষ্ট না হয় সে ব্যাপারে খেয়াল রাখা জরুরী। কারণ আপনার মত তিনিও আল্লাহর মেহমান।

# ভালো মত জেনে নিবেন কোন কোন স্থানে দোয়া কবুল হয়। যেমন, কাবা ঘরের ভিতর, যমযমের নিকট, সাফা-মারওয়ায়, সাফা-মারওয়ার সবুজ বাতির মাঝখানে, মাকামে ইব্রাহীমের কাছে, আরাফাতের ময়দানে, মুযদালিফায়, মিনায়।

# একটি দু’আর নোটবই তৈরি করে ফেলুন। হজ্জের সময় কি কি দু’আ করবেন তার একটা লিস্ট করে ফেলুন। কারণ হজ্জের সময়, তাওয়াফ বা সায়ী করার সময় অতি আবেগের কারনে অনেকেই কি দু’আ করবেন তা ভুলে যান। দু’আ লিস্টে এখন থেকেই প্রতিদিন একবার নজর বুলালে আপনার দু’আ করতে এখন যেমন সহজ হয়ে যাবে, তেমনি হজ্জের সময়গূলোতেও দু’আ চাইতেও সহজ হয়ে যাবে।

# আপনি হয়তো রান্না করছেন বা গোসল করছেন, এমন সময় আপনার মনে হলো অমুক জিনিষটা আল্লাহ্‌’র কাছে চাওয়া দরকার। হাতের কাজটা শেষ করে অথবা পারলে সাথেসাথেই টুক করে নোটবইয়ে সেটা লিখে ফেলুন। পরবর্তীতে আপনি ভুলে যাবেন না। কারণ শয়তান মানুষকে ভুলিয়ে দেয়।

এছাড়া কোরআনে বিভিন্ন দু’আ আছে সেগুলো নোটবইয়ে লিখে ফেলুন। ফলে দু’আর সময় একবার এই বই, আরেকবার ঐ বই বের করতে হবে না। তাছাড়া বিভিন্ন দু’আর এ্যাপ্স আছে। যেমন, “রাব্বানা” দিয়ে শুরু করা কিছু দু’আ। সেসব এ্যাপ্স ডাউনলোড করে নিতে পারেন।

# সাধারণত হজ্জের প্যাকেজ হয় ৩০ থেকে ৪০ দিনের জন্য। তারমানে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পর আপনার হাতে প্রচুর সময় থাকবে। সময়গুলো কাজে লাগাতে হবে দূ’আ আর যিকির করে। বিশেষ করে হজ্জের মূল সময়ে আরাফাতে, মিনা, মুযদালিফায় অনেকেই গ্রুপ করে গল্প করেন। সেটা না করে দু’আ আর যিকির করাটাই উত্তম। দু’আর নোটবইটা কাজে লাগবে সেই সময়। আরবী দু’আর অর্থগুলো জেনে বুঝে দু’আ করবেন।

# মক্কা-মদিনার দর্শনীয় স্থান গুলো সম্পর্কে জেনে নিবেন। ফলে আপনার এজেন্সী যখন আপনাকে সেখানে ঘুরাতে নিয়ে যাবে তখন মনের মাঝে ফিলিংসটা কাজ করবে।

# নামাজের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার দু’ঘন্টা আগে থেকে গিয়ে বসে না থাকলে মসজিদের ভিতর জায়গা পাবেন না। বিশেষ করে জুম্মার নামাজ শুরু হওয়ার তিন ঘন্টা আগে গেলে মসজিদের ভিতর ভালো জায়গা পাবেন।

# অনেক মহিলারা জামাতে নামাজ পড়তে পারেন না। যাওয়ার আগে শিখে নিবেন। ছেলেদের দায়িত্ব তাদের মহিলা আত্মীয়দের শিখিয়ে দেওয়া। কারণ আমাদের দেশের মহিলারা মসজিদে নামাজ পড়তে অভ্যস্ত নয়।

# যেসব মহিলারা হজ্জে যাবেন, এখন থেকেই তারা যেন চুল লম্বা রাখা শুরু করেন। অনেক মহিলাদের চুল ছোট থাকে। মনে রাখতে হবে যে, একবার উমরাহ করার পর, আরেকবার হজ্জ করার পর আপনাকে চুল কাটতেই হবে। অর্থাৎ দুইবার চুল কাটতে হবে। ছেলেরা ন্যাড়া হবে, তবে মেয়েদের ন্যাড়া হতে হবে না। মেয়েদের আংগুলের এক কড়া সমান পর্যন্ত চুল কাটতে হবে।

সাধারণত মেয়েদের স্বামী বা ভাই বা যিনি মাহরাম থাকেন তিনিই চুল কাটেন। যেহেতু তারা এমন চুল কাটায় অভ্যস্ত থাকেন না, তাই প্রয়োজনের তুলনায় অনেকসময় বেশী চুল কেটে ফেলেন বা ত্যাড়াব্যাকা করে চুল কেটে ফেলেন। তাই চুল বড় রাখলে তাদের চুল কাটতে সুবিধা হবে। এরপর দেশে এলে পার্লারে গিয়ে না হয় চুল সুন্দর করে সাইজ করে নেওয়া যাবে।

(আগামী খণ্ডে সমাপ্য)

————————–
হজ্জের প্রস্তুতির কিছু জরুরী বিষয়-১

তাহনিয়া ইসলাম খান