নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া

অন্ধকার জীবনে হঠাৎ যখন আলোর দিশা পেলাম, চোখ ধাঁধিয়ে গেল। যে সময়ে আমি শত সহস্র পাপে ডুবে ছিলাম, ঠিক সে সময়ে দ্বীনি ভাইবোনেরা ইসলামের আলোয় জীবন সাজিয়ে নিয়েছে। তাদের সুসজ্জিত জীবনে নিজেকে বড্ড বেমানান মনে হত। মনে হত ওদের ছুঁতে গেলে আমাকে আলোর বেগে ছুটে চলতে হবে।

বছর ঘুরে রামাদান আসতো, ভাঙা মন নিয়ে সবার প্রস্তুতি দেখতাম। কুরআন তিলওয়াত তো চলবেই, সেই সাথে প্রতিদিন এক ঘন্টা তাফসীর পড়া। আরও থাকবে সূরাহ মুখস্ত। প্রতিদিন কম করে হলেও ৫টি আয়াত।
অবাক লাগতো খুব। এও কি সম্ভব? সব কাজ সামলে ওরা ঠিকই পারতো। মনে হত ওরা পারলে আমি কেন পারব না? ওদের মত আমিও অনেক পরিকল্পনা সাজাতাম ঠিক রামাদানের আগে। মাস শেষে জিব্রীল (আলাইহিস সালাম) আর নবীজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথোপকথন স্মরণ করে হতাশ হতাম। সবাই পারছে, আর আমার প্রাপ্তির খাতা শূন্য রয়ে গেছে।

একদিন মনে হল ধ্বংস হয়ে গেছি ভেবে হাল ছেড়ে দেয়ার জন্য তো আমার রাব্ব আমাকে বাঁচিয়ে রাখেননি! বছর ঘুরে আরেকটা রামাদান যদি পেয়েই যাই, এর অর্থ তিনি আমাকে সুযোগ দিচ্ছেন।
এ সুযোগ কীভাবে কাজে লাগাব? আবার সেই একই প্রশ্ন- সবাই পারছে, আমি পারছি কই?
প্রশ্নের জবাবে নিজেকে পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম। সবার জীবন কি এক? একই ছাদের নিচে থেকেও মানুষ ভিন্ন জীবন যাপন করতে পারে। যে কষ্টে একজন নুয়ে পড়ে, সে কষ্টে আরেকজন মাথা উঁচু করে দাড়ায়।
কেউ হয়ত এক ঘন্টার চেষ্টায় কুর’আনের দশটা আয়াত মুখস্থ করে ফেলে। কেউ হয়ত ঐ সময়ে দশ আয়াতের তাফসীর হৃদয়ংগম করে নেয়। কারো জন্য হয়ত দু’টোই বেশ কঠিন।
তাহলে উপায়?

উপায় আছে। দিন শেষে আমাদের সবার লক্ষ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। আল্লাহ কারো উপর সাধ্যাতীত বোঝা চাপিয়ে দেন না।

দশদিনের মাঝে গোটা কুর’আনের অর্থটা পড়ে ফেলতে হবে ভেবে কেন অস্থির হয়ে যাচ্ছেন? আপনি বরং ভাবুন আমাকে কুর’আনের অর্থ পড়তেই হবে। কতদিনে পড়তে হবে তার সীমা বেঁধে নিবেন না। সবসময় চাইবেন যাতে আল্লাহ সহজ করে দেন, আপনার ইলমে বারাকাহ দেন।

অন্তর্জালের ভাই বোনেরা প্রতিদিন এক ঘন্টা তাফসীর পড়েন। কে বলেছে আপনাকেও এক ঘন্টা পড়তে হবে? আপনি বরং আল্লাহর কাছে সাহায্য চান, যাতে সাধ্যমত পড়তে পারেন। তিনিই তো সুকঠিনকে সহজ করে দেন!

কারো বাড়িতে ইফতারে শুধু দই চিড়া হবে। আর আপনি দুপুর থেকে ইফতারের ভাজাভুজির প্রস্তুতি নিবেন। পরিস্থিতি এমন তেলেভাজা কিছু করতেই হবে, উপায় নেই। ঐ সময়টা নষ্ট ভেবে কেন কষ্ট বাড়াচ্ছেন?
আলুর চপটা ভাজতে ভাজতে যিকর করলে কি সময়টাকে নষ্ট বলা যায়?

সারা বাড়ির হাড়ি পাতিল মাজতে মাজতে দু’আ করলে কি সময়টাকে নষ্ট বলা যায়?
একবার ভাবুন, অনেকে এই সময়টা জটিল এসাইনমেন্ট করছে, অনেকে অফিসের ক্লায়েন্টের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলছে। তাদের মন ব্যস্ত, মুখ ব্যস্ত। আর আপনার দু’হাত ব্যস্ত কিন্তু মন আর মুখ আল্লাহর যিকরের জন্য উন্মুক্ত।

আমাদের জীবনটা এমনই। সবাই ব্যস্ত থাকি, সবাই পরীক্ষা দিই। কিন্তু আল্লাহ আমাদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা প্রশ্নপত্র তৈরি করেছেন।

একারণেই সবাই পারছে, আমি কেন পারছি না- এ প্রশ্ন অর্থহীন।

এই রামাদানে সবার উদ্যোম আর প্রস্তুতিতে দিশেহারা হওয়ার আগে, নিজের সাথে বোঝাপড়া করে নিন।
পৃথিবীর সবাই যখন কাজের ফলাফল দিয়ে আপনাকে বিচার করছে, আল্লাহ তখন আপনার চেষ্টাটা দেখছেন। এর চেয়ে স্বস্তির আর কী হতে পারে!

নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া
আনা আমাতুল্লাহ

জুন ০৪, ২০১৮ইং