ভ্রান্তি

১.
বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে দ্রুতপদে হেঁটে বাড়ি ফিরছে অর্পিতা। ব্যাগটা বহনযোগ্যই ছিল যদি না তাতে অাস্ত একটা প্রমাণ সাইজের নারকেল ঢুকত। একবার ডান হাত তো একবার বাম হাতে চক্রাকারে ঘোরাতে ঘোরাতে হাতে গোণা ক’কদম হেঁটে ক্লান্ত হয়ে শ্রান্তভাবে নিজের উপর মহা বিরক্ত অটোর উদ্দেশ্যে দাড়িয়ে পড়ে। অর্পিতার অটোভাগ্য বরাবরই ভালো বিধায় অাজও তা পেতে সময় লাগল না। হালকা দর কষাকষির পর একটাতে উঠে পড়ে। অথচ মুটিয়ে যাচ্ছে বলে আর একবারও বাইরে বের হলে কোনো প্রকার অটো বাস কিংবা রিকশা চড়বে না বলে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। নিজের সিদ্ধান্তের এই করুন অবস্থায় মনটা খারাপ হয়ে যায় তার। হঠাৎ কি মনে করে মনে মনে ক্যালেনডার আওড়ায় অর্পিতা। ওহ! সামনের সপ্তাহেই তো রমজান শুরু। নাহ! এবারের রমজানেই তাকে জিরো ফিগার অর্জন করতে হবে, এই তো সেরা সুযোগ।

২.
নিশু কমনরুমে বসে বসে ক্লাস টেস্ট এর খাতা দেখছিল। মাত্রই ক্লাস নাইনে পয়তাল্লিশ মিনিট লেকচার দিয়ে এসেছে, মাথাটা কেমন যেন ঝিনঝিন করছে। টিফিন পরে আবার দুটো ক্লাস আছে। আজ বোধয় আর অর্পিতার সাথে বিকেলে বের হওয়া যাবে না। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে অর্পিতাকে কল দিল নিশু।

– এই শোন,আজ বিকালে বোধহয় বের হতে পারব নারে। শরীরটা ভালো লাগছে না।
– কি হয়েছে রে?
– না,তেমন কিছুনা,ক্লাস আর মিটিং করতে করতে টায়ার্ড হয়ে পড়েছি রে। এবার পুরো রমজান শুধু রেস্টই নিব।
– ছুটি পাচ্ছিস?
– হুম।

৩.
পাশের বাসার তমা ভাবি সেই কখন থেকে এসে বসে আছেন। আপার আসার নামগন্ধটিও নেই।রুমির আর ভাল্লাগছেনা উনার সাথে বসে বসে গল্প করতে,সেই কখন থেকে ঠোটজোড়া চওড়া করে হাসির ভংগি নিয়ে বসে আছে। না পারতে পারতে এক সময় বলেই বসল,
“আপা আসলে আমিই ওকে বলে দিব খবর টা, আপনি হেরান হয়ে বসে না থাকলেও পারেন।”
“আরে কি যে বলনা,এত ভাল একটা খবর নিজের মুখে বলে যাব না তা কি হয়? আর আমার তো ভালই লাগছে।আরে ওইত,নিশু চলে এসেছে…….”
কথা শেষ করার আগেই রুমি দরজা খুলে দিতে গেল।যাক!আপা ফিরল তবে।তমা ভাবিও যেন নিস্তার লাভ করেছেন।
“নিশু,তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম এতক্ষণ,ভাবলাম এসেছি যখন তখন তোমাকে বলেই যাই।”
নিশু বসে এক গ্লাস পানি খেয়ে বলল,
“কি খবর ভাবি?”
“আরে, আমার নাজিফা যে একটা রিয়েলিটি শোতে হামদ গেয়ে ফার্স্ট হয়েছিল না, ওটাতো ১ম রমজানে থেকে এনটিভিতে টেলিকাস্ট করবে বিকাল ৫টায়। তোমরা কিন্তু দেখতে ভুলবেনা,বুঝেছ। আর আরেকটাতে তো ও নিজে উপস্থাপনা করেছিল, ওটা প্রত্যেক দিন সন্ধ্যা ৭টায় দেখাবে এমটিভিতে। উফ!
আমার যে কি এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে না, কবে যে রমজানটা শুরু হবে………

৪.
নাজিফা বাসায় বসে বসে হোমওয়ার্ক করছিল। মা সেই কখন পাশের বাসায় গিয়েছিলেন এখনও ফিরেননি। সন্ধ্যা হতে চলল, মা কি ওকে খুব বড় হয়ে গেছে মনে করছেন যে সে একা থাকতে ভয় পায়না? আসলে সে বড়ই হয়েছে,ক্লাস ফাইভে পড়লে কি হবে, পাশের বাসার অনার্সের এক আপু এসে ওর কাছে গান শিখেন। সেই আপু আজ বিকালে যখন এলেন, সাথে নিয়ে এলেন আরেকজনকে।

-“নাজিফা,ও হচ্ছে আমার কাজিন ঐশী।”

ঐশী আপু খুব সুন্দর করে কথা বলেন। উনি নাকি খুব ভালো রান্নাও করতে পারেন।
-“আরে নাজিফা শোনোইনা, এবারের রমজানে ঐশী আমাদের মজার মজার আর মুখরোচক সব রেসিপি রেঁধে খাওয়াবে, উমম! এবারের রমজানটা যা জোস্ হবেনা…….”

৫.
সন্ধ্যার পর এক কাপ চা খাওয়া সেজুতির দীর্ঘদিনের অভ্যাস। চা না হলে ওর চলেনা-বলাটা মোটেও অতিরঞ্জন হবেনা। আজ এখন পর্যন্ত রান্নাঘরে ওর আগমন না দেখে অমি নিজেই চা বানিয়ে ওর রুমে নিয়ে গেল।
– থ্যাংকস্।
– কোনো প্রয়োজন নেই।
-দেখ্ না আমার অবস্থা, পড়ার চাপে চায়ের কথা ভুলে গেছি।
-তুই আছিস তোর পড়া নিয়ে। আরে, সামনে ওয়ার্ল্ড কাপ, কই প্লান টান করবে…….
-রাখ তোর ওয়ার্ল্ড কাপ। ঈদের পরপরই প্রফ পরীক্ষা।পুরো রমজানে শুধু পড়তেই হবে, না করা যাবে ঈদের শপিং, না যাবে দেখা ওয়ার্ল্ড কাপ,ধ্যাৎ!!!!

৬.
বসু বাজার লেনের শেষ মাথায় একতলা বাড়িটা। ভেতর থেকে হালকা ভলিউমে টেলিভিশনের শব্দ শোনা যাচ্ছে,
“……..সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আত্নশুদ্ধির ও তাকওয়ার বুনিয়াদ গড়ার শ্রেষ্ঠ এই সুযোগ আমাদের সামনে সমাগত। এই রামাদ্বান যেন আমরা অবহেলায় আর জাগতিক প্রয়োজনে………”
কেউ একজন বিরক্তি নিয়ে চ্যানেলটা পাল্টে দিল।
বাড়ির সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত রয়েছে।

***

কাল্পনিক চরিত্রগুলো আর এসব ঘটা ঘটনা প্রবাহগুলো কি আদৌ কাল্পনিক? নাকি আমরাই সেই চরিত্রগুলোর বাস্তব রুপ? নিজেদের যাচাই করার সময় কিন্তু আটকে থাকছেনা। উপলব্ধির জায়গাগুলো জীবিত করতে হবে। রমাদান এসে আবার চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। যার যার নিয়ত অনুসারে আমরা প্রতিদান পাব। গুনাহ মাফ করার নিয়ত করেছিলাম কী? আসুন আমরা যে কয়েক ঘণ্টা বাকি আছে, একে হেলায় না হারাই। কে জানে, আগামী রমাদানে আমি অথবা আপনি বেঁচে থাকব কি না?

“ধ্বংস তার জন্য, যে রমাদান পেল অথচ তার গুনাহ মাফ করে নিতে পারল না।”

……………
ভ্রান্তি
ফাইজা তাসনিম

জুন ১৪, ২০১৮ইং