শখের বাগান

বিকেলে কাঁপা হাতে দইয়ের বাসনে শরীফার বীজ বুনতে বুনতে ভাবছিলাম – এ কেমন শ্রাবণ! কেমন উস্কোখুস্কো চুলের দুরন্ত কিশোরের মত বিকেল। গরম আমার ভাল্লাগে না, আমার গাছগুলোরও না।

ঢেড়সগাছগুলো কেমন হেলে পড়ছে – সারাঘর আঁতি পাতি করে খুঁজেও তাদের ঠেক দেবার মত কিছু পেলাম না। আহা, কানের কাছে বাজল মড়াৎ করে শুকনো কঞ্চি ভাঙার শব্দ। যেন নানীজান এখনি শসার চারাদের দেবেন অবলম্বন।

হঠাৎ করে গোড়া পঁচে মরে যাওয়া শসা চারার জন্য আমার বুকের ভেতর কেমন করে ওঠে। বরবটি চারার দশাও ভালো না, শসার পথ ধরেছে। ডাঁটাশাকগুলো তারাও বাড়ছে না। কলমি শাক অবশ্য বাড়ন্ত। মরিচের বীজ বুনেছিলাম। ঘৃতবোম্বাই আর লম্বা মরিচ। মরিচের বীজ থেকে চারা করাটা নাকি একটু কঠিন – সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। গোটা তিরিশেক বীজ থেকে দুটো করে মোট চারটে চারার দেখা পাওয়া গেল। তথাস্তু! সেগুলোই দইয়ের বাসন থেকে টবে গেল।

একটা অকাজ অবশ্য করেছি, একটা গোলাপগাছ তুলে ফেলে সেখানে মরিচ বসিয়েছি। গোলাপের মালিক দেখলে পেলে কী করবেন – তা বোঝা যাচ্ছে না। অবশ্য গোলাপগাছটি ছিল মৃতপ্রায়। আদর যত্ন করলে বোধহয় তাজা হত, সে শক্তি আর ধৈর্য আপাতত নেই। তাছাড়া, আমার সব গাছ ছাদে সরিয়ে ব্যলকনী জুড়ে তিনি কেবল গোলাপের আবাদ করবেন বলায় – কিঞ্চিৎ বিরক্তিও ছিলো মনে। উহু, মনটা একটু খারাপই লাগছে গোলাপের জন্য। তাই এত সাফাই গাইছি।

আঁশফলের বীজ বুনলাম, শরীফা আর পায়লার বীজও। ইদানিং নতুন বাতিকে পেয়েছে – দেশী প্রজাতির ফল গাছের আবাদ করার। গোলাপজামের চারা যে হবে – তা বুঝতেই পারি নি।অফিসের ফ্রিজে পঁচে যাওয়া গোলাপজাম ছটা বের করে নিয়েছিলাম হসপিটালে যাবার পথে, সেই রোজায়। বাসায় এনে সন্দেহ নিয়ে বুনেছিলাম ছটা বীজ। পাক্কা দেড়মাস পর অঙ্কুরিত হতে দেখে যে কী ভালো লেগেছিল! আরও আছে তেতুলের চারা। সেও হাতখানেক বেড়েছে বুঝি। এই শাওনেই গোলাপজাম আর তেতুল বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হবে। খেজুর বীজো মাথা তুলছে। ভাবছি, একশ তালের চারা করব এবার।বাড়ির সামনের নদীর পাড়ঘেঁষে খেঁজুর আর তালের সারি সারি গাছ বুনে দেব। নিজের জন্য নয়, গাছ লাগানোর আনন্দে। এসব চারার ফল খাওয়ার আশা করি না, ততদিন বাঁচার মোটেও আকাঙ্খা নেই! তবে ব্যলকনীর গ্রীল জুড়ে ঝুলতে থাকা করলা তো খাবার আশা করি! করলাগাছের একচ্ছত্র মালিক আমি।

রোজায় যখন হসপিটালে ছিলাম ছেলেকে নিয়ে, মেয়ে ফোন করে জানাল তার পিতাজী সুন্দর একটা ফুলের গাছ এনে টবে লাগিয়েছেন! আমি বললাম, টব কই পেলো! সে বললো, ক্যান টব তো একটা খালি ছিলো! আমি সেখানে বসেই আর্তনাদ করে উঠলাম- হায় সেটাতে আমার করল্লা গাছ! মেয়ে হাসে, আমি রাগি। সেই সুন্দর ফুলগাছের নিচে দাফন হওয়া বীজ খুঁজেপেতে মোটে তিনটে চারা করতে পেরেছিলাম। আজকে তিনি বললেন – করলা ছেড়া যাবে না। ওরা গাছেই থাকবে, পাকবে। সেই বীজ আবার লাগাব! এই কথার বিরূদ্ধে আমি অতি শীঘ্রই হাইকোর্টে রীট করব।

কামিনী গাছে কলি ধরে আছে মাসাধিক কাল। নট নড়ন চড়ন। আমিও তাতে গা করছি না। জবা গাছে দেখলাম গুনে গুনে সাতটা অর্ধফোটা কলি! আমি তো অবাক! রক্তজবার রঙ কেমন সুন্দর। মেয়ে জানান দিলো ফুল ফুটলে সে ছিড়ে চুলে বাঁধবে! কন্যা শিশু থেকে কিশোরী হয়ে গেছে তাহলে! দিন কই থিকা কই যায়। বিশেষ গোলাপ গাছটাতে একজোড়া জংলী শাখা ডালপালা মেলে বেড়ে উঠতেছে। কাটতে গিয়েও কেন যেন কাটা হলো না। কাল কেটে দেব।

বেলীতে কলি আসতেছে আবার। গাছটার একটা শাখায় একটা কলি আসে। ফুল ফোটার আগে যখন গোল বলের মত হয়, ফুলের চে তখন তারে ভাল্লাগে। কাঠগোলাপটা ছাদে, লেবু, গন্ধরাজ আর মেহেন্দীও। তারা কেমন আছে জানি না। পুত্রকে অনুরোধ করি রোজ পানি দিতে – কী করে জানি না। শীঘ্র তাদের সাথে দেখা হবে সে আশাও নেই! সবার সেবা করে – একহাত দূরত্বে থেকেও মাসাধিক কাল পর খবর নেবার জন্য মাপ চেয়ে আড়মোড়া ভাঙতেই চোখে পড়ল কেবল চোখ মেলে তাকানো বনকাঁঠাল! হপ্তাতিনেক আগে গাজীপুর থেকে তাদের আগমন। আরেকটু বড় হলে তাদেরও ঠাঁই হবে নদীর দেশে!

বাড়িটা কি জঙ্গল বানিয়ে ফেলব শেষাবধি! তুলসি থেকে পাতা ছিড়ে মুখে দিলাম। তারপর রজনীগন্ধা না থাকার দুঃখ করলাম মনে মনে। সবার গোড়ায় একপশলা মাটি দিলাম। তারপর সেই চিরচেনা সুরের আজান শুনে উঠে এলাম। সন্ধের পরে হালকা একপশলা বৃষ্টির টের পাবার পর মনে হলো – গাছে পানিই দেয়া হয় নি!

আহা আহা! বৃষ্টিটা কদিন আসতে থাকুক রুমঝুম। সবার তেঁতে থাকা মন মেজাজ যদি তাতে একটু শীতল হয়। ভরা শাওনে বৃষ্টি না হওয়া তো ভালো নয়, গাছেরা কাঁদবে তবে। রব! আমাদের উপকারী বৃষ্টিতে শীতল করুন। আপনার রহমের বৃষ্টিতে। আমরা ভালো নেই…

শখের বাগান
আফিফা মারজানা

অগাস্ট ২০, ২০১৯ইং