অগ্নি স্নান

রাহেলার চোখগুলো খুশিতে চকচক করছে । মোমবাতির আলোতেও তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নুরউদ্দিন । কাল পহেলা বৈশাখ । দোতালার বেগম সাহেবের বাসায় কাজ করে রাহেলা । বৈশাখে ইলিশ-পান্তা খাবে বলে মাঝারী সাইজের দু’জোড়া ইলিশ মাছ আনা হয়েছে । রাহেলা কে বলেছে ইলিশ মাছের মাথা আর লেজের অংশগুলো যেন নিয়ে যায় । কাঁটা বেশি বলে কেউ খাবেনা । রাহেলা অতি আনন্দে ইলিশ মাছের মাথা কাটছে মোমবাতির আলোয় । কাল ছেলে আসছে । ইলিশ মাছের মাথা জুবায়েরের অতি পছন্দের । নুরউদ্দিন পেছন থেকে বৌকে আলতো করে বাতাস করছে । বেশ গরম পড়বে মনে হচ্ছে এবার ।

দোতলা থেকে হারমোনিয়ামের তালে তালে গানের সুর ভেসে আসছে ।

“ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নি স্নানে শূচি হোক ধরা ….
…………………………………
এসো হে বৈশাখ, এসো এসো । “

নীলাদ্রীর গলা । দোতলার বেগম সাহেবের একমাত্র মেয়ে । টিভি চ্যানেলে গান টান করে । বেগম সাহেব ডিভোর্সী হলেও বেশ স্বাবলম্বী । তিনি নিজেও কোন একটা টিভি চ্যানেলের উঁচু পদে আছেন । বাংলা বছরের প্রথম দিন উপলক্ষে কাল ভোরে সেই চ্যানেলে এক ঝাঁক শিল্পীরা নাকি গান গেয়ে সূর্য বরণ অনুষ্ঠানে করবে । সেখানে নীলাদ্রীও গান গাবে বলে শুনেছে, তারই রিহার্সেল চলছে বোধ হয় ।

বিদ্যুৎ গেলো প্রায় দুই ঘন্টা হলো । বড়লোকদের এইসব এলাকায় বিদ্যুতের সমস্যা কম । তাছাড়া জেনারেটর তো চব্বিশ ঘন্টা আছেই তবে আজকে ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে । বিদ্যুৎ আসার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা এখনও । নুরউদ্দিন মনে মনে ভাবলো এইবার বেতন পেলে একটা চার্জ লাইটসহ ফ্যান কিনবে ইন শা আল্লাহ । তিন বছর হলো এই ফ্ল্যাট বাড়িতে দারোয়ানের চাকরি নিয়েছে । সামান্য বেতন আর নিচতলা গ্যারেজের একপাশে দেড় রুমের কামরায় ফ্রি থাকে নুরউদ্দিন ও তার বৌ । গ্যারেজ সহ বিল্ডিং এর দোতলা থেকে সাততলা পর্যন্ত সব ফ্ল্যাটে জেনারেটরের সুবিধা আছে শুধুমাত্র দারোয়ানের রুম ছাড়া । দারোয়ানদের জেনারেটরের সুখ পাবার নিয়ম নাই । গরীবদের এত বড়লোকি মানায় না ।

রাহেলার মাছের মাথা কুটা শেষ । এরমধ্যেই বিদ্যুৎ চলে আসলো । মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ পড়লো নুরউদ্দিন । কালকে ছেলে আসলে ইলিশ মাছের মাথা খাওয়াতে পারবে এই আনন্দ যেন সরছেইনা রাহেলার মুখ থেকে । হঠাৎই মেইন গেইটে আওয়াজ হলো । নুরউদ্দিন গেইট খুলে দেখে ছেলে জুবায়ের দাঁড়িয়ে আছে বাজারের ব্যাগ নিয়ে । রাহেলা এবং নুরউদ্দিন দু’জনেই হতবাক ছেলের অপ্রত্যাশিত আগমনে । তবে মনে মনে দারুন খুশি । একটা রাত তো থাকবে তাদের সাথে ।

রাহেলা-নুরউদ্দিনের একমাত্র ছেলে জুবায়ের টঙ্গীর এক মাদ্রাসার ছাত্র । রাহেলার শ্বাশুড়ি অত্যন্ত ধার্মিক মহিলা ছিলেন । মৃত্যুর আগে ছেলে আর বৌ এর হাত ধরে অনুরোধ করে গেছেন একমাত্র নাতিকে আল্লাহর দ্বীনের জ্ঞানে দীক্ষিত করতে । দাদীর কথা রাখতে ক্লাস টু তে পড়া জুবায়ের কে তাই হঠাৎই মাদ্রাসায় দাখিল করে দেওয়া হলো । জুবায়ের হিফজ করছে এখন ।

বাজারের ব্যাগ টা মায়ের হাতে দিয়ে জুবায়ের বললো
-মা, কাইল দুপুরে পোলাও আর মুরগীর সালুন করবা । সাথে এক হালি ডিমও আনছি । ডিম ভুনা করবা । অনেকদিন হইলো তোমার মেজবানি রান্ধন খাইনা ।

-কাইলকা তো বৈশাখের পতথম দিন বাজান । কাইলকা সবাই পান্তা-ইলিশ খাইবো আর আমরা মেজবানি খানা খামু ? আর তুমি ট্যাহা কই পাইছো !!

-মাদ্রাসার কাছে এক বাড়িতে দুইটা পোলারে কুরআন পড়াই । উস্তাদ জি ঠিক কইরা দিছে । পতথম মাসের বেতন পাইলাম গত সপ্তাহে । সেই ট্যাহা দিয়া বাজার করছি । আর কাইলকা কিছু মানুষ বৈশাখ পালনের মত আল্লাহর নাফরমানি করবো, পান্তা ইলিশ খাইবো এই খুশিতে, এখন আমরাও যদি এই কাম করি তাইলে তো তাগো লাহান হইয়া যাইবো । এই ইলিশ মাছের মাথা তোমরা অন্যদিন খাইয়ো । আর আমার কথা ভাইবনা । রিযিকে থাকলে আরেকদিন খামুনে । কাইলকা আমরা বাপ-বেটা তোমার হাতের মেজবানি খানা খামু ইন শা আল্লাহ ,কি কও বাপজান ?

নুরউদ্দিন মুচকি হেসে সায় দিলো তাতে । রাহেলার মাথায় তখনও ঢুকেনি বৈশাখ পালন কেন আল্লাহর নাফরমানি হবে ।

-বাজান, বৈশাখ তো ভালা জিনিস । মাইনষে একটু আনন্দ করে । আল্লাহর নাফরমানি কেমতে হইবো বাজান ? -চটপট প্রশ্ন রাহেলার

-মা, তুমি টিভি চ্যানেল রেডিও তো বৈশাখের গানডা হুনসো ? কি কয় ? বৈশাখ নাকি আইসা বেবাক মাইনষের দুক্কু কষ্ট দুর কইরা দিবো । হের লাইগা এরা পায়ে হাঁইটা মিছিল করে জানোয়ার আর পশু পক্ষীর মূর্তি নিয়া । তারা কয় এমতে নাকি দুনিয়ার বেবাক মানুষের ভালা হইবো । এখ্খন তুমি কও এইডা কি সম্ভব ? আমরার ভালা মন্দ দেখনের মালিক তো আল্লাহ । হেরা যা করে এইডা নাফরমানি ছাড়া আর কি ? এইডারে কয় শির্ক, বুঝলা ?

ছেলের কথাগুলো মনে ধরলো রাহেলার । রাতে খাবার দাবারের পর রাহেলার হঠাৎ মনে পড়লো বেগম সাহেবের দেওয়া গত বছরের পুরানো বৈশাখের শাড়িটার কথা । এ বছর লেটেস্ট ডিজাইনের শাড়ি কিনেছে বলে গত বছরে কেনা বৈশাখের সাদা লাল শাড়িটা রাহেলা কে দিয়ে দেন তিনি । শাড়িটা রাহেলার ভীষণ ভালো লেগেছিল । পুরো শাড়িতে একতারা দোতারা ঢোলের ছবি । কিন্তু ছেলের কথা শুনে মনে হচ্ছে এ শাড়ি পরা তো দুরে থাক নিজের কাছে রাখাও উচিত হবেনা । রাহেলা জুবায়ের কে জিজ্ঞাসা করবে বলে মনস্থির করলো ।

-বাবা, এইটা কি করমু ? বেগম সাহেব মায়া কইরা দিছে । ফেরত দিমু ?

মায়ের হাতে থাকা বৈশাখের শাড়ি দেখে জুবায়ের বললো
-না, ফেরত দেওনের দরকার নাই । তুমি বরং এ শাড়ি টা কোন পরিচিত বিধর্মী মহিলা রে দিয়া দিও ।

-বিধর্মী রে কেন বাজান ! তোর ছোট খালারে দিয়া দেই ?

-না…মা এইডা কইরো না । একটা ঘটনা শুনো তাইলে । উস্তাদজির কাছ থেকে শুনছি । হাদীসে বর্ননা করা হইছে – একবার আমরার নবী (সাঃ) সাহাবী উমারের (রাঃ) সাথে বাজারের ভিতর দিয়া যাইতেছে । একলোক সিল্কের কুর্তা বিক্রি করতেছে । সেইটা দেইখা উমার (রাঃ) রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর উদ্দেশ্যে কইলো – “ ইয়া রাসুলাল্লাহ ! আপনি কেন এই সিল্কের জামা খরিদ করেন না যাতে গুরুত্বপূর্ণ কারও সাথে সাক্ষাত কালে কিংবা জুমআর খুতবাতে আপনি তা পরিয়া যেতে পারেন ? রাসুলুল্লাহ (সাঃ) জবাবে কহিলেন – “ এ পোশাক সেই পরবে যার আখিরাতে কোন অংশ নাই ( দুনিয়া যার কাছে প্রাধান্য পায় )” । পরে কোন এক সময় এক ইহুদী লোক রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে সিল্কের একটা কুর্তা উপহার দেয় । রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সেই কুর্তা ফেরত না দিয়া উমার (রাঃ) নিকট পাঠায়ে দেয় । এই ঘটনার পর উমার (রাঃ) নিজে আইসা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কি জিজ্ঞাসা করে – “ ইয়া রাসুলাল্লাহ ! আপনি যে জিনিস নিজের জন্য পছন্দ করেন না তা আমাকে কেন দিলেন ? “ জবাবে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কহিলেন – “ হে উমার ! আমি তোমাকে ইহা দিলাম যেন তুমি তা বিক্রি করে দিতে পারো কিংবা মুশরিক কাউকে দিয়ে দিতে পারো “। পরে উমার (রাঃ) কুর্তাটা মক্কার এক মুশরিক লোকরে দিয়া দেন । “ [১]

যে শাড়ি তুমি নিজের যইন্ন রাখবানা সেইটা কেমতে তোমার মুসলমান কোন বইনরে তুমি দিবা ?

মাঝ রাতে বিছানায় ঘুমন্ত জুবায়েরের মুখের দিকে চোখ ভর্তি পানি নিয়ে তাকিয়ে আছে রাহেলা । সেইদিনের ছোট্ট জুবু আজ কত বড় হয়ে গেলো, কুরআন পড়ে আবার শিখায় , জ্ঞানী মানুষের মত কত কিছু জানে । তার মত মূর্খের কিসমতে এমন সন্তান আল্লাহপাক দিয়েছেন ভেবে বারবার আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করলো ।

দুপুর বেলায় খুব মজা করে মেজবানি কায়দায় খাবার খেলো রাহেলা আর তার পরিবার । সন্ধ্যার পর জুবায়ের চলে যাবে । কি কি দিবে ছেলের সাথে মনে মনে লিস্ট করা শুরু করতেই খারাপ খবরটা আসলো তখন । দোতলার বেগম সাহেবের মেয়ে নীলাদ্রি আগুনে ঝলসে বার্ণ ইউনিটে ভর্তি । বৈশাখের প্রথম ভোরে গান গেয়ে সূর্য বরণ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার কথা নীলাদ্রির । মেইক আপ রুমে কে জানি সাজানো প্রদীপের একটা ডালা রেখে গিয়েছিলো । সেইখান থেকে অজ্ঞতা বশত আগুন লেগে যায় পুরো রুমে । নীলাদ্রি ওয়াশ রুমে থাকায় আটকা পড়ে যায় । সময় মত বের হতে না পারায় শরীরের আশি ভাগ আগুনে পুড়ে যায় ।

কাল রাতে যে মেয়েটা অগ্নিস্নানে ধরা (পৃথিবী) পবিত্র হোক – এই প্রার্থনার অংশ হবার জন্য গানের রেওয়াজ করে যাচ্ছিলো, আজ সেই অগ্নিই তাকে গ্রাস করে নিলো । রাহেলা মনস্থির করলো নিজের ঈমান আমলে আরও মনযোগ দিবে । যে জীবনটা আল্লাহপাক দিয়েছিলেন সেই আল্লাহপাকের নাফরমানি করতে করতেই যদি জীবনটা শেষ হয়ে যায় – এরচেয়ে বড় ক্ষতি একটা মানুষের জন্য আর কি হতে পারে !!!

রাহেলার হঠাৎ খুব করে শ্বাশুড়ির কথা মনে হচ্ছে । শ্বাশুড়িকে সে নামাযে দুই সিজদার মাঝখানে কাঁদতে কাঁদতে প্রায়ই বলতে শুনতো ‘ রাব্বিগ ফিরলি, রাব্বিগ ফিরলি …’ ।

হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ছোটা সিএনজির ভেতরে বসে থেকে এসব কথা ভাবতে ভাবতে ছেলেটার হাত দু’খানা চেপে ধরে রাহেলাও মনে মনে বলে উঠলো –

“ রাব্বিগ ফিরলি, রাব্বিগ ফিরলি …..”

[১] সহীহ বুখারি, ভলিউম-৭, বই নং-৭২, হাদীস নাম্বার-৭৩২

অগ্নি স্নান
– নুসরাত জাহান

(১৩/০৪/২০১৯)