অন্তর্জালে ভেজাল


ভোঁ ভোঁ আওয়াজে জানালার কাঁচ কাপছে। নীতি গল্পের বই ফেলে জানালার দিকে দৌড় দিলো। এরোপ্লেন দেখাটা ওর কাছে নেশার মতো।

“এই আপা! মিস করলি! প্লেনটা অনেক কাছ দিয়ে গেলো। প্লেনের উপর রোদে পড়ে কেমন চকচক করছিল।“ চোখ গোল গোল করে বলে নীতি।

চৈতি মৃদু হেসে আবার বইয়ে মুখ গোঁজে। ঈদের ছুটির পরই সেকেন্ড টার্ম এক্সাম। বাংলাদেশ এন্ড গ্লোবাল স্টাডিজে বেশ পিছিয়ে আছে। ছুটির মধ্যেই কাভার করতে হবে অনেককিছু।

বাথরুম থেকে বের হয়ে এসে ফোন হাতে নেয় অনীমা। চৈতির দিকে তাকিয়ে ফোঁড়ন কাটে, “কিরে আতেল কুমারী। আমার এসএসসি এক্সামটা কী তুইই দিবি নাকি।“ এসএসসি পরীক্ষার আর ৬ মাসও বাকি নেই অনীমার।

অসহায়ের মতো বই উলটে দেখায় চৈতি, “অনি! বিজিএস!”
“ও আল্লাহ! নাম নিস না! এই বই দেখলেও রাতে দুঃস্বপ্ন দেখতে পারি। তুই তো তাও সায়েন্সে ভালো। আমি যে গোল্লা পাইছি ম্যাথে প্রিটেস্টে। টেনশন লাগতেছে প্রচুর। এজন্যেই তো পাপাকে বললাম দশদিনের বন্ধ হলেও টিচারের ব্যবস্থা করে দিতে। বন্ধের মধ্যে ম্যাথস করা ছাড়া উপায় নাইরে বোনটি।“
“চাচা তো আমাদের সবাইকে ম্যাথ টিচারের কাছে পড়তে বললো!”
“আমি একা একা পইড়া পইচা মরবো, আর তুমি মজা করবা? বাঁচলেও একসাথে মরলেও একসাথে! হুহ!” খোঁচাখুচির সময় দুইজনই তুই থেকে তুমিতে নেমে যায়। কেন যেন মনে হয় এতে বিদ্রুপটা ভালো মতো করা যায়।
“ঐ যে মাদ্রাসাপড়ুয়া ভাইয়াটা, উনিও কিন্তু আমাদের সাথে পড়বে। জানো তো?” নীতি খুব আগ্রহ নিয়ে বলে। গ্রাম থেকে এক দুর্সম্পর্কের ভাই এসেছে। সেও এইবার অনীমার সাথে এসএসসি দিবে, মাদ্রাসা বোর্ডে যাকে বলে দাখিল।
“হ্যা! হ্যা! জানি! কথায় কথায় তারে ডাইকা আনো কেনো গো!” সন্দেহের চোখে তাকায় অনীমা।

অপমানে মুখের সব রক্ত গালে চলে আসে যেন ক্লাস ফাইভ পড়ুয়া নীতির। তোতলাতে থাকে,”অ…অনীমাপি বাআআজে কথা বলবা না একদম!” চৈতিও চোখ রাঙ্গায়, এসব ইংগিতপুর্ণ কথাবার্তা একদম ভালো লাগে না ওর।

ঝগড়ায় ইতি টানে অনীমা, “যাই হোক ভাই। ফেইসওয়াশ দিয়ে মুখ ধুয়ে আসছি। এখন আমাকে একটা সেলফি তুলতে দে।“ হিজাবটা গায়ে চাপিয়ে ফটোসেশন শুরু করে অনীমা।

বিরক্তির ভাবাব্যক্তি নিয়ে চোখাচোখি করে চৈতি, নীতি।
“সেলফি তুলে কী করিস এতো। ফেইসবুকে দিবি?” জানতে চায় চৈতি।
“দিলামই না হয়। সমস্যা কোথায়? আমার ফ্রেন্ডলিস্টে তো মেয়েরা সব। আর আমি তো হিজাব ছাড়া ছবি কোথাও দিচ্ছি না।“ অনীমা বিরক্তির সাথে ব্যাখ্যা করে।
“এইসব ইন্টারনেটের প্রাইভেসী জাতীয় কোনো বিষয়ই আমি বিশ্বাস করি না। যাই হোক! তোর পারসোনাল বিষয় কি করবি না করবি। কিছু বললেই তো তাকওয়া পুলিশ হয়ে যাবো, অথচ আগে বলতি, ‘মানুষ কেন ডান বাম কাত হয়ে ছবি তুলে! আমি জীবনেও দিব না!’’

“তোমরা দুইটা তো তা-ই, পুলিশ ছাড়া কে আর উনিশ শো কটকটি সালের কথা তুইলা আইনা খোটা মারে। আমি তোমাদের মতো এতো ভালো না বুঝলা? আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।“

চৈতি-নীতির চাচা আবরার পরিচয় করিয়ে দিলো আসিফ ইমরানের সাথে। একজন গণিতবোদ্ধা অথবা যোদ্ধাও বলা যেতে পারে। সাদা চুলের হাসিখুশি মানুষটার চোখে মুখে জ্ঞান ঠিকরে পড়ছে যেন। গনিতের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে ছাত্রদের কাছে বেশি-ই জনপ্রিয়। একইসাথে তিন ক্লাসের শিক্ষার্থীকে গাইড করা তার জন্যে কঠিন কিছু নয়। গণিতের প্রতি ভয় না, ভালোবাসা থাকা উচিৎ এই বিষয়ক লেকচার দিলেন দশ মিনিট। আবরার চলে যাওয়ার পর তার ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি মনোযোগী হলেন। ক্লাস টেনের মাসঊদ গ্রামের মাদ্রাসা পড়ুয়া,ঢাকার বাইরের মিলিটারি স্কুলে পড়া অনীমা আর ঢাকার একটা বাংলা মিডিয়ামে পড়া দুই বোন চৈতি-নীতি। নীতি আবার কুরআন হিফ্‌যের ছাত্রী,মাসঊদ ইতোমধ্যে একজন হাফেজে কুরআন।

“আমি আসলে কারো নামই মনে রাখতে পারি না। ইংরেজি বানানে নিজেদের নামটা বলো। আমি লিখে নিচ্ছি।“ সবার নাম টুকে নেয় আসিফ। “আশা করি এক সপ্তাহে তোমাদের নাম মুখস্থ হয়ে যাবে।“

জ্যামিতির প্রাথমিক ধারণা থেকে শুরু করে আসিফ। এতো চমৎকার পড়ানো নীতির মাথার জটও খুলে যায়, জ্যামিতি আর কঠিন লাগে না। হাই স্কুলের বাকি তিন ছাত্র-ছাত্রীকে পড়ানোর বেলায় গণিতবিদদের জীবনের মজার ঘটনা তুলে আনেন। মৌখিক প্রশ্নোত্তরে মাসঊদ আর চৈতি চুপ থাকে, অনীমা চটপট উত্তর দেয়।

“বাহ! ব্রাভো! তুমি আবরারের মেয়ে না? ওয়াসিমের মেয়েরা চুপ কেন? পড়াশোনায় কিন্তু ওয়াসিম আবরারের চেয়ে অনেক ভালো ছিল। তোমরা জানো নিশ্চয়ই আমি ওদের সিনিয়র ছিলাম। অনীমা মাথা ঢাকলেও ব্রেইনটা ঢাকা পড়েনি। আর তোমাদের কি মুখ ঢাকার সাথে সাথে মাথার বুদ্ধি কমে গেল? আর আপনার কি দাঁড়ির উকুন বুদ্ধি খেয়ে নিয়েছে?”

অনীমা ছাড়া বাকি তিনজন উত্তর দেয় না। মাসঊদ এমনিতেও কম কথা বলে। আর দুই বোন বাইরের কোনো লোকের সামনে সহজে তাদের চটপটে ভাব দেখায় না। শিক্ষকের খোঁচা মারা কথায় বিরক্ত লাগলেও পারস্পরিক চোখাচোখি ছাড়া আর কোনো অনুভূতির প্রকাশ করেনা ওরা দুজন।
“চৈতি কিন্তু আমার চেয়ে ম্যাথসে অনেক ভালো আঙ্কেল। এখন যদিও মুখে চাবি দিয়ে রেখেছে!” অনীমা সাফাই গায় চৈতির হয়ে।
“হুম! সংকোচ হচ্ছে হয়তো। ইজি হওয়া দরকার। নাহলে শিখতে পারবে না। তোমরা এক কাজ কর সামনে এসে বসতে পারো! দুইটা রো করলে মাসঊদ একদিকে তোমরা একদিকে।“
“না আঙ্কেল! এখানেই ঠিক আছি আমরা।“ পেছন থেকে দৃঢ় জবাব দেয় চৈতি।

“হাহা! বুঝতে পেরেছি। তোমরা তো আসলে ওয়াসিমের কড়া শাসনে আছো। নারীরা পেছনে থাকবে, পুরুষরা সামনে! ইসলাম কিন্তু আসলে এতো কঠিন না বুঝলে! নারীরা এখন পুরুষদের সাথে সমান তালে এগিয়ে চলছে। আর ইতিহাস পড়লে জানবে আয়েশা ছিলেন একজন বীর যোদ্ধা, জামিল যুদ্ধের নেত্রী। আর খাদিজা ছিলেন পাকা বিজন্যাস ওম্যান। মুহাম্মদ তো নানা বয়সের মেয়েদের বিয়ে করেছিলেন, আয়েশার বয়সে বিয়ে তো ভাবাই যায় না এখন। এখনকার যে কেউ এমন বিয়ে করলে তো পেডোফাইল ভাবতো লোকে…”
মুহাম্মদ নামটা নেয়ার সাথে সাথে জোরে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে উঠে মাসঊদ।

মুখ খুলে যায় চৈতির, “আসলে আঈশা (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা) যুদ্ধ করতে যাননি। যুদ্ধ যাতে না হয় মুসলিম উম্মাহ্‌র মা হিসেবে গিয়েছিলেন শান্তির মিশন নিয়ে। সেখানে পরে কিছু খারাপ লোকের কারণে যুদ্ধ লেগে যায়। কিন্তু তিনি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন এমন ঘটনার সত্যতা যাচাই করার বিষয়। আর খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা) ইনভেস্টর ছিলেন। তার নিজস্ব লোক ছিল ব্যবসা পরিচালনা করার।“

হেসে দেয় আসিফ ইমরান। “বাহ! এইতো তোমার মুখ খুলেছে। এখন নিশ্চয়ই প্রশ্নের উত্তর দিতে সমস্যা হবে না!”

নীতিকে সুডোকু সমাধানে বসিয়ে দেন আসিফ, আর বাকিদের জ্যামিতিক প্রমাণ। প্রমাণ সবার আগে ঝটপট শেষ করে মাসঊদ। মুখে মুখে অনেক প্রশ্ন করেন আসিফ। মুখচোরা ছেলেটা সব জবাব দিতে পারেনা।

“কি ব্যাপার হুজুর! মুখস্থ বসিয়ে দিলেন নাকি? অবশ্য মাদ্রাসা শিক্ষার অবস্থা তো জানি! লুতের জাতির কার্যকলাপের বাইরে কিছু হয় কিনা সন্দেহ! “
বিস্ফোরিত চোখে তাকায় মাসঊদ!
“না! না! তোমায় বলছি না। তুমি হয়তো কুরবানি ঈদের গরুর চামড়ার টাকা তোলার চিন্তায় ব্যস্ত। গণিত মাথায় ঢুকছে না! যাই হোক। আজকের মতো এখানেই শেষ করছি। তোমরা তোমাদের বুয়া খালাকে বলবে আমার জন্যে ভালো এক কাপ কফির ব্যবস্থা করতে। লাইব্রেরী রুম থেকে বেরিয়ে গেস্টরুমের দিকে রওনা দিল আসিফ। পেছনে মাসঊদও গেলো। ডাবল বেডের গেস্টরুমে মাসঊদও সংগী।

“এই আপা পেডোফাইল মানে কিরে?”

নিজেদের রুমে ঢুকতেই নীতি প্রশ্ন ছুড়ে দিল।
রাগে কাঁপছে চৈতি, নীতির প্রশ্নের তোয়াক্কা করলো না। “এই ফালতু ব্যাটার কাছে ম্যাথ করবো না!”

“টিইইইট টিইইইট! কী ব্যাপার! গীবত এলার্ট কাজ করতেছে না! ইসলামের ব্যাপারে হয়তো সে তেমন জানে না। আমরাই কি জানতাম নাকি? আমরা তো গণিত শিখতে গেছি, ইসলাম না। এতো রাগার কি আছে? “ অনীমা ঠান্ডা করার চেষ্টা করে।

“ অনীমাপি তুমি দেখলে না রাসূলুল্লাহ্‌র নামের শেষে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনি। এতোটুকুও কি জানবে না? আর লুত, আয়শা, খাদিজা শুধু নাম ধরে কেউ বলে? আদব নাই কোনো? মাদ্রাসা নিয়ে এসব কী বললো! ছি! সূরা আন্‌নিসার তাফসীরে পড়েছি, দ্বীন নিয়ে কোথাও উলটাপালটা বললে ওখানে বসে না থাকতে! আচ্ছা! চামড়ার ব্যাপারটা কি আপা?।“

“দেশের বেশিরভাগ মাদ্রাসারই স্পন্সর থাকে না। ঈদুল আযহায় ছাত্ররা কুরবানী করে চামড়াটা হাদিয়া পায়। সেই চামড়া বিক্রি করে মাদ্রাসায় বেশ একটা এমাউন্ট আসে। নিজেদের ফ্যামিলির সাথে ঈদ না করে কত বড় ত্যাগ স্বীকার করে ছেলেগুলো! আর তাই নিয়ে বিদ্রুপ! উফ! আজই বাবাকে ফোন দিয়ে বলবো! আমাদের যদি ম্যাথ করাতে চায় তো এইসব ফালতুমি বাদ দিতে হবে! এই লোক মুসলিম কিনা আমার সন্দেহ লাগছে!”

“বাহ! সূরা হুজুরাতের শিক্ষা মুহূর্তে ভুলে গেলি? এতো বড় ধারণা করা কী ঠিক হচ্ছে? জ্যাঠামণিকে ফোন দিলে একবারে ম্যাথ শেখা বন্ধ। সত্যি বলতে আজকের ক্লাসটা আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছে। আমি পাপাকে বলে দিব যেন উনি ইসলাম নিয়ে বেশি কথা না বলে। পাপা বুঝিয়ে বলবে ইন শা আল্লাহ!”

অনীমার কথায় চুপ হয়ে যায় চৈতি।

“এই আপা তোদের তো আসল কথা বলিই নাই। নিচের ভাড়াটিয়ারা একটা সুন্দর ছাগল আনছে, কালো কুঁচকুঁচে গায়ের রঙ। রোদ পড়লেই চকচক করে কালো লোম। আমাদের গরু দুইটার মতো মুডি না। পাতা দিলেই খায়। চল না দেখতে! তবে কি জানিস আমাদের গরুদের চোখ দুইটাই বেশি সুন্দর, খুব মায়াবি। ”

“ নিচতলার সেই ভাইয়াটা থাকবে না?” চৈতি ইতস্তত করে।
“ হ্যা! সেতো সারাদিন গরু ছাগলের সাথেই থাকে!”
“হাহা! তাইলে যাওয়া যাবে না! অনীমার দিকে ড্যাবড্যাব করে দৃষ্টি দিবে। আমরা তো আর অনীমার চেয়ে যোজন যোজন দূরে যাইতে পারবো না! অস্বস্তিকর!”
“আই ডোন্ট কেয়ার ইউ নো! কোনদিন যে ক্যারাটের কোপ দেই বেটারে! দেখ না!”
“টিইইইইট! টিইইইট!” মুখ দিয়ে যান্ত্রিক গীবত এলার্ট বাজালো নীতি। “যাই বলো, ভাইয়াটা ভালো আছে। আমাদের গরুকে প্রায়ই এটা সেটা খাইতে দেয়।“

“মুটি তুই থাম তো! আসিফ স্যার যে ম্যাথ ক্লাবটার কথা বললো ওটার নাম যেন কি ছিল? আমি ঐ গ্রুপে জয়েন করি দাঁড়া!”
“আমাকে মন্দ নামে ডাকবা না আপি।“ গাল ফুলিয়ে জানালার ধারে গিয়ে বসল নীতি। মা-বাবার সম্পর্কের অবনতির পর খাওয়া নিয়ে অবসেশন হয়েছে ছোট্ট মেয়েটার।

কুরবানীর গরু রেডি হয়ে গেছে প্রায়, একটু পরই নীতির চাচীমণি দম বিরিয়ানি করবেন।

একটা গরু এখনো কুরবানি দেয়া হয়নি। ঈদুল আযহা ৪দিন থাকে, ঐ গরুটা ৩য় দিন কুরবানী দেয়া হবে। পুরোটাই গ্রামের মাদ্রাসায় যাবে। ঈদের সলাহ পড়ে ফিরলেও আনন্দ নেই বাড়িতে, সবার মন অস্থির। অনীমার কী হয়েছে কিছু বুঝছে না কেউ। ঘন ঘন বাথরুমে যাচ্ছে। চোখ মুখ ফোলা অতিরিক্ত কান্নার জন্যে। বমি করতে গিয়েও করছে না। দিনে কয়বার গোসল করছে তার ইয়ত্তা নেই।

অনীমার মা দুশ্চিন্তায় অস্থির। শেষমেষ চৈতির কাছে সব খুলে বলেছে অনীমা।

“ তোরা তো বলবি আমি ফেইসবুকে ছবি দেই দেখে এই অবস্থা। কিন্তু আমার ‘আইএমও’ এ সব বাজে বাজে ম্যাসেজ আর পিকচার আসতেছে। আমার কাঁটা মাথা বসানো খুব বাজে ছবিতে! আমি রেস্পন্স না করলে নাকি এগুলো আরো স্প্রেড করবে! আমি জানি এগুলো আমার ছবি না। কিন্তু এগুলো যদি স্প্রেড হয় সব মানুষ কী বুঝবে?”

“এই আমাদের কারাটের ব্ল্যাক বেল্ট ওউনার? শক্ত হ অনি। কার কাজ এটা আমাদের বের করতে হবে! ফোন নঃ দে! বাবা ট্র্যাক করে দিবে।“

“প্লিজ না! জ্যাঠামণি এমনিই বাবার সাথে ঝগড়া করে কেন আমাকে ফোন দেয়া হয়েছে। তুই তো জানিস বাবাকে আমাকে যথেষ্ট লিবার্টি দেয়। আমিও সেটার অপব্যবহার করি না। বাবা অনেক ছোট হয়ে যাবে রে!”

“এটলিস্ট চাচ্চুকে জানাতে দে? আমাদের পক্ষে নিশ্চয়ই নম্বর ট্র্যাক করা সম্ভব না।“
নিমরাজি হলো অনীমা। আবরারকে সব বলার পর তার মুখের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। নিজের মেয়ের অসম্মান কে সইতে পারে! লোকলজ্জার ভয়ে থানায় জিডি না করে ভেতরে ভেতরে খোঁজ নেয়া যায় কিনা ভাবছিল সে। হঠাৎ মনে পড়লো তারই ব্যাচমেট একজন পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল। ফোন দিয়ে বন্ধুকে সব খুলে বললো। অতি দ্রুত জানানোর আশ্বাস দিল আইজি বন্ধু।

ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই ফোন আসলো। ফোনের জিপিএস অফ করার থাকলেও ট্র্যাক করা কোনো বিষয় না আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্যে। চাঞ্চল্যকর তথ্য দুইটা, লোকেশনটা আবরারদের বাড়িতেই দেখাচ্ছে। আর যে ফোন নম্বর দিয়ে বাজে ছবি পাঠানো হচ্ছে সেটা একজন বয়স্ক মহিলার ন্যাশনাল আইডি কার্ড দিয়ে তোলা।

“বন্ধু! তোমরা তো পুলিশি হেল্প নিতে চাওনা লোকলজ্জার ভয়ে। কিন্তু এইভাবে কত প্রাণ যে ঝরে যায়!” আইজি আব্দুল কুদ্দুস বললেন।

“জানিরে। একবারে তো বসে নেই। জিডি করছি না হয়তো,কিন্তু তোর হেল্পই তো নিচ্ছি। মহিলাটার নাম পরিচয় জানাতে পারবি? “

“সে আমি খোঁজ নিয়েছি। মনে হচ্ছে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের হচ্ছে। সিমটা ইউজ করত ভদ্রমহিলার মেয়ে। ১৪ বছরের মেয়েটা আত্মহত্মা করেছে মাস ছয়েক হলো। কেন করেছে কেউ জানেনা। কেইসটা ক্লোজ করতে হয়েছিল সেই লোকলজ্জার কারণেই। মা-বাবা অভিমান বলে চালিয়ে দিতে চাইলো!”

বুকের মাঝে ধক করে উঠল আবরারের। একমাত্র মেয়ে অনীমা। প্রাণবন্ত সাহসী মেয়েটাকে হারাতে দিবে না সে কোনোভাবেই। পরে কথা বলবে বলে ফোনটা রেখে দিল সে।

স্ত্রী সিমিকে কিছুই বলা যাবে না, দুশ্চিন্তার ভার একা বয়ে বেড়াতে হবে। অনীমাকে যেভাবে হোক সাহস দিতে হবে। এটা বকার সময় না। আর সত্যি বলতে নিজের ছবি কোথাও দেয়াকে অপরাধ মনে করেনা আবরার। ফেইসবুক ফ্রেন্ডলিস্টের কেউ নম্বর নিয়ে IMO তে জ্বালাচ্ছে কি? ভালো একটা গোসল দিয়ে কড়া এক কাপ চা খেয়ে মিটিং এর জন্যে সবাইকে লাইব্রেরি রুমে ডাকলো আবরার।

সবাই বলতে অনীমা,চৈতি, নীতি আর গণিত শিক্ষক আসিফ ইমরান। বিজ্ঞের মতো পরামর্শ দিতে পারবেন আসিফ ভাই, এমনটাই আশা আবরারের। সেদিন ইসলাম নিয়ে বাচ্চাদের সাথে একটু সমস্যা হয়েছিল এটা ঠিক। আসিফ ইমরান ইসলামকে ভিন্ন চোখে দেখেন।

পরবর্তীতে বাচ্চাদের খাতিরে নিজেকে শুধরে নিয়ে আর কিছু বলেননি, ওরাও গণিত শিখছে খুব আগ্রহ নিয়ে। শুধু গণিত না, দেশের সামাজিক,রাজনৈতিক যেকোন সমস্যা নিয়ে তিনি সবসময় সোচ্চার।

কিশোর-কিশোরীর আস্থার জায়গা তিনি। কিশোরীরা যে সমস্যা মা-বাবাকে বলতে পারেনা তা হয়তো এই পঞ্চাশোর্ধ্বকে খুব সহজে বলে ফেলে।

“তোমরা কাকে সন্দেহ করছো?” আসিফ জানতে চাইলেন!

“দেখেন আসিফ ভাই! লোকেশন আমাদের বাড়িতে দেখাচ্ছে। ভাড়াটিয়াদের দিকে সন্দেহ চলে যায়!”

“চাচ্চু ঠিক বলেছো! ঐ যে নিচতলার ভাইয়াটা কেমন করে অনীমাপির দিকে তাঁকায়!” নীতি অপরাধী ধরার আত্মবিশ্বাসে বলে।

“তাকালেই কেউ অপরাধী হয়না নীতি! আমাদের মনে রাখতে হবে, Everyone is innocent until proven guilty!” সতর্ক করে চৈতি।

“আমি এই ব্যাপারে চৈতির সাথে একমত। তাকালেই কেউ অপরাধী হয় না। এমন তো হতে পারে যে তাকায় না সমস্যাটা তার। মনের মধ্যে পাপ না থাকলে তাকাবে না কেন?” আসিফ ইমরান জোর দিয়ে বলেন।

“বুঝলাম না! কী বলতে চাচ্ছেন!”

“এই সন্দেহটা আমারো হয়েছে স্যার!” অনীমা সায় দেয়। “ আমি সামনে গেলেই মাসঊদ পারলে লাফ দিয়ে সরে যায়। অথচ চৈতি ,নীতির বেলায় নর্মাল থাকে। আমি কি বাঘ না ভল্লুক?”

“ কী বলছিস! ভাইয়া আমাকে ফোন দিয়ে মাসঊদকে আনিয়েছে। ওর ম্যাথের ভিত গড়ে দিতে আমি আসিফ ভাইয়ের কাছে দিয়েছি। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য গরুর মাংস মাদ্রাসায় নিয়ে যাবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাদ্রাসাটা, কোনো রকম ডোনেশান যায় না। খাওয়ার মান লো। এইবার দুইটা গরু এজন্যেই নেয়া। ছেলেটা যেমন মেধাবী, তেমন ভদ্র…”

“আবরার! তোমার আর কী বয়স, কয়টা মানুষকে বাইরে থেকে দেখে চিনতে পারবে! ওয়াসিমটা আজও আবেগে দৌড়ায়! তুমি তো জানোই ওর সাথে আমার তেমন বনেনা! রেগে যায় কেমন আমাকে দেখলেই। এজন্যেই না ওকে না জানিয়ে আমাকে মেহ্‌মান করলে! লম্বায়ই বড় হয়েছে ছেলেটা! বুদ্ধি কিন্তু ঠিকই হাটুতে!”

“ছেলেটা অবশ্য দুইদিন ধরে আমাকে কী যেন বলতে চাচ্ছে! আম্‌তা আম্‌তা করে না বলে চলে যায়! আমি তো ভাবছিলাম লাজুক বলে বলতে পারছে না!”

“আরে! কিসের লাজুক! দেখো তোমার মেয়ের পাণিপ্রার্থী কিনা!”

কথা বেশি বাড়াতে দেয় না চৈতি, “আঙ্কেল কার বুদ্ধি হাটুতে সেটা সময়ই বলে দিবে। আমাদের মিটিং কি শেষ হয়েছে চাচ্চু? তিনটা নাম সন্দেহের তালিকায় রাখো চাচ্চু। লাল কালিতে টাইপ করে রেখে দাও, যথাক্রমে আসিফ ইমরান, মাসঊদ, ভাড়াটিয়ার ছেলে!”

কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঠাস করে উঠে চলে যায় সে। এমন বেয়াদবিতে সবাই বিব্রত!

রুমে এসেই বাইরে যাওয়ার জন্যে রেডি হতে বলে তিন বোনকে। চাচাকে বুঝিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হয় ওরা, ড্রাইভিং এ আবরার, গন্তব্য আত্মহত্যাকারী কিশোরী শামিমার বাসা।

গাড়ি থেকে নেমে কিছু ফলের ব্যাগসহ শামিমার বাসার সামনে এসে দাঁড়ায় ওরা চারজন। আবরার যেখানে সেখানে ছাড়তে পারে না ওদের, তাই সাথে এসেছে। পুলিশের সাহায্যে ঐ বাসায় যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করে নিয়েছে। বেল দিতেই একজন মধ্য বয়স্কা মহিলা খুলে দিলেন, আবরার পরিচয় দিলেন।

তিনটা হিজাবি মেয়ের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন তিনি। নীতি,চৈতি নিকাবসহ বোরকা পরে আর নিকাব ছাড়া শর্ট বোরকা পরে অনীমা। ভদ্রমহিলা শামিমার মা। ফলগুলো তার হাতে দিল নীতি। নীতির মুখটা দেখার পরই মহিলা যেন পালটে গেলেন। শামিমার রুমে ঢুকতেই বিষয়টা বুঝতে পারলো ওরা, দেয়ালে ঝুলানো শামিমার চেহারার সাথে নীতির বেশ মিল।

“আমার মেয়েটা খুব মেধাবি ছিল। কী অভিমানে যে চলে গেল আল্লাহ্‌ ভালো জানেন…আপনারা বসুন। আমি চা করে আনি।“

শামিমার মা চলে যাওয়ার পর পুরো রুমটা মনোযোগ দিয়ে দেখে ওরা। প্রতিদিন ঘরের আসবাবপত্র মোছা হয় স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। কাপড়ের আলমারি, দেয়াল, বুকশেলফে ক্রেস্ট আর মেডেলের ছড়াছড়ি। বড় একটা ছবির এলবাম রাখা টেবিলের উপর। ছবি দেখে ওরা। কড়া লিকারের ঘন দুধ চা আনে শামিমার মা, সাথে বাচ্চাদের জন্যে ম্যাংগো মিল্ক শেক আর ওভেনে গরম করা প্যাটিস। খেতে খেতে শামিমার মা অনেক গল্প করেন। শামিমা খুব ইন্ট্রোভার্ট ছিল। মাকে কোনো কষ্ট বা সমস্যার কথাই কখনো জানাতো না। গল্পে ছেদ পড়ে আবরারের ফোনের আওয়াজে। আবরারকে ফোনে খুব উত্তেজিত মনে হয়।

“ এই তোরা জলদি চল। প্রবলেম সল্ভ হয়েছে! উঠি আপা। আপনাকে বিরক্ত করলাম। আবার কোনোদিন ওরা আসবে।“ কথা বাড়াতে না দিয়ে ওদের নিয়ে গাড়িতে উঠল আবরার।

“চৈতি, তুই অবশ্যই আসিফ ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চাইবি। মাসঊদের ব্যাগে তোর চাচীমণি আজে বাজে পত্রিকা পেয়েছে। তুই আবার ভাবিস না যে আসিফ ভাই ঢুকিয়ে দিয়েছে। তোর চাচীমণি নিজ সন্দেহেই ব্যাগ দেখেছিল।“

চৈতি গম্ভীর হয়ে গেল। “চাচ্চু! তুমি তোমার আইজি বন্ধুকে পুলিশ পাঠাতে বলো। মেয়েদের উত্যক্তকারীদের ছেড়ে দেয়া উচিৎ না! জেলের ভাত একটু হলেও খাওয়ার দরকার আছে।“

“ঠিক বলেছিস! আমার মেয়ের সাথে ফাইজলামি!“

অনীমার খুব রিলাক্স লাগছে।
খারাপ লোক সব জায়গায়ই আছে। বারসিসার গল্প পড়েছে নীতি। কিন্তু মাসঊদ ভাইকে ভালো মানুষ ভেবেছিল ও। প্রচন্ড মন খারাপ লাগছে ওর।

পুলিশ এসেছে, সাইবার ক্রাইমকে এখন যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটা খুব কঠোর। আইজি আব্দুল কুদ্দুস কিছুটা অবসর সময় থাকায় বন্ধুর সাথে দেখা করতে নিজেই চলে এসেছেন, সাথে তার বাহিনী।

মাথা নিচু করে ছলছল চোখে বসে আছে মাসঊদ। আবরারের ইচ্ছা করছে কষে একটা চড় মারতে। আসিফ ইমরান লাগেজ নিয়ে রেডি, গণিতের উপর একটা কনফারেন্সের কল পেয়েছেন ইন্ডিয়া থেকে। জরুরি ভিত্তিতে যেতে হচ্ছে তাকে। ভিসা আগেই করা ছিল। বসেছেন আবরারের অনুরোধে। চৈতি তার কাছে ক্ষমা চাইবে সবার সামনে। বয়স্ক একজন মানুষকে সবার সামনে অপমানের শাস্তি এমনটাই হওয়া উচিৎ। বেয়াদবি এই পরিবারে একদমই সহ্য করা হয় না। মেয়েরাও সবাই ভদ্রই আছে। তবে মাঝে মাঝে বিগড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু না।

চৈতি মুখ খোলে, “অনীমা, তোর মনে আছে আইএমও তে ম্যাসেজগুলো আসা শুরু হয়েছে আমাদের গণিত ক্লাসগুলোর পরপরই। আর গণিত ক্লাসে আসিফ ইমরান আমাদের নাম বানানসহ লিখে নিয়েছিল?”

চৈতির ব্যবহারে সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। স্যার ডাকার প্রয়োজনটাও বোধ করছে না!

“ কি একটা ম্যাথ ক্লাবে জয়েন করেছিলি। সেখান থেকে কয়টা নতুন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেয়েছিস?”

অনীমা ভ্রু কুঁচকে জবাব দেয়, “কিছু ছেলে রিকোয়েস্ট দিয়েছিল। আর গণিত কন্যা নামে একজন। মেয়ে দেখে এড করে নিয়েছি। অনেক পুরানো মেম্বার, তাই ফেইক প্রফাইল হওয়ার সম্ভাবনা কম মনে হয়েছে।“
“তোর ফেইসবুকে কি ফোন নম্বর দেয়া আছে?”

“আছে। তবে ফ্রেন্ডলিস্টের বাইরে কেউ দেখতে পারে না। আর তুই গণিত কন্যাকে সন্দেহ করছিস কেন? ওর সাথে আমার তেমন একটা কথা হয়নি।“

“এগুলো আবোল তাবোল শোনার জন্যে কি বসে আছি আবরার?” বিরক্তিতে বলে আসিফ ইমরান।

“চাচ্চু আমাকে একটু সুযোগ দাও কথা বলার। তুমি তো জানোই আমি ঠান্ডা মাথায় অযৌক্তিক কথা বলবো না। সেদিন বাবার বুদ্ধি হাটুতে বলায় হয়তো আমার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। তারই খেসারত হিসেবে হয়তো মাসঊদ ভাই আসামী হয়ে গেল। বা এমনিও হতো হয়তো। যাই হোক, আমাকে একটু কথা বলতে দাও।“

রাজি হয় আবরার। চৈতি আবার শুরু করে, “শামিমার পুরো নাম, স্কুল, ছবি সবই তো আমাদের জানা। একটু সার্চ দে তো অনীমা ফেইসবুক প্রফাইলটা পাস কিনা।“
দুই মিনিটের মধ্যে বের করে ফেলে অনীমা। ইতস্তত করে অনীমা,”মিউচুয়াল ফ্রেন্ড গণিত কন্যা।“
“যা ভেবেছিলাম। শামিমার বাসার মেডেলগুলো দেখেই আমার মাথার সব জট খুলে যায়। মেয়েটা ম্যাথ অলিম্পিয়াডে ন্যাশনাল এওয়ার্ড পাওয়া ছিল…”

কথা কেড়ে নেয় আসিফ ইমরান, “ফাইজলামি পেয়েছো! এই মেয়ে! এই! আমার গ্রুপের মেম্বার ওদের ফ্রেন্ড হলেই আমার কি? আর কিসব শামিমা টামিমা করছো?”

“ওহহো! সরি আংকেল! আপনার স্মৃতি ফিরিয়ে আনি। শামিমা এই বছরের শুরুর দিকে সুইসাইড করা একটা মেয়ে।“ বাইরে যাওয়ার সময় যে পার্সটা নেয় সেখান থেকে বের করে দেয় ছবিটা। “দেখেন তো আংকেল মনে পড়ে কিনা শামিমাকে। শামিমার আম্মুকে সরি বলতে হবে। না বলে তার মেয়ের ছবি এনেছি। তবে তার মেয়ের ইন্ডিরেক্ট খুনির সাথে ছবি তিনি হয়তো কালেকশানে রাখতে চাইবেন না।“

সবাই চমকে যায়। শামিমার সাথে আসিফ ইমরানের হাস্যোজ্জ্বল ছবি।

“খুব সম্ভবত আমাদের গণিতবিদ আসিফ ইমরান একজন পেডোফাইল, মানে যারা ছোটদের প্রতি কামনা অনুভব করে। গণিত বুঝানোর ছুতোয় কত মেয়ের জীবন এমন করেছে কে জানে। শামিমা খুব সম্ভবত তাঁর দ্বারা এতোটাই পর্যদুস্ত ছিল যে সিমটা পর্যন্ত দিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।“

মাথা নিচু করে রাখে আসিফ ইমরান।
“ছিহ! …কিন্তু ম্যাগাজিনগুলোর ব্যাপারে কী বলবে আপু?”

“চাচীমণিকে ম্যাগাজিন আনতে বলো!”

ভেতরের রুম থেকে চাচী বের হয়ে আসেন,”আরে আমি তো পুড়িয়ে ফেলেছি। এতো আজেবাজে জিনিস,চোখে দেখা যায়! “
আবরার ক্ষেপে যায়, “কি বলে! আলামত সব!”

“আমি কি জানি নাকি তোমরা বাসায় পুলিশ আনবে। তোমাদের তো খালি লোকলজ্জার ভয়“ টিপ্পনি কাটে সিমি।

“চাচীমণি শুধু একটা কথা বলো। ওগুলো কি দেশি সস্তা ম্যাগাজিন, নাকি বিদেশি দামি ম্যাগাজিন?”

“হুম। দামি শিওর আমি। বিদেশীই হবে।“
“এতোটুকু সবার বুঝা উচিৎ যে মাদ্রাসা পড়ুয়া একজন ছাত্রের এগুলো এফোর্ড করার ক্ষমতা থাকে কিনা।“

আইজি আব্দুল কুদ্দুস মুগ্ধ শ্রোতার মত হাটুর বয়সী একজনের ক্রাইম এনালাইসিস শুনে যাচ্ছেন। একবারও নিকাব করার মেয়েটার দিকে না তাকিয়ে শুনছেন, নিকাবি মেয়েদের দিকে অতি সম্মানে চোখ তুলে তাকাতে পারেন না তিনি।
“তাহলে আমাকে দেখলেই কেন মাসঊদ ভাই লাফ দিয়ে সরে যেতো আর বাবাকে কি বলতে চাইতো।“ অনীমা জানতে চায়।
“খুব সম্ভবত তুই নিকাব করিস না, চোখের পর্দার জন্যে দ্রুত সরে যেতো। মাসঊদ ভাই দয়া করে ক্লিয়ার করেন।“

“জ্বী। আপনি ঠিক বলছেন। আর চাচাকে আমি আসিফ স্যারের ব্যাপারেই বলতে চাইছিলাম। উনি যদি ভেজেটেরিয়ান হয়ে থাকেন তো বাসায় মাংসের বার্গারের ডেলিভারি আসে কেন? আর বিফ না দিয়ে কেন চিকেন দেয়া হইলো এই নিয়ে চিল্লাচিল্লি করেন কেন? রাত জেগে লাউডস্পিকারে বাজে মুভি দেখতেন আমার ইবাদতে সমস্যা হতো।“ অকপটে বলে দেয় মাসঊদ।

“তুমি আগে বলোনি কেন মাসঊদ। তাহলে তো তুমি অনীমা দুজনই অনেক আগেই হেনস্থা থেকে বেঁচে যাইতা। আসিফ ভাই তাইলে আপনার পশু প্রেমের এই অবস্থা! আমার কিছু বলার নাইরে আব্দুল কুদ্দুস। তুই এই বেটাকে লকআপে ভর।“

“চাচ্চু তুমি হয়তো বাবাকে জিজ্ঞেস করতে পারো। আমার ধারণা বাবা এই লোকের আসল চেহারা জানে।“

“হুম এখন আমারো তাই মনে হচ্ছে।“ আবরার সায় দেয়।

“আর আসিফ ইমরান আপনাকে বলি। রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চিন্তাশীল কেউ কোনোদিন পেডোফাইল ভাববে না। কারণ তিনি বিয়ে করতেন, যা জায়েজ কাজ। আর সেক্সুয়াল এবিউজের স্বীকার কোনো মেয়ে কোনোদিন স্বাভাবিকভাবে ভাবতে চলতে পারে না। সেখানে আমাদের মা আঈশা (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা) ছিলেন একজন স্বতঃস্ফূর্ত মেধাবী হাদীস বর্ণণাকারী। এরপর ইসলামকে অবমাননা করার আগে ভাববেন আশা করি। আর মাদ্রাসাগুলোতে যেমন সমকামীতার প্রকোপ আছে, যেকোনো আবাসিক প্রতিষ্ঠানেও আছে। শুধু ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে লুতের (আলাইহিস সালাম) জাতির অপরাধের দায় দিলে হবে না। আর মাদ্রাসার এই করুণ দশা খুব দ্রুত কাঁটবে ইন শা আল্লাহ, বাঙালি মুসলিম উম্মাহ দ্রুত সচেতন হবে ইন শা আল্লাহ।“ চৈতি শেষ বাণীটা দিয়ে দেয়।

“বাহ! মা শা আল্লাহ! ওয়াসিফ ভাইয়ের বড় মেয়ে এ?” সপ্রশংস দৃষ্টিতে জানতে চান আব্দুল কুদ্দুস। “এতো দেখা যায় আমাদের ভাতে মারবে! থাক দুশ্চিন্তা না করি। রিযিকের মালিক আল্লাহ!”

লাগেজ চেক করে শামিমার সিমসহ সেটটা উদ্ধার করে পুলিশ। হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে পুলিশের গাড়ির দিকে নেয়া হয় আসিফ ইমরানকে। পুরো চুপ হয়ে গেছে ‘ভেজেটেরিয়ান’ আসিফ ইমরান। গাড়িতে উঠানোর আগে কুরবানীর গরুটা তেড়ে উঠে হঠাৎ লাথি মারে আসিফকে। পুলিশরা দুই দিকে লাফ দেয়, মাটিতে পড়ে গোঙ্গাতে থাকে অপরাধী।

“গরুটা দেখি মানুষ চিনে! দেখেছিস আপা! আমাদের গরুগুলো কি মেধাবী!” নীতির কথায় সবাই হেসে দেয়।

“আমারও তোদের মতো নিকাব করা উচিৎ?” বাংক বেডে গড়ানো অনীমা জিজ্ঞেস করে।

“দেখ নিকাব ফরয কিনা এ নিয়ে মতভেদ আছে। তবে উত্তম যে এই নিয়ে কারো সন্দেহ নেই। নিলে চিন্তা করে নিবি। কিন্তু আমি অবশ্যই বলব ফেইসবুকে কখনোই ছবি দিবি না। ফেইসবুক অথরিটির কাছে ছবি জমা হয়। আর ফ্রেন্ডলিস্টের চেনা মেয়েরাও অনেক সময় নীতিহীন হয়।“

“হুম ছবি আমি অনেক আগেই সরিয়েছি…” কথা শেষ করার আগেই নীতি দৌড়ে আসে।
“এই আপা। মা ফোন দিয়েছে দাদীমণির ফোনে।“

চৈতি ছুটে যায়। মা এবার মামার সাথে হজ্জে গিয়েছেন। হজ্জ শেষ মায়ের ফ্লাইট আগামীকাল।

ফোন ধরতেই মা অভিবাদন জানালো টিম প্রত্যুৎপন্নমতির ২য় কেইস সফলভাবে সমাধানের জন্যে।

“মা বাদ দাও ওসব। আগে বলো, আল্লাহ্‌র কাছে দুআ কবুলের স্থানগুলোতে বেশি করে দুআ করেছো তো যেন নীতির চাওয়াটা পূরণ হয়?”

এবার মা-ই প্রসংগ ঘুরায়। নীতির চাহিদাটা আর কিছুই না। মা-বাবার মধ্যে সম্পর্ক যেন আগের মতো হয়, একবাড়িতে সবাই আবার থাকতে পারে তাই চায় ছোট্ট মেয়েটা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চৈতি, অপেক্ষার পালা কবে শেষ হবে! হজ্জটা যদি মাকে বদলে দিত!

অন্তর্জালে ভেজাল
উম্মে লিলি

অগাস্ট ১৪, ২০১৯ইং