অবাক কিশোর

সানজিদা সিদ্দিকী কথা
১.

আমরা প্রায় একশ জনের মত। আমাদের সামনে বিশাল নদী। নদীর নাম ড্রাগন। এর ড্রাগন নামকরণের ইতিহাস নিয়ে লোকমুখে নানান কথা প্রচলিত আছে। লোকে বলে এই সর্বনাশা নদীতে কেউ পড়ে গেলে নাকি এর পানি গুলো ড্রাগনের মত আকৃতি ধারন করে তাকে গিলে খায়।

এই একশজন মানুষকে এই নদী পার করে আমার ওই পাড়ে নিয়ে যেতে হবে। সব্যসাচী গ্রুপ আমাকেই কেনো জানি দায়িত্ব দিয়েছে এদের পার করবার। 

নদী পার হয়ে ওই পারে আছে আহুতি নামের চর। সেই চরে আছে গুপ্ত গুহা। সেখানে কাড়ি কাড়ি স্বর্ন লুকানো। রাজা রামগোপালের গুপ্তধন। কোনভাবে নদীটা পার হয়ে গেলেই সবাই কাজে নেমে পড়বে। এত এত স্বর্ন এগুলো বয়ে আনতে মানুষ লাগবে বৈকি।
বিপত্তি বেধেছে কিসে করে যাবো সেটা নিয়ে। প্রায় দুই ঘণ্টা বায়ান্নো মিনিট পেরিয়ে গেছে। কোন বড় নৌকা দেখা যায় নি। দু চারটে ডিঙি নৌকাতে করে চার পাঁচ জন করে লোক আসা যাওয়া করছে।

এত লোক আমি কিভাবে নিই! আমার স্বর্নের বাড়ির প্ল্যানটা বোধহয় নদীর এপারেই রয়ে গেলো।
সুহাস চেচিয়ে উঠলো। স্যার দেখুন জলদি। একটা বিশাল নৌকা দেখা যাচ্ছে। এটাকে আসলে স্টিমার বলা যেতে পারে। বেশ অত্যাধুনিক আর অনেক বড়। আমাদের কাজের জন্য একেবারে পারফেক্ট। বিন্দুর মত স্টিমারটি ক্রমশ কাছে আসছে।

কি আশ্চর্য। এটা চালিয়ে আনছে এক কিশোর। তাই তো। কিশোরই তো মনে হচ্ছে। কাছে এসে থামলো স্টিমারটি। সদ্য গোফের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে কিশোরে ঠোঁটের উপরের রেখা বেয়ে। বড়জোর আঠারো বছর হবে। সাধারণ দেখতে ছেলেটি কিন্তু কোথায় যেন অদ্ভুত একটা ব্যাপার আছে। আমি ঠিক ধরতে পারছি না। কেমন একটা তেজী ব্যাপার আছে। ঠিক যেনো একটা খ্যাপাটে ষাড়। ছেলেটি তীরে উঠে আসতেই আমি এগিয়ে যাই। ও সম্ভবত দীর্ঘ যাত্রার পর বাড়ি যাবে। যেভাবেই হোক ওকে বোঝাতে হবে। আমাদের ওইপারে যাওয়া বড় দরকার।

মানুষকে বুঝিয়ে শুনিয়ে কাজ বের করে নেবার ব্যাপারে আমার জুড়ি মেলা ভার। কোম্পানি এই লোক বোঝানোর জন্যই আমাকে ৫ লাখ টাকা গুনে দেয় মাস শেষে। বোকা কিন্তু চেতনায় দীপ্ত কিশোর ছেলেটিকে বোঝাতে খুব একটা বেগ পেতে হয় নি আমাকে।

২.

সন্ধ্যা হবে একটু পরই। আমাদের সকলের হাত পিঠ এবং সম্মুখে ব্যাগ। ব্যাগ ভর্তি সোনা। সোনার ভারে আমাদের হাটতে কষ্ট হচ্ছে। স্টিমারে সকলে উঠে বসতে বসতে পুরো সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ছেলেটি একেবারে সামনে বসেছে চালকের সিটে। আমি এর মধ্যেই এর চালানোর কলা কৌশল শিখে নিয়েছি আসবার পথেই। স্টিমার পানি কেটে সামনে এগিয়ে চলে।

ঠিক তখনই স্টিমারের সর্বোচ্চ ওজন পরিমাপক মিটারের কাটে সিগন্যাল দিতে থাকে। মাত্রাতিরিক্ত ওজন। বালকটি চেচিয়ে ওঠে। বত্রিশ কেজি ওজন বেশি। আপনারা যার যার ব্যাগ থেকে একমুঠ পরিমাণ সোনা নদীতে ফেলে দিন। নইলে মাঝ নদীতে নৌকা ডুবে যাবে। কারো মাঝেই এক মুঠ পরিমাণ স্বর্ন ফেলবার কোন চিহ্ন দেখা গেলো না।

আমি হেটে সুহাসের কাছে গেলাম। ওর দিকে চোখাচোখি হতেই আমার ভেতরে কথাগুলো পড়ে নিলো ও। কিশোর ছেলেটির ওজন চৌত্রিশ পঁয়ত্রিশের কাছে পিঠেই কিছু একটা হবে।

আর অল্প গেলেই আমরা মাঝ নদীতে পৌঁছে যাবো। সুহাস ছেলেটিকে স্টিমারের শেষ প্রান্তে নিয়ে গেছে কিছু একটা দেখাবে বলে। আমি কিছুক্ষণের জন্য মাঝ নদীতে স্টিমারকে থামিয়ে এগিয়ে চললাম সেই অবাক কিশোরের দিকে।

হ্যাংলা পাতলা ছেলেটিকে পেছন থেকে শুধু একটি মাত্র ধাক্কা দিলাম আমি। খুব বেশি বেগ পেতে হয় নি আমাকে। মুহুর্তের মধ্যে ড্রাগন নদী গিলে খেয়ে নিলো ছেলেটিকে। আমাদের স্টিমার এগিয়ে চলছে গন্তব্যের দিকে। আমাদের চোখে মুখে স্বর্নের বাড়ির স্বপ্ন।

সামনের বছর বেতন টাকে সাত লাখ করে ফেলা যাবে। হাজার হোক একটা জীবনের বিনিময়ে এতটুকু দাবী তো আমি করতেই পারি।
কিন্তু ঠিক মাঝ নদী থেকে ক্ষীণ কন্ঠের কোন আবৃত্তি শোনা যাচ্ছে কি। ঠিক স্পষ্ট না। তবু কি এমন কিছু শুনতে পেলাম আমি?

…………… আসিতেছে শুভ দিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ।

#রৌদ্রময়ী_গল্প