অবয়ব

কমলাপুর রেল ষ্টেশন। দুপুর তিনটার ট্রেনে চিটগং যাচ্ছে তিতির, সাথে ওর স্বামী জাহিদ আর মেয়ে রিমঝিম । ট্রেনে উঠেই যথারীতি টিকেট দেখে সীট খুঁজে বের করছিল তিতির আর জাহিদ। তিন জনের জন্য তিনটে সীট। মেয়েটা আজকাল একটু বড় হয়েছে। ওকে কোলে বা পাশে বসিয়ে জার্নি করা এখন মুশকিল। তাছাড়া লম্বা জার্নি, মেয়ে একটু ঘুমোতে চায়, সীট না থাকলে সমস্যা হয়ে যায়। আজকাল তাই জাহিদকে আলাদা সীটে বসতে হয়। ওদের সীটের নম্বর ছিল আট, নয়, দশ। দেখা গেল, বগির ঠিক মাঝখানেই ওদের সীটগুলো। আট পড়েছে আলাদা, উল্টো দিকের সারিতে, যেখানে জাহিদ স্ত্রী ও মেয়ের দিকে মুখ করে বসবে বলে ভাবছে। এপাশে নয় আর দশ। তিতির আর রিমঝিম এপাশে বসবে পাশাপাশি। মা মেয়ে দুজনই জানালার পাশে বসতে ভালবাসে, বাইরে তাকিয়ে প্রকৃতি দেখা দুজনেরই খুব পছন্দ। মেয়ের পছন্দকে প্রাধান্য দেবে ভাবছে তিতির, আগেও কয়েকবার তাই করেছে, তবে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আপাতত মেয়েকে প্যাসেজ এর দিকের সীটে বসানো যাক। 

ট্রেনের ঠিক মাঝখানের সীটগুলোতে মাঝে একটা স্টিলের টেবিল থাকে। মুখোমুখি চার জন যাত্রী বসেন। তিতিরদের উল্টো দিকের দুটো সীটে এক তরুণ দম্পতি বসে রয়েছে আগে থেকেই। মেয়েটি ভেতরের সীটে আর লোকটি প্যাসেজ এর দিকের সীটে। দুজনেই পায়ের ওপর পা তুলে বসা। এধরণের বসা দেখলেই কেন জানি তিতিরের মেজাজটা খারাপ হয়। সে দেখলো ভেতরের সীটে গিয়ে বসতে গেলেই তার বোরখা লোকটির জুতোর সাথে লাগবে। তিতির নিজে টিপটপ চলতে পছন্দ করে। তার নিজের জুতোর নিচেও যাতে বোরখা না পড়ে সেজন্য সে বেশ সাবধানে হাঁটে। সে ঈষৎ বিরক্ত হয়ে বলল, “ভাই পা টা একটু সরিয়ে বসুন। এভাবে বসলে তো আমরা বসতেই পারব না।”

লোকটি শুনেও খুব একটা পাত্তা দিল না। অল্প একটু পা সরানোর ভাব করল, পা টা সরলো কি সরলো না, আবার তার সংগিনীর দিকে মনোযোগ দিল এবং নিজেরা হাসাহাসি করতে লাগলো। তিতির মনে মনে যথেষ্ট বিরক্ত বোধ করতে লাগলো যদিও মেয়েকে নিয়ে সাবধানে নিজেদের জায়গায় বসলো। লক্ষ্য করল, মুখোমুখি বসা দুই যাত্রীই পায়ের ওপর পা তুলে এমনভাবে বসেছে যে তারা ঠিকভাবে জায়গা নিয়ে বসতে চাইলে ঐ দুজনের জুতোর সাথে তো লাগবেই, এমন কি ওদের পায়ের সাথে ঠোকর খাওয়ারও সম্ভাবনা। ট্রেনে উঠেই তার মেজাজটা ভালরকম খিঁচড়ে গেল।

তিতির জানে তার একটু ধৈর্য কম, হুটহাট রাগ চড়ে যায়। তবে সে খুব নীতিবাদী, নিজে নীতিবিরুদ্ধ কিছু করে না, অন্যের অসুবিধাও করে না। তাই কেউ এরকম করছে দেখলে সহ্যও করতে পারে না। দেখতে খুব সাধারণ তিতির, হিজাব পরে বেশ ভালভাবে তবে মুখটা খোলা থাকে। হিজাবে অতি আধুনিকতা এড়িয়ে চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ করেছে। এখন একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে লেকচারার হিসেবে কাজ করে, বেশ আত্মমর্যাদা আছে মনের মধ্যে যদিও বিনয়ের সাথেই মানুষের সাথে কথা বলে। কিন্তু তার বিনয়ভাব, সাধারণ চেহারা আর মোটামুটি সাধারণ হিজাব-বোরখা দেখে কেউ তাকে অবমূল্যায়ন করলে সে ঠিকই তা টের পায়। 

চট করে কাউকে হড়বড় করে নিজের পড়াশোনা বা পেশার কথা বলতে একদমই পছন্দ করে না তিতির। আর খুব লক্ষ্য করেছে সে, তার সাধারণ চেহারা দেখে যারা তাকে প্রথমটায় খুব এলেবেলে ভাবে তারা পরে তার শিক্ষা, পেশা ইত্যাদির কথা জানতে পেরে বড় ধরণের ধাক্কা খায়। মানুষের এরকম আচরণ থেকে তিতির শিক্ষা নিয়েছে যে, কাউকে এক পলক দেখেই তার সম্পর্কে ধারণা করা চরম মূর্খতা। কিন্তু বাংলাদেশে বেশির ভাগ মানুষ এরকমই করে। 

তিতিরের সব সময় এসব পরিস্থিতিতে পারস্যের কবি শেখ সাদীর পোশাকে খাবার মাখার গল্পটা মনে পড়ে যায় আর হাসিও পায় খুব। কবি একবার রাজসভায় যাবার পথে রাত হয়ে যাওয়ায় এক ধনী লোকের বাড়িতে রাত্রি যাপনের জন্য গিয়েছিলেন। তাঁর পরনে তখন সাদামাটা পোশাক ছিল। তাই লোকটি কবিকে চিনতে না পেরে খুব অবহেলা দেখিয়েছিল। এরপর কবি রাজসভায় যান, কবিতা শুনিয়ে সবাইকে চমতকৃত করেন এবং অনেক উপহার সামগ্রী পান। ফেরার পথে দামী পোশাক পরে কবি একই লোকের বাড়িতে গেলে এবার লোকটি তাঁকে খুব খাতির যত্ন করে সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করে। তখন কবি সেই খাবারগুলো তাঁর পোশাকে মাখতে থাকেন, পকেটে ভরতে থাকেন। লোকটি তখন অবাক হয়ে কবির এমন আচরণের কারণ জানতে চাইলে কবি বলেন, এই খাবারগুলো আসলে তাঁর জন্য নয়, দামী পোশাকের জন্যই তিনি আজ এত সুস্বাদু খাবার পেয়েছেন। মলিন পোশাক পরে যখন এসেছিলেন তখন তো এত আদর আপ্যায়ন পান নি। তখন লোকটি তার ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত হয়। মাঝে মাঝে কেউ বেশি বাড়াবাড়ি করলে তিতিরও সেই কবির মত এরকম একটু আধটু শিক্ষা দিতে কার্পণ্য করেনা।

আজ এই দুই যাত্রীকে দেখে সেই শিক্ষাটা দেয়ার ইচ্ছে হতে লাগলো তিতিরের। ওরা দুজনই প্রচন্ড হাসাহাসি করছে, খুব শো-অফ করছে, ক্যামেরায় ছবি তুলছে নানান ভঙ্গীমায়। তিতির বার কয়েক জাহিদের দিকে তাকালো ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে, কিন্তু জাহিদ সব বুঝেও কেমন নির্বিকার। আসলে ও খুব অন্তর্মুখী স্বভাবের, পারতপক্ষে মানুষের আচরণের প্রতিক্রিয়া দেখায় না। তিতির আর কি করে! একবার বিরক্ত চোখে সামনের দুজনের এদিকে প্রসারিত করা জুতোসমেত পা চার খানার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো, যদি এতে পুরুষটির না হোক অন্তত মেয়েটির বোধোদয় হয়। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। অথচ মেয়েটি হিজাব পরিহিতা। হলুদ রঙ এর হিজাব দেখে তিতির অনুমান করছে এদের হয়ত বিয়ে হয়েছে বেশিদিন হয়নি, নয়তো এমন রঙ এর হিজাব তো মেয়েরা সাধারণত পরে না। জাহিদের আশে পাশে তিনটি সীটই ততক্ষন পর্যন্ত ফাঁকা। যাত্রীরা এসে পৌছায় নি। হঠাত সামনে বসা পুরুষটি উঠে জাহিদের সামনের সীটে বসল।

‘ভাই, শুনুন। আপনাকে একটা অফার দিচ্ছি। ঐ দুই সীটের একটি সীট আমার। আর আপনার পাশের সাত নম্বর সীটটাও আমার। আপনি যদি আট আমাদের ছেড়ে দেন, তাহলে আমরা দুজন এখানে বসতে পারি আর আপনি ঐ সীটে বসতে পারেন।’

জাহিদ বিনা বাক্য ব্যয়ে উঠে তিতিরের মুখোমুখি সীটে বসে পড়লো। তিতির মনে মনে কত্ত যে খুশি হল, তা বলে বোঝাতে পারবে না। জাহিদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শোকর আলহামদুলিল্লাহ্‌। এত পেইন লাগছিল এতক্ষণ, এবার বাঁচলাম।’

‘একই তো কথা।’ জাহিদ সামান্য হাসল।

‘মোটেই একই কথা না, এতক্ষণ এদের পা এর যন্ত্রণায় আমরা মা-মেয়ে একটু শান্তিতে বসতে পর্যন্ত পারছিলাম না। এমন বেশরমও হয় মানুষ! বলার পরেও পা ঠিক করল না।’

জাহিদ কোন মন্তব্যে গেল না। স্ত্রী সন্তানের কাছাকাছি বসতে পেরেছে এ-ই যথেষ্ট। 

দুই তিন মিনিট পরই একজন খুব মোটাসোটা লোক এসে রিমঝিমের মুখোমুখি আর জাহিদের পাশে প্যাসেজ এর দিকের সীটে বসল। বসতে বসতে রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলল, ‘আপাতত বসি কেমন?এই সীট এর লোক এলে উঠে পড়ব আর কি!’

আগের দুজনের আচরণের তুলনায় এই লোকটির আচরণ অনেক শোভন লাগলো তিতিরের কাছে। 

সে বলল, ‘ও আচ্ছা, আপনি উত্তরা যাবেন?’

‘আমি এয়ারপোর্ট যাব।’

তিতির মনে মনে হাসল। সে উত্তরা বলতে এয়ারপোর্টই বুঝিয়েছে যদিও লোকটি তা বুঝতে পারে নি। এবার জাহিদ লোকটির সাথে কথা বলতে লাগলো আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজনের ভাব হয়ে গেল! জানা গেল, লোকটি এ সময়ের বিরোধী দলীয় নেত্রীকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্ট যাচ্ছে। নেত্রী অনেকদিন পর দেশে ফিরছেন আজ। আর লোকটি ঐ দলের একজন ওয়ার্ড সভাপতি।

এই লোকটি ট্রেনে উঠার কিছুক্ষণ পরই তিতিরদের বাম পাশের ঐ দুই সীটে আরো দুজন লোক উঠে তরুণ দম্পতির মুখোমুখি বসল। দুজনই বেশ বড়সড় মানুষ, অনেকটা জায়গা লাগলো তাদের বসতে। এক জনের হাতে দুটো সেলফোন আবার একটা ওয়্যারলেস সেট। জাহিদ নিচু গলায় তিতিরকে বলল, ‘ইনি গোয়েন্দা বিভাগের অফিসার।’ তার পাশের লোকটি আবার বিরোধী দলের কোন ছোটখাটো নেতা হবেন অনুমান করল তিতির, কারণ তিনিও এয়ারপোর্ট যাচ্ছেন, আর ওয়ার্ড সভাপতির সাথেও দুএকটা বাক্য বিনিময় করছেন।

মজার ব্যাপার হল এরা দুজন বসার পর থেকেই ঐ তরুন দম্পতি একদম স্পীকটি নট হয়ে আছে আর বসেছেও খুব ভদ্রভাবে। প্রত্যেকেরই পা দুটো তো নামানোই, ছোট করে গুছিয়ে বসেছে দুজনই। তিতিরের খুব হাসি পেল ওদের দিকে তাকিয়ে। আহা! সে যদি ঐ দম্পতির সামনে বইসা ঐ দুজন লোকের মত দশাসই চেহারার হত!

“অবয়ব”
সাইমুনা তারিন
(২৯ অক্টোবর ২০১৭)