আনন্দ অশ্রু

আজ হাসান কে বলার জন্য একটি বিশেষ খবর আছে তার কাছে। তাদের ছোট্ট সংসারে নতুন অতিথি আসছে। যদিও এই আর্থিক অবস্থায় এ খবরে ও কতটা খুশি হবে তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না।

ওয়াইট চ্যাপেল স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে পড়লো তানিয়া। পাতাল স্টেশন থেকে উপরে উঠলেই হিমেল হাওয়া জাপটে ধরবে তাকে, এই ভাবনাটাই মন খারাপ করে দেবার জন্য যথেষ্ট। মাত্র সাড়ে তিনটে বাজে, কিছুক্ষণ পর সূর্য ডুবে যাবে, শুরু হবে দীর্ঘ রাত! শীতকালে খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নেমে যায়। 

গলার মাফলারটা আরো টাইট করে প্যাঁচিয়ে, দস্তানা ছাড়া হাত দুটো পুরোনো কোটের পকেটে ঢুকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে, মাটি ফুঁড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো সে।

আজ বহু কষ্টে রেস্তোরাঁর ম্যানেজারকে বলে একটু আগে আগে বেড়িয়েছে। ব্যাটা সিলেটী ভদ্রলোক প্রায় তিরিশ বছর ধরে রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছে। এই লোকের মতো হাড়কিপ্টে মানুষ জন্মে দেখেনি ও। নিতান্ত বাধ্য না হলে এখানে কাজ করতো না। হাসান একটা সুপার শপে কাজ করে। দুজনের আয়ে শুধু মাত্র দিন চলে যায়। সঞ্চয় বলতে কিছুই হয় না।

বিলেতে এসেছে মাত্র এক বছর হলো, এখনো নিজের পায়ে দাঁড়ায়নি ওরা, স্থায়ী কোন চাকরি নেই একজনেরও। না আছে কোন ভালো থাকার যায়গা। 

বাংগালীদের জন্য আজকাল কাজ পাওয়া খুব কঠিন হয়ে গেছে, মুখে স্বীকার না করলেও এদেশে বর্ণ বৈষম্য এখনো আছে। তার ওপর ওরা মুসলিম, তাও আবার হিজাব ও দাঁড়ী রাখা মুসলমান। 

অহেতুক খরচ করার অভ্যাস তানিয়ার নেই, তাও আজ একটু আদিখ্যেতা করে ফেললো। ব্রিক লেনের বাঙালী পাড়া থেকে হাসানের পছন্দের কচুর লতি, কুচো চিংড়ী, ইলিশ মাছ ও আলাউদ্দিন সুইটমিট থেকে এক কেজি চমচম কিনে ফেললো। 

অনেকগুলো পাউন্ড বেরিয়ে গেলো, কিন্তু কি আর করা। এতো কৃচ্ছসাধনা মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে। দেশে খুব বড়লোক না হলেও, অন্তত এতোটা মেপে মেপে খরচ করতে হতো না। 

দেশের জন্য মাঝে মাঝে বুকের ভেতর কেমন যেনো হাহাকার করে। বিশেষ করে যখন প্যাঁচ প্যাঁচে বৃষ্টি পড়ে আবহাওয়া আরো মেঘলা হয়ে যায়, তখন দেশের বর্ষা কালের ঝমঝমানো বৃষ্টির শব্দ শোনার জন্য প্রাণ আইঢাই করে।

শীতের তীব্রতায় সব ভুলে, জোরে পা চালাতে থাকলো ও। আজ রাতে মনে হচ্ছে তুষার পড়বে। বাড়িওয়ালাকে বার বার বলা হয়েছে হিটার ঠিক করাতে। বিদ্যুৎ বিল কম আসার জন্য, ইচ্ছে করেই ভদ্রলোক হিটারে তাপমাত্রা কমিয়ে রাখে।

ইশ সাবলেট থাকা বাদ দিয়ে যদি একটা ভালো বাসা নেয়া যেতো! ওদের ফ্ল্যাটের চার রুমে, চারটি আলাদা ভাড়াটিয়া থাকে। একটি কমন বাথরুম ও রান্নাঘরে অনেক কষ্ট হয় তানিয়ার। বাকি তিনরুমের ব্যাচেলর ভাড়াটিয়া রা সকালে অফিসে চলে গেলে, তখন সে তার কামরা থেকে বের হয়ে, রান্না বান্না ও অন্য কাজ শেষ করে। পরদার জন্য খুব দরকার না হলে, ওরা থাকতে কামরা থেকে বের হয় না। 

এই পর্দা করার জন্যই হোটেল ম্যানেজার তাকে দেখতে পারে না। সে সদাই ব্যাস্ত তার কোন একটা দোষ খুঁজে বের করে ছাঁটাই করার জন্য। এরপর স্বল্প বসনা এক সুন্দরী ওয়েট্রেস রাখবে, তাহলে তার ধারণা কাস্টোমারের সংখ্যা বেড়ে যাবে।

অবশ্য আর কয়েকমাস পর সহজেই ওকে বের করে দিতে পারবে লোকটি। বিশাল পেটের কোন মেয়েকে নিশ্চয় রাখবে না কাজে। আর ম্যাটারনিটি লিভের কথা তো স্বপ্নেও ভাবা যায় না।

এসব ভাবতে ভাবতে বুক কাঁপতে লাগলো ওর। শীত এ নাকি দুশ্চিন্তায় বুঝতে পারলো না তানিয়া। নতুন সদস্য সংসারে আসলে অনেক অনেক টাকা প্রয়োজন হবে ওদের। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে লক খুলে ঘরে প্রবেশ করলো। 

হঠাত মন টা খারাপ হয়ে গেলো, ওর অনাগত সন্তান কি তাহলে অনাহুত, অনাকাঙ্ক্ষিত সদস্যের মর্যাদা পাবে? তারপর নিজের ওপরেই রাগ উঠে গেলো, ছি: ছি: নিজেদের ভালোবাসার ফসল, নিজের সন্তান নিয়ে এতো নীচ চিন্তা সে কিভাবে করতে পারলো!

সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো তানিয়া, আর দুশ্চিন্তা করবে না, আল্লাহ্‌ নিশ্চয় আর রাযযাক। নতুন যে পৃথিবীতে আসবে, অবশ্যই তার রিযিক নিয়েই আসবে। 

আল্লাহ্‌ কে শুকরিয়া জানিয়ে, রান্নাঘরে গেলো ও। ইলিশ মাছ মচমচে করে ভাজবে আজ, সাথে রাখবে সুগন্ধি কাগজী লেবু আর ঘন ডাল, এসব হাসান খুব পছন্দ করে। 
***★***★******★******★*****★*****★**

ইমেইল টা চোখের সামনে দেখেও বিশ্বাস হচ্ছে না হাসানের। প্রায় ছয় মাস আগে চাকরিটার জন্য আবেদন করেছিলো, ভেবেছিলো হবে না কিছুই। কম্পিউটার ইনজিনিয়ার হয়েও অড জব করতে করতে হাঁপিয়ে পড়েছিলো ও। 

লন্ডন শহর থেকে বেশ দূরে কান্ট্রিসাইডে একটা হাসপাতালে আইটি স্পেশালিষ্ট পদে ওর চাকরি হয়েছে। ওরা দু’জন মিলে এখন যা আয় করে, সেখানে বেতন তার চেয়ে বেশী। সেই সাথে থাকার জন্য বাড়িও দেবে ওরা। এর চেয়ে বেশী তো কল্পনাতেও চাইতে পারে না সে!

ডিউটি শেষে এক তোড়া গোলাপ কিনলো আর তানিয়ার পছন্দের চকলেট কিনলো একবাক্স। জয়েনিং লেটারটা প্রিন্ট করে নিয়েছে, আজ তানিয়াকে সারপ্রাইজ দেবে সে। বেচারাই কতই না খুশি হবে। 

**★*****★*****★*****★*****★******★**

এক ঘণ্টা পর…
রাস্তার মোড়ের পুরনো তিনতলা দালানের ছোট্ট এপার্টমেন্ট টা এক অদ্ভুত আনন্দের সাক্ষী হচ্ছিলো তখন। ভালোলাগার বন্যায় ভেসে গিয়ে, অল্প বয়েসী এক দম্পতি শক্ত করে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়েছিলো। তাদের চোখ ছিলো অশ্রুতে ভেজা, সে অশ্রু ছিলো আনন্দের, সে অশ্রু ছিলো কৃতজ্ঞতার..

আনন্দ অশ্রু
হাসনীন চৌধুরী
(১৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৮)