আমি তুমি তারা

 লেবু চায়ে চুমুক দিয়ে নদী বেশ অবাক হয়ে গেল। আজকে রঙ চা বানাতে রান্নাঘরে ঢুকে হঠাত এক টুকরা লেবু দেখে ওর লেবু চা খেতে ইচ্ছা হয়েছিল। বিয়ের পর ওর বরের কারণে চিনি ছাড়া রঙ চা খাওয়ার অভ্যাস করেছে। ঘরে মধু থাকলে চায়ে ওরা মধু খায় আর তা না হলে এমনিই খায়। কিন্তু লেবু চায়ে তো চিনি দেয়া লাগবে তাই আজকে ও চিনি দিয়েছে। কিন্তু প্রথম চুমুকেই চিনির স্বাদটা ওর আর আগের মতো ভালো লাগল না। অভ্যাস এমনই এক জিনিস!

শুধু কি চা? বিয়ের পর একদিন ওর বর কন্ঠে অধিকার মেশান আবদার করে বলল, “আমি তের বছর ধরে সফট ড্রিংকস খাই না, আপনি কি খাবেন?” এর পর থেকে নদীও সফট ড্রিংকস খাওয়া ছেড়েছে।

স্বচ্ছল পরিবারের ছোট মেয়ে হিসাবে ও বেশ আহ্লাদী ছিল। কম পছন্দের খাবার টেবিলে দিলে অল্প খেত বলে ওর মা সবসময় ওর পছন্দের খাবারগুলোই দিত। হাতেগোনা অল্প কিছু খাবারই ও খেত। নদী জীবনে প্রথম বেগুন ভাজি খেয়েছে ওর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে। খেয়ে ভালোই লেগেছে। এরপর বরের সাথে বিদেশে গিয়েছে। বর পিএইচডির সীমিত টাকায় সাধ্যের মাঝে যা কিনে আনত তাই খেত।

ওর বরের খাদ্যাভ্যাস আবার ওর চেয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত। তার সাথে থেকেই ও শাক-সবজি, মাছ খাওয়া শিখেছে। যে নদী ইলিশ আর চিংড়ি ছাড়া আর কোন মাছ খেত না সেই নদী বিদেশে গিয়ে সমুদ্রের মাছ রান্না করে খেয়েছে। শুনে ওর বাবা পর্যন্ত অবাক ! আর এখন তো তিন বছর পর দেশে এসে ওর দেশি ভর্তা-ভাজি এসবই অমৃত লাগছে। নদী অবশ্য ওর এই পরিবর্তনে বেশ সন্তুষ্ট। ওর বর শুধু হালাল খাবারই না, তাইয়্যেব মানে ভালো খাবার খেতে চেষ্টা করে। দ্বীন ইসলামও সেটাই নির্দেশ দেয়। নদী তাই নিজের এই পরিবর্তনে খুশি।

লেবু চা খেতে খেতে নদী বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকাল। মনে মনে ভাবল, শুধু কী ওর খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন হয়েছে? আরও কত কিছুই তো পাল্টেছে এই ক’বছরে। বিদেশে ওর দুইটা বাচ্চা হয়েছে। যে নদী বিয়ের আগে ঘরের কাজ, রান্নাবান্না করেনি সেই নদী ওই সময় নিজের জন্য রান্না করেছে। দ্বিতীয় প্রেগন্যান্সীতে তো সময় মতো বরের খাবার দেয়া ছাড়াও ওর এক বছরের মেয়ের দেখাশোনা করতে হয়েছে। বাবা-মা-ভাই-বোন কেউ কাছে থাকেনি তাই ও খুব চাইছিল এবার দেশে এসে বাবার বাড়িতেই বেশি থাকবে। বরকেও বলে রেখেছে আগে থেকে। যদিও বাসায় আসার জন্য খুব অস্থির ছিল নদী কিন্তু একই সাথে দেশে ফেরা নিয়ে ও খুব চিন্তিতও ছিল। ইস্তিখারা পর্যন্ত করেছে দেশে এসে বেশিদিন থাকার ব্যপারে। ওর বরের ক্যরিয়ারের জন্য ভালো হয় যদি ও বেশ কিছুদিন দেশে থাকে।

নদী ওর শাশুড়িকে প্রচন্ড ভয় পেত। শ্বশুরবাড়ির সবার আচরণে ও কোণঠাসা হয়ে থাকত। ওর মনের ভয়, তাদের খারাপ আচরণ এসব বিদেশেও ওর পিছু ছাড়েনি। নদীর মনে আছে এক রাতে আবার একদিন দেশে এসে তাদের সাথে থাকতে হবে এই ভেবে ভয়ে ও চিৎকার করে কাঁদছিল আর ওর বর বার বার বলছিল তুমি এভাবে কাঁদলে এসব দেশে পুলিশ এসে দরজায় নক করবে! নদী ওর মনের ভয় কে জয় করতে একসময় নিয়ম করে দু’আ করত আল্লাহ্‌ যেন ওর মন থেকে এক আল্লাহর ভয় ছাড়া দুনিয়ার আর যেকোন ভয় দূর করে দেন। 

কখন যেন আল্লাহ্‌র সাহায্যে সত্যিই ও ভয়কে জয় করতে পেরেছে। নদী এখন আর ওর শাশুড়িকে আগের মতো ভয় পায় না। বরং উনার দিকে তাকালে ও এখন একজন দুর্বল ও অসহায় মানুষকে দেখতে পায়। উনার জন্য, ওর বরের পরিবারের মেয়েদের জন্য ওর এখন মায়াই হয় যেন। তারা নিজেরাও নানা অন্যায়ের স্বীকার যা তাদের আচরণকে প্রভাবিত করেছে। যে কয় বছর বিদেশে ছিল, নদী তখন বউ-শাশুড়ি সম্পর্ক নিয়ে কিছু গবেষণা ধর্মী লেখা পড়েছে। লেখাগুলো ওকে ওর শ্বশুরবাড়ির মানুষদের মানসিকতা বুঝতে সাহায্য করেছে।

প্রথমদিকে তো নদী একদমই তাদের সাথে খাপ খাওয়াতে পারত না; ওর নিজের পরিবারে তো ও এমন সংকীর্ণতা দেখেনি! নদী দেশে ফেরার পর বেশিরভাগ সময় জুড়েই ওর শ্বশুরবাড়িতে আছে, শশুড়-শাশুড়ির আকস্মিক অসুস্থতাই এর প্রধান কারণ, যদিও ওর বর না থাকায় বাবার বাড়িতেই ও বেশি থাকতে চেয়েছিল। তবে নদী এটাও খুব ভালো ভাবে বোঝে যে তারা ওকে বেশি সময়ের জন্য ওর বাবার বাড়ি যেতে দিতে চায় না। মাসখানেক আগেও এই নিয়ে বরের সাথে ওর ফোনে ঝগড়া হয়েছিল।

কিন্তু গত এক মাসে মনে হচ্ছে যেন ওর নিজের মানসিকতাও পাল্টে গেছে। ওর তেজী শাশুড়িকে শারীরিকভাবে এতটা দুর্বল হতে ও কখনো দেখেনি আগে। শরীরের দুর্বলতা উনার মনকেও আচ্ছন্ন করেছে। ও অনুভব করল যে কারো এখন উনার পাশে থাকা দরকার। দুইটা ছোট বাচ্চা নিয়ে দেশে ফিরে যেখানে ওর আরাম করার কথা সেখানে অসুস্থ শশুড়-শাশুড়ির দেখাশোনা করতে ওকে দীর্ঘদিনের জন্য শ্বশুরবাড়ি রয়ে যেতে হোল।

নদী জানে সে ইহসান করছে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আশ্চর্যের ব্যপার হোল সে এই ইহসানটা আন্তরিকতার সাথেই খুশি মনে পালন করল। একজন খাদিমা থাকায় বেশি কষ্টও হয়নি। ও খেয়াল করল যে ওর বর এই সময় বাবা-মায়ের কাছে নিজে থাকতে পারেনি কিন্তু ও আছে বলে মানসিকভাবে নিশ্চিন্ত বোধ করছে। ও অনুভব করল ও যেন এইভাবে দূরে থেকেও ওর বরের আরও কাছের হয়ে গেল। এই প্রয়োজনের সময়ে কাছ থেকে দীর্ঘদিন তাদের দেখে নদী ওর বরের পরিবার সম্পর্কে আরও ভালো ধারণা পেল। ওর এখন মনে হচ্ছে শ্বশুরবাড়ির মানুষদের সাথে থাকার প্রয়োজন আছে; তাহলে একে অপরকে জানতে ও বুঝতে সহজ হয়। 

হ্যাঁ, কিছু সমস্যা নদীর জীবনে এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু নদী এখন আর নতুন বউয়ের মতো ভয় পায় না, অন্যের কথা শুনে কারো নেতিবাচক মানসিকতা টের পেলেও নির্বিকার থাকতে শিখেছে। ও তো শুধু ততুটুকুই করতে পারে যতটুকু ওর সাধ্যের মাঝে আছে। আর দু’আ করার সুযোগ তো আছেই। আল্লাহ্‌ বলেছেন উনি উনার কৃতজ্ঞ বান্দাদের জন্য নিয়ামত আরও বাড়িয়ে দেন। নদী এখন বোঝে যে ওর শাশুড়ি জীবনে অনেক কিছুই পাননি যেগুলোর সাথে ও নিজে কখনো মানিয়ে নিতে পারত না। ওকে তো আল্লাহ্‌ অনেক কিছুই দিয়েছেন। এই তো সামনেই একটা সুযোগ এসেছে অনেকদিনের জন্য বাবার বাড়ি থাকার। নদীর এই দু’আও তো আল্লাহ কবুল করে নিয়েছেন।

“আমি তুমি তারা”
বিনত খাজা
(২৩ নভেম্বর ২০১৭)