আলহামদুলিল্লাহ্‌

দ্বীনের বুঝ তখনও পাইনি। বন্ধুমহলে আমার বেশ সুনাম ছিল। যেকোনো আড্ডায় আমি আসলে সবাই নড়েচড়ে বসতো। ভাবটা এমন এখনই মজা শুরু হবে। আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলে ছেলে মেয়ে সবাই ছিল। আমরা ছিলাম তথাকথিত জাস্ট ফ্রেন্ড, খুব ভাল বন্ধু। এর বেশি কিছু না। যেকোনো ব্যাপারে তাৎক্ষণিক রসিকতায় আমি ছিলাম সেরা। দ্বিতীয় সেরা ছিল শিউলি। ও ভীষণ মজা করতে পারতো। শিউলিকে দেখেই প্রথম বুঝেছিলাম সেন্স অব হিউমার ছেলেদের একচ্ছত্র মালিকানায় নেই। মেয়েরাও পারে! আসলে আমাদের সার্কেলে কি ছেলে কি মেয়ে সবার রসবোধ খুব চমৎকার ছিল। ভার্সিটিতে ওঠার আগে মেয়েদের সাথে তেমন মেশার সুযোগ হয়নি বলে মেয়ে মাত্রই বেক্কল ভাবতাম।

সে যাই হোক, এক সময় জীবনের মোড় একশ আশি ডিগ্রীতে ঘুরে গেল। আমি ইসলামের পথে আসলাম। যে ভাইয়ের প্রভাবে দ্বীন বুঝতে শিখলাম, তিনি বললেন সব মেয়ের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দাও। কোনো অজুহাত না, ওদেরকে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার দরকার নেই। চুপচাপ সার্কেল পরিবর্তন করে ফেল।

আমি সার্কেল থেকে বেরিয়ে গেলাম। সময়টা সহজ ছিল না। কিন্তু কীভাবে যেন পেরেছিলাম। একটা দ্বীনি সার্কেল জুটে গিয়েছিল, টিকে থাকার এটাই সবচেয়ে বড় কারণ। মনের খায়েশ মিটিয়ে মজা করতাম। মাঝে মাঝে নারীসংগের অভাববোধ করতাম। মনকে সান্তনা দিতাম, থাক! বিয়ের পর বউয়ের সাথে হাসি ঠাট্টা করা যাবে।

একসময় বিয়ে নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে শুরু করলাম। রফিক ভাই, যার দাওয়াতে আজ আমি দ্বীন মেনে চলছি তাকে বায়োডাটা দিলাম। ভাই বায়োডাটা দেখে ফোন দিলেন। প্রথমে বেশ প্রশংসা করলেন আমার। খুব কম ছেলেই নাকি বিয়ের পর বউকে পর্দার পরিবেশ তৈরি করে দেয়ার চিন্তা করে।

বিয়ের চিন্তা ভাবনার সময়ই আমি মা বাবা আর ভাইকে বুঝিয়েছিলাম একটা মেয়েকে পর্দার পরিবেশ দেয়া আমার দায়িত্ব। বায়োডাটাতেও সে ব্যাপারে হিন্ট দিয়েছি দেখে রফিক ভাই ভীষণ খুশি। মিনিট দেড়েক প্রবল প্রশংসায় ভাসিয়ে ভাই আমাকে বাঁশ দিলেন। বললেন, “এক্সপেক্টেশনের জায়গায় ওটা কী লিখেছো? তোমার স্পাউসের সেন্স অব হিউমার থাকতে হবে? হ্যাঁ? এগুলা কী জিনিস! আমার তো সেন্স অব হিউমার নাই। আমি কি তোমার ঘটক হতে পারব?”

রফিক ভাইয়ের দীর্ঘ লেকচারে বুঝতে পারলাম বায়োডাটাতে এসব লিখতে হয় না। সৌন্দর্য লিখলে তাও ঠিক আছে, সেন্স অব হিউমারের কথা লেখা যাবে না। বাড়তি যা যা চাই মনে মনে দু’আ করতে হবে।

বাড়তি চাহিদা কেটেকুটে বায়োডাটা আবার রফিক ভাইকে দিলাম।

আমার বিয়ে হল অসম্ভব সুন্দরী কম বয়েসী এক নিক্বাবী মেয়ের সাথে। 

ফেসবুকে বউ নিয়ে নানারকম আদিখ্যেতা চলে। আমারও করতে মন চায়, শো অফ হয়ে যাবে ভেবে করি না। সাজিদ ভাইয়ের ব্যাপারটা আলাদা ছিল একটু। তারটা শো অফ বা আদিখ্যেতা মনে হয়নি। উনি কোথা থেকে যেন জ্ঞানগর্ভ সব পোস্ট শেয়ার দিয়ে বউকে মেনশন করে দেন। তার স্ত্রী যথেষ্ট স্মার্ট। যেসব পোস্ট আমারই মাথার উপর দিয়ে যায় যায় অবস্থা সেসব নিয়েও তিনি সুচিন্তিত মতামত দিতে পারেন। স্বামী স্ত্রীর মন্তব্য প্রতি মন্তব্য আর রসবোধে পরিবেশটা বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে।

এসব দেখে আমিও ভাবতাম একদিন আমারও বিয়ে হবে। সবকিছু সময়ের ব্যাপার মাত্র।

কিন্তু বিয়ের পর আবিষ্কার করলাম আমার অসম্ভব রূপবতী নিক্বাবী বউ একটা টিউব লাইট। না না টিউব লাইটও না, হ্যাজাক বাতি। জ্বলে তো জ্বলে না, টিমটিম করে শুধু।

প্রথম প্রথম খুব হাসির গল্প ট্রল মীম সব বউকে ইনবক্স করতাম। ও হাসতো। হেসে বলতো মানে বুঝিনি। কোনো কৌতুক বলা শেষে ও জিজ্ঞেস করতো, তারপর কী হল?

জীবনটা প্রচন্ড হতাশায় ছেয়ে গেল। রফিক ভাইকে মাঝে মাঝে শত্রু মনে হত। বায়োডাটায় সেন্স অব হিউমার কেটেকুটেই আজ আমার এ অবস্থা। বউয়ের সাথে কোনো ব্যাপারে কথা বলার আগ্রহ পাই না আর। কম বয়েসী মেয়ে, অনেক আগ্রহ নিয়ে চাইল্ডিশ সব বিষয়ে গল্প করতে চায়। আমি হু হা করি। মাঝে মাঝে হতাশায় একটু রূঢ় আচরণ করে ফেলি তখন কেঁদে কেটে চোখ ফুলিয়ে ফেলে। মায়া লাগে, আবার যন্ত্রণাও লাগে। আমি কম বয়েসীই চেয়েছিলাম, কিন্তু এ বয়েসী মেয়েরা ওর মত ইম্যাচিওর হয় না।

মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যেদিকে তাকাই সেদিকেই বুদ্ধিদীপ্ত প্রাণবন্ত সব মেয়ে। সেদিন রায়হান ভাইকে দেখলাম স্ত্রীকে নিয়ে রিকশা করে কোথাও যাচ্ছেন। দুজন বেশ গল্প করছেন, হাসাহাসি করছেন। কী অসাধারণ বোঝাপড়া! আর আমি! না বউয়ের পুতুল খেলা টাইপ গল্প হজম করতে পারি, না সে আমার কোনো কথা বুঝতে পারে। 

রায়হান ভাইকে সস্ত্রীক দেখার ঘটনাটা প্রতিদিনই মাথায় ঘুরতো। একদিন ভাবলাম এভাবে আর হয় না। রফিক ভাইয়ের সাথে দেখা করে সব খুলে বলি। ভাই যা বলে মেনে নিব। ভাইয়ের সাথে দেখা করে নিজে আর কিছু বলতে পারলাম না। ভাইই শুরু করলেন। বললেন, “শাহীন তোমার মনে আছে তোমাকে ধমকে ধামকে সেন্স অব হিউমারের ভুত ছাড়িয়েছিলাম?”

পুরোনো রাগ জেগে উঠল। মনে আবার থাকবে না! হাড়ে হাড়ে মনে আছে! মুখে বললাম, “জ্বী ভাই মনে আছে।”

– “জানো শাহীন! দু’জন মানুষ একসাথে থাকতে এতকিছু লাগে না। সেন্স অব হিউমার, রূপ, বুদ্ধিমত্তা, আহামরি জ্ঞান এগুলো বোনাস। থাকলে আলহামদুলিল্লাহ, না থাকলেও আলহামদুলিল্লাহ। জীবন কেটে যাবে।”

ভাইকে খুব গম্ভীর দেখাচ্ছে। কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে শুরু করলেন, “রায়হানের ডিভোর্স হয়ে গেছে জানো তো?”

চমকে উঠলাম আমি। “রায়হান ভাইয়ের? কেন?” পরক্ষণেই বুঝলাম কেন ডিভোর্স হয়েছে এটা জানতে চাওয়া ঠিক না। রফিক ভাই অবশ্য নিজে থেকেই বললেন, “খুব মামুলি বিষয় থেকে ঝামেলা শুরু হয়েছিল। রায়হান ভাইয়ের স্ত্রী আশা করেছিলেন তার হাজবেন্ড স্টুডেন্ট অব নলেজ হবেন। বিয়ের পর আবিষ্কার করেন অমুক তমুক শায়খের মত জ্ঞানী হওয়া তো দূরের ব্যাপার, রায়হান ভাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার থেকেও কম জানেন। এই অভিযোগ দিয়ে টানাপোড়েনের গল্প শুরু হয়। এরপর নানান ঘটনায় দুজনই দু’জনকে আর সহ্য করতে পারছিলেন না।”

রফিক ভাই খুব রাগত স্বরে বলছিলেন, “আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামতে ডুবে থাকলে যা হয়। মানুষ কী পেয়েছি তা না ভেবে কী পেলাম না ভাবতে ভাবতে অকৃতজ্ঞের মত জীবন কাটায়। অথচ নিয়ামতের শোকর করলে আরো পেত।”

ভাইয়ের শেষের কথাগুলো ভেতরটা যেন দুমড়ে মুচড়ে দিল। আসলেই নিয়ামতের শোকর করি না বলে এত হতাশা! 

সেদিন ভাইকে কিছু না বলেই বাসায় ফিরে আসলাম। ভাল লাগছিল না কিছু। বাসায় এসে ল্যাপটপে ফেসবুক খুলে বসলাম। শুরুতেই সাজিদ ভাইয়ের পোস্ট। যথারীতি সেখানে স্বামী স্ত্রীর কমেন্ট পালটা কমেন্ট। এসব দেখে আর ভেতরে কোনো হাহাকার অনুভব করলাম না। মনে মনে তাদের জন্য বারাকাহর দু’আ করলাম। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। এতদিন কি উনাদের প্রতি অসংখ্য বদনজরে আমিও শরীক ছিলাম?

ল্যাপটপের স্ক্রীনে তাকিয়ে অনেককিছু ভাবছিলাম। বউয়ের ডাকে চিন্তায় ছেদ পড়ল। জিজ্ঞেস করছে, “কী করেন?”
স্ক্রীন থেকে চোখ না সরিয়েই আপনমনে বললাম, “নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করি।”

– কীভাবে করে?
– মন থেকে আলহামদুলিল্লাহ বলতে হয়।
– ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বলতে হবে?
– আরে নাহ! যেখানে খুশি তাকিয়ে বল।

হ্যাজাক বাতিটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, আলহামদুলিল্লাহ।

এই প্রথম, হ্যাঁ এই প্রথমবারের মত একদম মন থেকে হ্যাজাক বাতির জন্য আমিও বললাম, আলহামদুলিল্লাহ!

…………………………

আলহামদুলিল্লাহ্‌
আনা আমাতুল্লাহ
(২০ মার্চ ২০১৮)