এমনও তো হয়

১.
নতুনকুঁড়ি কিন্ডারগার্টেনে কিছু ঘটনা একদম অলিখিত নিয়ম মেনে চলে। এই যেমন ক্লাস শুরুর পাঁচ মিনিট আগে যেই না সতর্ক ঘন্টা বাজে, নার্সারির শাহানের পেটটা মোচড় দিয়ে ওঠে৷ অসহায়ের মতো ও দৌড়ে আসে আয়া খালার কাছে। আর ঠিক তখনই ওদের আনিকা মিস হন্তদন্ত হয়ে টীচার্স রুমে ঢোকে। কে জানে হয়তো আড়চোখে শাহানকেও দেখে। ছোট্ট শাহানের এই নিয়ে মনঃকষ্ট আছে৷ মিস একটু আগে আসলেই তো ওরা মুখোমুখি হয় না!

আনিকা অবশ্য কোনোদিনও শাহানকে দেখেনি। ওর মনে প্রতিদিনকার মতো দেরি হয়ে যাবার আফসোস। আজকের দেরিটা একটু অন্যরকম অবশ্য। স্কুলে আসার পথটা বদলে গেছে৷ আগে বাবার বাড়ি থেকে একা আসা হতো, আজ থেকে স্বামীর সাথে। অফিসে যাবার আগে ওকে নামিয়ে দিয়ে গেছে ফাহাম।

দু’হাত ভর্তি মেহেদীর কারণেই হোক অথবা নতুন ফ্লোরাল প্রিন্টের ব্যাগটার কারণেই হোক, রুমে ঢুকেই কলিগদের জেরার মুখে পড়েছে আনিকা।

‘কুরবানির ঈদে মেহেদী দিয়েছো? বাহ! বাপের বাড়ির আরাম! কাজ করতেই হয় না, তাই না?’ রূপন্তীর টিপ্পনী দিয়ে শুরু হলো। যৌথ পরিবারের বড় বউ সে। জীবনে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়েছে। এখনও সংসার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। কী করে যেন অন্যের জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সুখ তার ছাঁকনিতে ধরা পড়ে যায়। কেউ রূপন্তীর কাছে সুখ লুকাতে পেরেছে এমন নজির নেই।
রূপন্তীর পরপরই ধরল শাহানা খানম। অভিজ্ঞ চাউনি দিয়ে বুঝে ফেললেন এটা ঈদের মেহেদী না। সাদা ফুল ফুল নেভী ব্লু ব্যাগটাও দেশি হবার সম্ভাবনা কম।

‘এই আনিকা, নতুন ব্যাগ…হাতে মেহেদী…বিয়ে হয়েছে নাকি?’ চশমার নিচ দিয়ে গোয়েন্দা-দৃষ্টি তার।
আনিকা চটপট স্বীকার করে নিয়েছে। বিয়ের খবরে লুকোছাপার কিছু নেই। কেবল হুট করে হওয়াতে আগে জানাতে পারেনি এই যা!
শ্বশুর শাশুড়ি দেশের বাড়িতে থাকেন, স্বামীর চাকরী ঢাকায়, দুজন একসাথেই থাকছে- ইত্যাদি কৌতূহল নিবারণের পর আনিকা রওনা দিয়েছে ক্লাসের উদ্দেশে। রূপন্তী আর শাহানা খানম রয়ে গেছেন। তাদের এখন ক্লাস নেই।

‘বিয়ে হয়েছে না, কয়েকটা দিন যাক! বুঝতে পারবে সংসার কী জিনিস!’ হোমওয়ার্ক খাতা দেখতে দেখতে শাহানা খানম গল্প করছেন রূপন্তীর সাথে। ‘ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে এই প্রোজেক্ট সেই প্রোজেক্ট, হ্যান করেঙ্গা ত্যান করেঙ্গার দিন শেষ!’

রূপন্তী ঠোঁট উল্টায়, ‘বুঝবে আর কই! টোনাটুনির সংসার। শ্বশুর শাশুড়ির সাথে থাকত, ননদ দেবরের হ্যাপা পোহাত আমার মতো, তখন না বুঝত!’

এরপর গল্প এগোয় সংসারের নানান ঘোরপ্যাঁচ নিয়ে। বয়সের বদৌলতে শাহানা খানমের অভিজ্ঞতা কম না, ওদিকে একা হাতে দশদিক সামলানো রূপন্তীও সংসারের অলিগলির আদ্যোপান্ত জেনে বসে আছে। তৃতীয় কোনো ব্যক্তির যদি নিরপেক্ষভাবে তাদের গল্প শোনার সুযোগ হতো, তাহলে হয়তো আবিষ্কার করে বসত–এই দুই ভদ্রমহিলাই সংসার জীবনে অত্যন্ত সফল। নির্ভুলভাবে, নিখুঁতভাবে সংসার করে যাচ্ছেন, তবু তারা সুখে নেই। তাদের যোগ্যতার ধার না ধেরে সুখগুলো সব অপাত্রে বণ্টন হয়ে গেছে।

২.

‘ঈদে কই কই গেলা আনিকা?’
আনিকা হাসে। স্বামীর সাথে এবার প্রচুর ঘুরেছে। আত্মীয়-অনাত্মীয়, এই ঝিল, ঐ বিল…ঢাকার অদূরে পানির উপর রেস্তোরাঁ হয়েছে, সেখানেও যাওয়া বাদ রাখেনি।
‘ঘুরো, ঘুরো! তোমাদেরই তো সময়! সংসার সামলানোর ঝক্কি নাই, খবরদারি করার মানুষ নাই। ঘুরবাই তো!’

খুব আগ্রহ নিয়ে ভ্রমণের গল্প শুরু করেছিল আনিকা৷ রূপন্তীর খোঁচামারা কথায় দমে গেল। খবরদারি করার মানুষ নাই কথাটা সত্য না। শ্বশুর-শাশুড়ি, বাবা-মা সারাক্ষণই খোঁজ খবর নিচ্ছেন। কই যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে ব্যাখ্যাও দিতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসবে অবশ্য গা করে না সে। ফাহাম বলেছিল মা বাবার কাছে সন্তানরা বড় হয় না কখনও। এটা কেন করছিস, ওখানে কেন যাচ্ছিস এগুলো সহজাত জিজ্ঞাসা তাদের৷ এসব ব্যাপার স্বাভাবিকভাবে নিতে হয়।

আনিকা অবশ্য মুরুব্বীদেরকে সইতে জানে। তবে এই সবজান্তা, সব পারঙ্গম কলিগ দু’জন বরাবরই তার জন্য পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ায়। ব্যক্তি আক্রমণ ছাড়া এদের কথায় অন্যকিছু পাওয়া ভীষণ শক্ত। মজা করা আর খোঁচা দেয়ার পার্থক্য এদেরকে বোঝানো দায়।
শাহানা খানমের কথাই ধরা যাক! ‘ব্যাগটা কত নিল রে?’ জিজ্ঞাসা করতেই আনিকা বলেছিল হাজবেন্ড গিফট করেছে। বোঝাতে চেয়েছিল গিফটের জিনিস, দাম জানে না।
শাহানা খানম তাতেই চোখ মুখ সরু করে ভেংচি কেটে বলল, ‘জিজ্ঞেস করলাম দাম কত? আর সে বলে স্বামী গিফট দিয়েছে! আমাদের যেন স্বামী নেই! স্বামী কেবল একজনেরই আছে!’

তারপর রূপন্তীর সাথে হাসাহাসি৷ বিয়ে হয়েছে মাস পেরোয়নি। সব কথাতেই স্বামী আর স্বামী!

আনিকা বুঝে উঠতে পারে না এদের সাথে ঠিক কীভাবে কথা বললে অহেতুক খোঁচা মারবে না।

‘এই সুখ টিকবে না আনিকা, এই সুখ টিকে না। এখন তো স্বামী প্রেমে অন্ধ! কয়টা মাস যাক, তারপর বুঝবা কত ধানে কত চাল! আমার এক বান্ধবী, স্বামীর গল্পে মুখে খই ফুটত। বছর না ঘুরতেই তার প্রেম ভালোবাসা শেষ। এখন কাঁদে আর বলে জামাই নাকি রগচটা। কথায় কথায় গালি দেয়, গায়ে হাত তোলে…অত ভালোবাসার গল্প ফাঁদলে তো অমন হবেই!’ রূপন্তী বিজ্ঞের হাসি হাসে।
আনিকার রাগে ফেটে পড়ার কথা ছিল। কেন যেন ফিক করে হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে, ‘আমি আর স্বামী প্রেমে অন্ধ থাকব না আপু। আপনি আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। এখন থেকে বলব কোথাকার এক ব্যাটা আমাকে ব্যাগ গিফট করেছে। এক ব্যাটার সাথে ঘুরতে গেছিলাম। সেই ব্যাটা অফিসে যাবার আগে আমাকে স্কুলে নামিয়ে দেয়।’
এমন উত্তরে দুই সংসার বিশেষজ্ঞও না হেসে পারে না। সবার মুখে হাসি, তবু কিছু বিষমাখা তীর মনগুলোকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে গেছে।
দুই কলিগ যখন যার যার সংসারের দুঃখের ঝাঁপি খুলে বসে, তখন আনিকারও মন চায় কারও কাছে নিজের যুদ্ধের কথাগুলো বলে একটু হালকা হতে। জীবনে তো কিছু যুদ্ধ থাকেই, বিয়ের আগে কিংবা পরে। একটু পরামর্শ পাবার আশায়ও কাউকে বলা যায় না। চোখ বন্ধ করলেই শুনতে পায় একরাশ তীর্যক বাণী।

‘আছো তো সুখে, অমন করতে গেছ কেন? তাই না এমন বিপদ হলো! আমি হলে কখনওই অমন করতাম না!’

‘বিয়ে করে খুব উড়ছিলা না, এমন তো হবেই!’
‘যা হয়েছে, অল্পই। নিজে নিজে পন্ডিতি করতে গেলে…’

‘এভাবে সংসার করে না কেউ…দোষ তো তোমারই!’
কল্পনায় অসংখ্য চরিত্র আনিকার দিকে নেতিবাচক কথার ফুলঝুড়ি নিয়ে হাজির হয়। এরই মাঝে একটা পরিচিত কন্ঠ বলে ওঠে, ‘আহ! ওকে ওর মতো করতে দাওনা! তোমার বেলায় নিজের মনমতো কোরো!’
এখানেই ফটাশ করে কল্পনার বুদবুদ ফেটে যায়। শেষ কন্ঠটা স্বস্তি দেয় আনিকাকে। আজ থেকে আট বছর আগে কলেজের কমনরুমে সত্যি সত্যি শুনেছিল কথাটা।

কমনরুমে আনাড়ি হাতে ক্যারাম খেলছিল আনিকা। পাশে কেউ একজন অনবরত ডিরেকশন দিয়ে যাচ্ছে-

‘আরে গাধা, এভাবে না! ওভাবে ধরতে হয়! ধ্যাত কী করলি! ওভাবে টোকা দে রে বাপ! হাত পিছলায় কেন?’
আনিকার জীবনে প্রথম ক্যারাম খেলা। পাশ থেকে উপদেশ উপভোগ্য নয় মোটেই, এড়িয়ে যেতেও পারছিল না।

তখনই টুম্পা গলা উঁচু করে উপদেষ্টাকে ধমক লাগাল, ‘আহ! ওকে ওর মতো করতে দাওনা! তোমার বেলায় নিজের মনমতো কোরো!’
উপদেষ্টা চুপ। আনিকাও বাকি খেলাটা হারতে হারতে জিতে গিয়েছিল নিজের মতো করে। এই একটা কথার জোরেই হয়তো সাহস পেয়েছিল! নয়ত আট বছর পরও এই সামান্য কথা কেন মনে আছে কে জানে!

৩.

নির্ঘুম রাত কাটিয়ে আনিকা আর ফাহাম রিকশায় চড়ে বসেছে৷ সামনে একটা সিগনালে বসে থাকতে হয় মিনিট দশেক। এই দশ মিনিট গল্প করতে করতে ফুরিয়ে যেত এতদিন। আজ ফুরোচ্ছে না। গতকাল রাতে সেপারেশনের সিদ্ধান্তে এসেছে দুইজন। এই সময়ে গল্প হয় না। বিয়ের তিনমাস মাত্র পেরিয়েছে। সুখ ছিল, তিক্ততাও ছিল। তিক্ততাই জয়ী হলো শেষমেষ।

দুইজন এখন দুইদিকে মুখ করে বসে আছে। ফাহাম তাকিয়ে আছে পাশের হাই রাইজ বিল্ডিং এর দিকে। আর আনিকা নিবিষ্টমনে সামনের গাড়ির লাইসেন্স প্লেট দেখছে।

টুম্পা বসেছিল ওদের ঠিক পাশের রিকশাটায়। ওর চোখ ভরা পানি। ইচ্ছে করেই চোখ মুছছে না। মুছতে গেলেই রাস্তাভর্তি মানুষ বুঝে ফেলবে এই মেয়েটা কাঁদছে। তাতে কিছু যায় আসে না। তবু টুম্পার সংকোচ হয়। পাশের রিকশার অতি পরিচিত আনিকারও বুঝতে পারার কথা না নিক্বাবের আড়ালে কে বসে আছে। তবু সংকোচ হয়।

গত সপ্তাহে এক নিমিষে জীবনের হিসেব নিকেশ পালটে গেছে টুম্পার৷ পালটে গেছে না বলে উলটে পালটে গেছে বলা ভালো। হসপিটালে মাসখানেক দৌড়াদৌড়ির পর কাল জানা গেল কী হয়েছে ওর৷ ব্যস্ত ডাক্তার কাল আধা ঘন্টা ধরে ওর সাথে কথা বলল, ওর স্বামীর সাথেও। কর্কট রোগ ধরা পড়েছে টুম্পার, একদম স্বাভাবিক কন্ঠে ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছে।

টুম্পার রাতে ঘুম হয় না বহুদিন। এতদিন অনিশ্চয়তায় ঘুম হয়নি, এখন অতি নিশ্চয়তায়।

খুব কষ্টে থাকলে ও এক আজব খেলা খেলে। এই খেলা একা একাই খেলা যায়। হাসপাতালে হতবুদ্ধি হয়ে দৌড়ালো কতদিন, কিছুই ভালো লাগত না। তখন টুম্পা খেলাটা খেলত। হয়তো পাশ দিয়ে একটা বাচ্চা যাচ্ছে, টুম্পা মনে মনে বলত ‘আল্লাহ বাচ্চাটাকে তোমার নেক বান্দা হিসেবে কবুল করে নাও। আল্লাহ তুমি ওকে মা বাবার চক্ষু শীতলকারী করে দাও।’

হয়তো কোনো দম্পতি পাশ দিয়ে যাচ্ছে, টুম্পা বলত, ‘আল্লাহ তুমি এদেরকে দুনিয়া আর আখিরাতে সফলতা দিও।’
হয়তো কোনো মহিলা চিন্তিত মুখে করিডোরে হাঁটছে, টুম্পা বলত, ‘আল্লাহ উনার চিন্তা দূর করে দাও।’

এই খেলায় ক্লান্তি চলে আসলে টুম্পা চলে যেত কল্পনায়। সেখানে স্বামীর সাথে জান্নাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। এই জায়গায় কোনো অবসাদ নেই, শংকা নেই। বিছানায় পড়ে যাওয়া তিক্ত জীবন নেই। কল্পনায় সে অসম্ভব সুন্দর, চেহারায় অসুখের চিহ্ন মাত্র নেই।
দুয়ার খেলা, জান্নাতের কল্পনা শেষ হয় এক সময়। তখন একরাশ চিন্তা ভর করে মাথায়। আজ জ্যামে বসে নিজের শূন্য ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভাবতেই চোখ ভিজে উঠেছিল টুম্পার। তখনই চোখ পড়ল আনিকার দিকে। ফেসবুকে দেখেছে পাশের লোকটা ওর স্বামী।

হুট করে আবার দুয়ার খেলা শুরু করে দিল টুম্পা, ‘আল্লাহ আনিকা আর ওর স্বামীকে দুই জীবনেই একসাথে রেখো। ভালো রেখো।’
দুয়া কবুল হয়েছিল সাথে সাথেই। স্কুলে পৌঁছে ফোলা ফোলা চোখে আনিকা দেখল ফাহাম মেসেজ পাঠিয়েছে: ‘স্যরি। আর এমন হবে না।’

পাশ দিয়ে রূপন্তী চোখের কোণায় মেসেজ দেখেছে, আনিকার ঠোঁটে অপার্থিব হাসি দেখেছে। আর মুখটা উল্টিয়ে মনে মনে বলেছে ‘ঢং!’

চারপাশে ওকে ঘিরে কত কী হয়ে গেছে, আনিকা কিছুই টের পায়নি।

এমনও তো হয়
উম্ম মারঈয়াম

অগাস্ট ২৩, ২০১৯ইং