কন্যা সন্তান

বৃষ্টির এক সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে ফেসবুকে স্ক্রোল করছিল সাদিয়া। ইদানিং ফেসবুকে খুব কম সময় দিতে চেষ্টা করে সে। ধর্ষণ, খুন, অত্যাচার, অনাচারের এই সব নিউজগুলো অসুস্থ করে দেয় তাকে। না চাইলেও এসব স্ক্রোল করতে করতে চোখে পড়েই যায়। আচ্ছা, ছবি ছাড়া শুধু খবরটা পোস্ট করলে কী এমন ক্ষতি হয়? এগুলো দেখলে আজকাল বাসা থেকে বের হতেও ভয় করে সাদিয়ার। নিউজফীডে ফেসবুক ফ্রেন্ডদের নিউজ দেখতে লাগলো সে একটার পর একটা।

আসাদ ভাই আজকে অনেক খুশি। তার বড় মেয়ে মুনিয়া স্কুলে সংস্কৃতি প্রতিযোগিতায় নাচে প্রথম হয়েছে। ভারী মেকআপ, নাচের পোষাক পরা মেয়েটির নৃত্যরত ছবি পোস্ট করেছেন তিনি।

সাদিয়ার আজও মনে পড়ে — গত বছর দ্বিতীয় মেয়ে জন্মের পর তার মা অনেক আফসোস করে বলেছিলেন, “একটা ছেলে যদি হতো!” কিন্তু আসাদ ভাই রেগে জবাব দিয়েছিলেন, “কী বলেন আম্মা! মেয়েরা তো জান্নাতের চাবি। আল্লাহ্‌ যেন আমাকে তৃতীয়বারেও কন্যা সন্তানের বাবা করেন।”

কি অদ্ভুত! তাই না? ভাবছে সাদিয়া। জান্নাত পাওয়ার জন্য তিনি নাকি তিন কন্যার পিতা হতে চান। অথচ মেয়েকে নাচ-গান শেখাচ্ছেন, আবার খুশি মনে তা সবাইকে বলেও বেড়াচ্ছেন। সেদিন মেয়ের জন্মদিন পালন করলেন, তা আবার ফেসবুকে জানিয়ে দিতে ভুললেন না। যেই মানুষটা মেয়ের বাবা হয়ে এত্ত খুশি ছিলেন যেন জান্নাতের সুসংবাদ পেয়ে গেছেন; সেই একই ব্যক্তি কিনা মেয়েকে হারামের মধ্যে বড় করছেন, আল্লাহর অসন্তুষ্টি কামাচ্ছেন। তা আবার জনস্মমুখে গর্বের সাথে প্রচারও করছেন।

জান্নাত আশা করার সাথে সাথে যদি তার আমলটাও তেমন হতো! হয়তো ধর্মটাও শেখাচ্ছেন, সপ্তাহে তিনদিন হুজুরের কাছে ঘন্টাখানিক পড়াচ্ছেন মেয়েকে। কিন্তু সেই অনুযায়ী আমল করতে শেখাচ্ছেন কী?

অন্তরার ছবি দিয়েছে ফেসবুকে। ভ্যাকেশনে গেছে থাইল্যান্ড। অন্তরার কাপড় চোপড় দেখে আর ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকা গেলো না! লজ্জাই লাগছিল সাদিয়ার। কী সব কাপড় পরে যে ছবি তুলে ও! আবার ফেসবুকেও দেয় এসব। ওর তিন বছরের মেয়েটা কী শিখছে মা’র কাছ থেকে?

সাদিয়া কয়েকবার অন্তরাকে বোঝাতে চেয়েছিল, কিন্তু ও খুব বিরক্ত হয়। উল্টো সাদিয়াকে বলে তুই আগে কেমন ছিলি! একটু স্মার্ট হ সাদিয়া! কুর’আন, হাদিস, কবর, আখিরাত, জাহান্নাম — কোন কিছু দিয়ে অন্তরাকে এখনো পর্যন্ত বোঝানো সম্ভব হয়নি।

সাদিয়া হাল ছেড়ে দেয় নি। শত হোক ছোট বেলার বান্ধবী। আল্লাহ্‌ তো যাকে ইচ্ছা তাকে হিদায়াত দান করে। আল্লাহ্‌ যেন ওকে সরল পথ দেখান এই দুয়া সাদিয়া সব সময় করে।

শান্তা আপুর পোস্টটা দেখে সাদিয়ার চোখ ভিজে গেল। কষ্টে নয়, খুশিতে। শান্তা আপুর মেয়ে হয়েছে। বিয়ের সাত বছর পর! পর পর তিনবার মিসক্যারেজ হওয়ার পর ডাক্তার তো আশা ছেড়েই দিতে বলেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ্‌র উপর শান্তা আপুর অগাধ বিশ্বাস ছিল যে শেষ রাতে দু’আয় তোলা তার হাত দুটো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ফিরিয়ে দেবেন না।

আল্লাহ্‌ তাকে নিরাশ করেননি। তাকে খালি হাতে ফেরাননি। শান্তা আপু ছোট্ট দু’টা পায়ের ছবি দিয়েছেন ফেসবুকে। ইশ! বাবুটাকে দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে, কেন যে পুরা ছবিটা দিল না! ওহ…আপু তো নিজের ছবিই পোস্ট করেন না, মেয়ের ছবি তো দিবেনই না। নজর লাগার কথা তো রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসাল্লাম নিজেই বলে গেছেন। চক্ষুশীতলকারীনিকে সশরীরে গিয়ে দেখে আসতে হবে একদিন, ভাবল সাদিয়া।

এই সব কিছু দেখতে দেখতে সাদিয়া চিন্তা করছিল তার পরিচিত এক বোনের মেয়ের কথা। এই তো কয়দিন আগেই পরিচয়। আড়াই বছরের ফুলের মতন হিজাবি একটা মেয়ে। তাদের কোন ছবি ফেসবুকে নেই। তার মা বাবা তাকে কত যত্ন করে লালন পালন করছেন। বাবা মার চক্ষুশীতলকারীনি কন্যা। ছোট্ট হিজাবিটার জন্য মন থেকে দুয়া করে সাদিয়া। এই ছোট্ট হিজাবিটা যেন তার মা-বাবার জন্য সাদকায় জারিয়া হয়ে থাকে।

আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যার দু’টি কন্যা সন্তান কিংবা বোন রয়েছে আর সে উত্তমভাবে তাদের ভরণ-পোষণ করলো এবং উপযুক্ত হওয়ার পর ভালো পাত্রের কাছে বিবাহের ব্যবস্থা করলো, আমি ও সে জান্নাতে এভাবে প্রবেশ করবো, যেভাবে এ দু’টি আঙ্গুল মিলে আছে। একথা বলে তিনি ডান হাতের শাহাদাত ও মধ্যমা আঙ্গুলদ্বয় মিলিয়ে দেখালেন।’
[সহীহ ইবেেন হিব্বান : হা. ২০৪৩]

অন্য একটি হাদীসে এসেছে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যার তিনটি কন্যা বা তিনটি বোন আছে, অথবা দু’টি কন্যা বা দু’টি বোন আছে এবং সে তাদের সাথে উত্তমভাবে জীবন অতিবাহিত করে, তাদের হকসমূহ আদায়ের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে, তবে আল্লাহ তাআলা তাকে বিনিময় স্বরুপ জান্নাত দান করবেন।’
[তিরমিযি শরীফ : হা. ১৯৮৮]

ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, তিন শ্রেণীর লোকের প্রতি আল্লাহ তা’আলা জান্নাত হারাম করেছেন।
(১) সর্বদা মদপানকারী
(২) পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান ও
(৩) পরিবারে বেপর্দার সুযোগ দানকারী (দায়ূছ)।
[নাসাঈ, মিশকাত হা/৩৬৫৫]

কন্যা সন্তান আমাদের পিতামাতার জন্য অনেক বড় একটা ‘আমানত। তাকে ইসলামের ছায়ায় বড় করে, দ্বীনদার পাত্রের হাতে পাত্রস্থ করলে একদিকে যেমন আছে জান্নাত পাওয়ার সুযোগ — অপরদিকে বেপর্দায় বড় করলে জাহান্নাম অবধারিত।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করুন। দ্বীনের বিধানগুলো পরিপূর্ণভাবে মেনে চলার তৌফিক দান করুন। আমীন।।

…………………………..
কন্যা সন্তান
রুখসানা নাজনীন ক্যামেলিয়া