খুন!!

অন্তুর ডায়েরী:

আজ সকালে আমি একটা খুন করেছি। আসলে খুন করার কথা ছিল দুইজনকে। মিলি আন্টি আর সুহামণি। বেশি খুন করলে ধরা পড়ে যাব। তাই শুধু মিলি আন্টিকে মেরেছি। সুহামণি এমনিতেই মরে যাবে। মা না থাকলে কেউ বাঁচে না। আমিও মরে যেতাম। মিলি আন্টি আমাদের পাশের বাসায় থাকতে আসলো। আমাকে অনেক আদর করলো। তাই বেঁচে গেছি। আমার মা সারাদিন অরূপ আংকেলের সাথে ফোনে কথা বলে। আংকেল বাসায় আসলে আমাকে মিলি আন্টির কাছে পাঠিয়ে দেয়। তখন মিলি আন্টি আমাকে চকলেট ড্রিংক্স খাওয়ায়। ভাত খাওয়ায়। আন্টি আমার জন্য সুন্দর সুন্দর জামা কিনে রাখে। গোসল করিয়ে পরিয়ে দেয়। আমি আন্টিকে মামনি বলে ডাকতাম। লুকিয়ে লুকিয়ে। মা জানলে ভীষণ মারত। এরপর মিলি আন্টি হসপিটাল থেকে সুহা বেবিকে আনলো। আমাকে আর একটুও আদর করল না। সারাদিন শুধু বলে, ‘আমার সুহামণি কই রে!’

আমি বলতাম, ‘মামনি, আমি অন্তুমণি! এই যে অন্তুমণি!’

মামনি আমাকে পাত্তাই দিত না। এরপর থেকে মামনিকে আমি আন্টি ডাকি। মিলি আন্টি।
সেদিন চুপচাপ সুহামণির হাত মুচড়ে দিয়েছিলাম। আন্টি কীভাবে যেন টের পেয়ে গেল। আমাকে সে কী বকা! খুব কাঁদলাম আমি। আর জীবনেও আন্টির কাছে আসব না। অরূপ আংকেল বাসায় আসলেও না। মা বাবা মারামারি করলেও না। আমি বাসাতেই থাকব। স্কুল থেকে ফিরে বসে বসে শুধু টিভি দেখব। আর গেমস খেলব। রাতে বাবা যখন ক্রাইম পেট্রোল দেখবে, আমিও দেখব। ক্রাইম পেট্রোল আমার একটুও ভালো লাগে না। বাবাকেও আমার ভালো লাগে না। কার্টুন দেখতে দেয় না। শুধু ক্রাইম পেট্রোল দেখে। আমিও দেখি। খুব বাজে। শুধু খুন হয়। সবাই কাঁদে, আর খুনিরা ধরা পড়ে যায়। আমি অবশ্য ধরা পড়ব না। সবাই ভাববে মিলি আন্টি ডিপ্রেশনে মারা গেছে৷ বাচ্চা হলে সবাই এভাবেই মারা যায়। টিভিতে দেখেছি আমি। অনেক কঠিন অসুখ এটা। মিলি আন্টিরও এই অসুখ ছিল। সাফি আংকেল বলতো, ‘মিলি কুরআন পড়ো, তোমার ভালো লাগবে’।

আন্টি চিৎকার দিত। ‘তুমি আমাকে কুরআন তিলওয়াত করে শোনাতে পারো না? একা হাতে কয়টা করব আমি?’

সাফি আংকেল রাগ হতো খুব। কিছু বলত না। ওরা আমার মা বাবার মতো ঝগড়া করে না। মারামারি করে না। চিৎকার দিয়ে চুপ হয়ে যায়। আমার মা বাবা খুব ভয়ংকর। রাগ হয়ে পঁচা কথা বলে। আমার ওসব কথা বলা বারণ। আমার আম্মুর বয়ফ্রেন্ড আছে। অরূপ আংকেল। বাবা জানে না। কিন্তু খুব সন্দেহ করে। প্রত্যেকটা দিন ঝগড়া করে! প্রত্যেকটা দিন!
মিলি আন্টির কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই। সারাদিন কাজ করে। আর মাঝে মাঝে কাঁদে। ফোন করে সাফি আঙ্কেলকে বকা দেয়। বলে মরে যাবে। আজকে তো আমিই আন্টিকে মেরে ফেলেছি। সাফি আংকেল অনেক একা হয়ে যাবে। সুহামণিকে বাসায় রেখে অফিসে যাবে। কেউ ওকে খাবার দিবে না। না খেতে পেরে সুহামণিও মরে যাবে।

মিলির ডায়েরী:

অন্তুকে আজ খুব করে বকেছি। খেলতে খেলতে কোন ফাকে সুহার হাত মুচড়ে দিয়েছে। সুহা চিৎকার করে কান্না। আর ও ফোকলা দাঁতে হেসে বলছে ‘সুহামণিকে হাতে ব্যাথা দিয়েছি মামনি!’ মেজাজ ধরে রাখতে পারিনি আর৷ সারাদিন দৌড়ের উপর থাকি৷ এরমাঝে ও এসে হাজির হয়। এসেই নানান বায়না, আবদার। সুহাকে একা হাতে সামলে ওর দিকে তাকানোরও সময় পাই না। আমি জানি ওর কষ্ট লাগে। তারচেয়েও কষ্ট লাগে আমার। ওর বিষণ্ণ মুখটা দেখলে কষ্টে মরে যেতে ইচ্ছা করে। মনে হয় কেউ অন্তরটা ব্লেড দিয়ে চিরে ফালা ফালা করে দিচ্ছে।

জীবনটা বড় অদ্ভুত। একটা সময় অন্তুকে চোখে হারাতাম। ওকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চাইতাম। ওর পাকা পাকা কথা, হাসি কান্না সব মনে মনে আওড়াতাম। আর এখন পালিয়ে বাঁচতে চাই। মনে হয় অন্তুটা না আসুক। ও আসলে সুহার দেখভাল অনেক কঠিন হয়ে যায়। সাত বছরের পাকা ছেলে। ওর সামনে সুহাকে শান্তিমতো দুধ খাওয়ানো যায় না। ডায়াপার বদলানো যায় না। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে একটা চুক্তিতে এসেছি। যখন সুহাকে ডায়াপার বদলে দিব, তখন ও পাশের রুমে চলে যাবে। আমি ডাকার আগে আসবে না। দুই মিনিট যেতে না যেতেই ছেলেটা অস্থির হয়ে যায়। দরজার কাছে এসে পেছন ফিরে বলে ‘আসব? মামনি আসব?’ মেজাজ চড়ে যায় না চাইতেই।
অন্তু আমার খেলার সাথী ছিল। দুই বছর আগে আমরা ওদের পাশের ফ্ল্যাটে উঠেছিলাম। কিছু মানুষকে দেখলেই আমার মনে কেমন যেন এলার্ম বেজে ওঠে। অন্তুর মা সেরকম এক মহিলা। স্বাভাবিকের চেয়েও অনেক জোরে এলার্ম বাজলো তাকে দেখে। এরপর এলার্মের সত্যতা টের পেলাম। ছেলের প্রতি তার খেয়াল নেই একদমই। প্রতিরাতে স্বামী স্ত্রী চিৎকার চেঁচামেচি করে। মারামারিও করে। একপক্ষ মারছে, আরেকপক্ষ খাচ্ছে এমন না। এ ফ্ল্যাট থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় দ্বিপাক্ষিক ব্যাপার স্যাপার। ওদের হানাহানিতে অন্তুর জন্য বুক কাঁপত। মনে হতো দৌড়ে যদি ওকে নিজের কাছে এনে ফেলতে পারতাম! তখন বিয়ের চার বছর চলছে। দুই দুইটা মিসক্যারেজের কষ্ট নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাই। মানুষ জানে না, বোঝেও না। দেখা হলেই আলটপকা বলে বসে, ‘এখন কিন্তু একটা বাচ্চা নেয়া দরকার। পরে আফসোস করবে!’ এরপর সাফির ভালো একটা চাকরি হলো ঢাকায়। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আত্মীয়স্বজন শুভাকাঙ্ক্ষী ছেড়ে ঢাকার ঘিঞ্জি গলিতে নিঃশ্বাস নেয়ার জায়গা খুঁজে পেলাম। আর পেলাম অন্তুকে। পাকা বুড়োটা প্রতিদিন বাসায় আসতো, আমাকে মামনি ডাকতো। মায়ের সামনে একবার মামনি ডেকে ভীষণ মার খেল। এরপর আমি সবার সামনে মিলি আন্টি, আর গোপনে মামনি। আজ ছেলেটা বকা খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো ‘তোমাকে আর জীবনেও মামনি ডাকব না। জীবনেও না।’
উচিত ছিল জরিয়ে ধরে আদর করে দেয়া। কিন্তু কী যে অসহ্য লাগছিলো! কী যে অসহ্য! বলে বোঝানো যাবে না। কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল, ফিরালাম না। মনে হচ্ছিল ও গেলেই বাঁচি৷ সুহাকে গোসল করিয়ে ঘুম পাড়ানো যাবে।

সুহাকে গোসল করালাম। ঘুম পাড়ালাম। নিজেও একটু চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। চোখ মুদলেই অন্তুর মুখ। ও আমাকে আর জীবনেও মামনি ডাকবে না। কীভাবে এত স্বার্থপর হলাম আমি! সুহা হওয়ার পর থেকেই আমার বদলে যাওয়া শুরু। আগে কত ভাবতাম দু’জনকেই সমান চোখে দেখব। দরকার পড়লে অন্তুকে একটু বেশিই আদর করব। ও যেন সুহাকে আদর করতে দেখলে কষ্ট না পায়। আর এখন! সুহাকে দেখতে গিয়ে খেই তো হারিয়েছিই, সেইসাথে নানান চিন্তা যোগ হয়েছে। আর দুদিন পরই অন্তু বালেগ হয়ে যাবে। ও তো আমাকে মা-ই মনে করে। সামলাবো কীভাবে ওকে? সবকিছু মিলিয়ে অন্তুকে দেখলেই মনে হয় পালাতে হবে। পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই। কোনো উপায় নেই!

সাফিকে বলেছিলাম বাসা পাল্টানোর কথা। নইলে অন্তুকে এড়ানো অসম্ভব। সাফি ধমকে উঠল। ‘এত খাতির করতে গেলে কেন? বাচ্চা দেখলে হুশ থাকে না?’

বাচ্চা দেখলে হুশ থাকে না কেন এটা ওকে বোঝানো সম্ভব না। ও আছে কেবল ঝাড়ি দেবার তালে। অন্তুর জন্য সুহাকে পালতে সমস্যা হচ্ছে তাতেও ভ্রুক্ষেপ নেই। উলটো বলে, ‘এতদিন যখন নিজের ছেলের মতোই দেখেছো, এখনও সেভাবেই দেখা উচিত। মনে করো সুহা দ্বিতীয় সন্তান। তাহলেই সব ম্যানেজ করে ফেলতে পারবে। ও তো আর সারাদিন এ বাসায় থাকে না।’
ওর কথা হয়তো ঠিক। কিন্তু ব্যাপারটা উচিত অনুচিতে আটকে নেই। পারা না পারার পর্যায়ে চলে গেছে। ভীষণ কান্না পায়। অন্তুকে আগের মতো ভালোবাসতে না পারার কষ্ট কাউকে বোঝাতে পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয় মরে গেলেই সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু সেখানেও সমস্যা! সুহাটা হওয়ার সময় যদি মরে যেতাম, হয়তো শহীদের মর্যাদা পেতাম। এখন মরলে কপালে কী আছে কে জানে!

অন্তুর ডায়েরী:

কাল আমি কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরেছি। মিলি আন্টি ফেরায়নি। একবারও ডাকেনি। তবু আজ আন্টির বাসায় যাব। আন্টিকে খুন করতে যাব আজ। বাসায় বসে অনেক ভেবেছি। সকালে সাফি আংকেল চলে গেলে আন্টি কফি খায়। তখন আন্টির কফিতে স্লিপিং পিল ঢেলে দিব। আমার আম্মু আব্বু সারারাত ঝগড়া করে। ঝগড়া করে ওদের ঘুম আসে না। তখন স্লিপিং পিল খায়। একটা খেলে কিছু হয় না। আমি অনেকগুলা পিল গুড়ো করেছি। টিস্যুতে সব গুড়ো তুলে এনেছি। একটু ময়লাও আছে। ফ্লোরে গুড়ো করেছি তো!

মিলি আন্টি মরে আল্লাহর কাছে চলে যাবে। আল্লাহ যেন মিলি আন্টিকে বলে দেয় আমার কত মন খারাপ। তখন আফসোস করেও লাভ হবে না। একবার মরলে আর ফিরে এসে আদর করা যাবে না। খুব শিক্ষা হবে মামনির। না না মামনি না, আন্টি। মিলি আন্টি।
দরজায় নক করতেই মিলি আন্টি খুলে দিল। আমাকে জরিয়ে ধরে বলল ‘অন্তু বাবা স্যরি। কালকে অনেক বকেছি না?’

এখন এসব বলে লাভ নেই। আন্টিকে আমি আর ভালোবাসি না। একটু খারাপ লাগছে। প্রথম খুন তো! কিন্তু আন্টি কোনো কষ্ট পাবে না। ঘুমের মধ্যে মরে যাবে। আমার কারো কষ্ট ভালো লাগে না। সুহাকেও কষ্ট দিতে চাইনি। কাল ওর হাতটা দেখে মনে হলো একটু মুচড়ে দেখি কেমন লাগে। তাই একটু মুচড়ে দিয়েছিলাম। তাতেই এত রাগের কী আছে? সুহা বেবী আসার পর আন্টি বদলে গেছে।

আন্টি আমাকে রুমের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। সুহামণির ডায়াপার চেঞ্জ করবে। এখন ঐ রুমে যাওয়া বারণ। ওভেনে পিইপ পিইপ করে আওয়াজ হলো। মনে হয় কফি বানাতে দিয়েছে। আমি ওভেন খুলে দ্রুত স্লিপিং পিলের গুড়ো ঢেলে দিয়েছি। বেশিক্ষণ এই বাসায় থাকা যাবে না। থাকলে ধরা পড়ে যাব।
আন্টি এসে ওভেন থেকে কফি বের করে নিয়েছে। আমাকে সুহার পাশে বসতে বলেছে। আন্টি কফিতে দুইবার চুমুক দিল। আমার যাওয়া দরকার। আন্টি এখনই মরে যাবে। ‘আন্টি আমি যাই বলে দৌড় দিলাম।’ সুহা কান্না শুরু করেছে। ও কথা বলতে পারে না। দুধ খাওয়ার জন্য কাঁদে। আমি দরজা খুলে এক দৌড়ে নিজের বাসায় চলে এসেছি।

সাফির ডায়েরী:

প্রত্যেকটা সেকেন্ডকে ঘন্টার মতো মনে হচ্ছে। মিলিকে ক্রমাগত ফোন দিয়ে যাচ্ছি। ধরছে না। এই সময়ে ওকে ফোন দেয়া বারণ। দুপুর বেলা একটু ঘুমানোর চেষ্টা করে মেয়েটা। টুং টাং শব্দ হলেই তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আজ ফোন না দিয়ে উপায় নেই। সিএনজিতে বসে আছি। জ্যামে সিএনজি ঘড়ঘড় আওয়াজ করে যাচ্ছে। মন চাইছে সব গাড়ি টপকে দৌড়ে বাসায় চলে যাই।
একটু আগে অন্তু ফোন দিয়েছিল। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, ‘আংকেল আমি মামনিকে খুন করে ফেলেছি। মামনি মরে গেছে।’

প্রথমে বুঝিনি কী বলছে। কান্না থামিয়ে ভালোভাবে বলতে বললাম। তখন বললো মিলির কফিতে দুই পাতা পিল গুড়ো করে দিয়েছিল। মিলি সেই কফি খেয়ে মরে গেছে।

মাথা কাজ করছে না। বেশ কয়েকবার ফোন দিলাম মিলিকে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। এ জীবনে কি বাসায় ফিরতে পারব?

বাসায় অবশ্য ফিরতে পারলাম। চাবি দিয়ে লক খুলেই সরাসরি বেডরুমে। চমকের অনেক বাকি ছিল। খুন হওয়া মিলি চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসেছে৷ ফোনটা হাতে নিয়ে আমার দিকে চোখ পড়তেই চিৎকার। অথচ চিৎকার দেয়ার কথা আমার। ভুত তো আমি দেখছি, ও নয়। শান্ত করার চেষ্টা করলাম। বোঝাতে লাগলাম আমি আমিই। জ্বীন না। ও একবার উচ্চস্বরে আয়াতুল কুরসী পড়ল। তারপরও ভ্যানিশ হলাম না দেখে মেনে নিল আমিই ওর স্বামী।

কফির কাপটা বিছানার পাশে রাখা। পুরোটা খায়নি। দুই এক চুমুক খেয়েছে মনে হয়। তারমানে ও আসলে খুন হয়নি। ভয়ের কিছু নেই। কাপটা নিয়ে রান্নাঘরে গেলাম। কফির নিচে ওষুধের পুরু তলানী জমে আছে। খুনী অন্তু ওষুধটা গুলিয়ে দেয়নি মনে হচ্ছে।
সুন্দর করে কাপ ধুয়ে শেল্ফে রাখছি, তখন মিলি পেছনে এসে দাড়ালো।

‘অফিস থেকে ফিরেই তোমার কাপ পিরিচ ধুতে হবে? আমি তো কফিটা শেষ করিনি। ফেলে দিলে কেন?’
‘তোমার না কফি খাওয়া নিষেধ?’ মুখ খুব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম।

‘তাই বলে ফেলে দিবে? খাবার নষ্ট হলো না?’
‘সেটা আমার হিসাব। ভাগো এখান থেকে।’
মিলি চিরাচরিত বিরক্তিমাখা দৃষ্টি দিয়ে চলে গেল। ভাগ্যিস এটা কফি ছিল। অন্যকিছু হলে কৈফিয়ত দিতে দিতে জান বেরিয়ে যেত।

ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে নিলাম। মিলিকে বললাম আগামী শুক্রবার নতুন বাসা দেখতে বের হব। অফিসের কাছে কোথাও বাসা নেয়া দরকার। অদ্ভুত মেয়েমানুষ। এতদিন বাসা পাল্টানোর জন্য পাগল ছিল। আজ আমার কথা শুনেই বলে উঠল, ‘কিন্তু আমার অন্তুর কী হবে?

সত্যি বলতে এই খুনটা না হলেও আমি বাসা পাল্টাতাম। অন্তু বালেগ হয়ে গেলে আসলেই মিলির কষ্ট হয়ে যাবে। ওর সামনে কতটুকু পর্দা করতে পারবে তার ঠিক নেই। অন্তুর ব্যাপারে ওর বাবার সাথে কয়েকদফা আলোচনা হয়ে গেছে। আজব ব্যাপার হলো অন্তুর মা বাবা দু’জনেই জানে ওরা প্যারেন্ট হিসেবে খুবই জঘন্য। অন্তুর ক্ষতি হচ্ছে। তবু যেই লাউ সেই কদু। আজ হয়তো জোর দিয়ে বোঝাতে পারব। ফোন দিয়েছিলাম একটু আগে। বললেন বাসায় ফিরেই আমার সাথে দেখা করবেন।

মিলির ডায়েরী:

আজ শনিবার। সাফি আমাকে আর সুহামণিকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে। কোথায় যাচ্ছে বলছে না। শীত নেমে গেছে। দিনে দুপুরেও রাস্তায় কুয়াশা। সুহাকে অনেক জামা কাপড় পরিয়েছি। তবু মন মানছে না। সুন্দর করে ছোট্ট একটা স্কার্ফ পরিয়ে দিয়েছি, কানটা ভালোমতো ঢাকা জরুরী। সাফি দেখে খুব হাসলো।

হাসতে হাসতে বললো, ‘মাশাআল্লাহ! আমার মেয়ে তো হিজাবি মুসলিমাহ হয়ে গেছে! ভালোই হয়েছে। যেখানে যাচ্ছি, সেখানে এমন পোশাকই মানানসই।’

আমাদের সিএনজি থামলো একটা আবাসিক মাদ্রাসার সামনে। মনের ভেতর চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। এখানেই আমার অন্তুমণি থাকে না তো?

আমরা বাসা পাল্টেছি দুইমাস হলো। সাফির মুখে শুনেছি অন্তুকে ওর মা বাবা আবাসিক মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। খুব অবাক হয়েছিলাম। কীভাবে সম্ভব? সাফি খুব নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেছিল, ‘জীবনে শুনোনি, সন্তানকে মা বাবা মাদ্রাসায় দিয়েছে? আজকে প্রথম?’

ওর সাথে আসলে কথা বলাই বৃথা। যে বিষয়গুলো আমার কাছে অদ্ভুত, ওর কাছে তা খুবই স্বাভাবিক।
ওয়েটিং রুমে বসে আছি। মন বলছে এটাই অন্তুর মাদ্রাসা। সত্যিই তাই। ওই তো নীল জুব্বা পরা অন্তুমণি দৌড়ে আসছে। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। ও যেন দেখতেই পায়নি সেটা। আমাকে পাশ কাটিয়ে সাফিকে জড়িয়ে ধরলো।

‘অন্তুমণি, মামনিকে ভুলে গেছিস?’
এতক্ষণে তার নজর পড়লো আমার দিকে। হাতটা তখনো বাড়িয়েই রেখেছি। সেটা দেখে ছিটকে গেল, ‘না বাবা তুমি আমার গাইর মাহরাম। তোমার সাথে হাত মেলানো যাবে না!’

মন চাইলো পাকা বুড়াটাকে কোলে নিয়ে বলি ‘এই বুড়া, তুই বালেগ হয়েছিস?’

বললাম না। একদিন তো বালেগ হয়েই যাবে। অভ্যাসটা নাহয় এখন থেকেই শুরু হলো!

………………….