গুরাবা

১.
ইমন ঘামছে রীতিমত। এতক্ষণে বিদেশী বসের চলে আসার কথা। বস এসে সবার সাথে দেখা করে হাত মিলাবে। গায়ের মাহরাম মহিলার সাথে হাত মিলাবে না বলে ওয়াশরুমে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে ইমন। গতবার মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি, হাত মিলিয়েছিল। পরে প্রচন্ড অনুশোচনা হয়েছে। হাত মিলানো রিজেক্ট করবে এমন সাহসও করে উঠতে পারেনি সে। অথচ সেদিন বাসায় বড় মামী এসে পিঠে হাত দিয়ে বলেছিল, “কেমন আছিস,বাবা?” ঠাস করে বলে দিয়েছিল ইমন, “মামী! আপনি আমার গায়ের মাহরাম। গায়ে হাত দিয়ে কথা বলছেন কেন?” এই নিয়ে মায়ের সেকি রাগ! দুইদিন কথাই বলেননি। বাসার স্পষ্টভাষী ইমন অফিসের মুখচোরা। অফিসের সবাই ওর মেয়ে এড়ানো স্বভাব দেখে হাসাহাসি করে। সবার মাঝে নিজেকে খুব বেমানান মনে হয়। রাস্তা বা অফিস প্রতিটা জায়গায় চোখ নামিয়ে, আস্তাগফিরুল্লাহ পড়তে পড়তে চলে সে। বাসায় ঢুকে যা শান্তি। নয়তো সব জায়গা জেলখানার মতো লাগে ওর। পেপার, বিলবোর্ড বা টিভি কোথাও তাকানোর উপায় নেই। ইন্টারনেট চালায় অনেক ফিল্টার করে করে, তবু চোখের হেফাজত করতে পারে কই? এখন মেয়েদের মধ্যে হিজাব যেমন বেড়েছে, আধুনিক পোশাকের চলও বেড়েছে। ইমনের মতো যারা আছে তারা খুব বেমানান এমন পরিবেশে। ইমন একজন গারীব; একজন আগন্তুক এই জগতে।

২.
খুব কষ্টে চুপচাপ চোখের পানি আটকাচ্ছে লিরা। মায়ের উপর প্রচন্ড অভিমান হচ্ছে। খালার বাসায় দাওয়াতে এসেছে ও। খালার বাসায় প্রতিবছর বড় করে আত্মীয়দের মিলনমেলা হয়। লিরা কখনোই মিস দিতো না। কাজিন, মামা-মামী, খালা-খালুদের হইচই এ সরগরম হতো সারা বাড়ি। আড্ডা আর খাওয়া দাওয়ায় সময় কেঁটে যেতো নিমিষেই। পর্দা শুরুর পর থেকে লিরা গত বছর আর আসে নি। খালা জানার পর তো সেই রাগ। ছেলেরা- মেয়েরা আলাদা আলাদাই খাবে নাহয়, লিরাকে আসতেই হবে। মায়ের সাথে লিরা চলে এসেছে সন্ধ্যার পরপরই। সবাই ড্রয়িং এ চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে, আর লিরা একা এক রুমে বসে আছে। মাঝে মাঝে মেয়েরা ওর রুমে আসছে অবশ্য, কিন্তু চুলটা আরেকটু আঁচড়ে নিতে বা লিপিস্টিকটা গাঢ় করতে। লিরার নিজেকে রেস্টরুমের দাড়োয়ান মনে হচ্ছে। খাওয়ার সময় ছেলেরা মেয়েরা আলাদা খেয়ে নিলো, কিন্তু ঠিকই লিরাকে নিয়ে হাসি তামাশা চললো।
“কিরে রিকশাওয়ালা তো লোক, তার রিকশায় চড়ে আসলি যে?” মামাতো বোন শিউলির কথায় সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ে। সবার সাথে তাল দিতে মাও হাসে। তারপর কী মনে করে আবার বলে, “লিরা যা করছে, ঠিকই করছে। আমি পারি না, ও পারছে। করুক না!”
মায়ের কথা মাটিতে পড়তে দেয় না খালা, মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, “ইসলাম কী এতই কঠিন? আমরা কী ইসলামের কিছুই জানিনা?”
মতামত চলতেই থাকে। লিরা কোনো কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে নেয়। লিরা একজন গারীবা; একজন আগন্তুক আত্মীয়দের মাঝে।

৩.
নিজের শহর ছেড়ে যাচ্ছেন তিনি, সাথে স্ত্রী আর ভাতিজা। মূর্তি পুজার কোনো যুক্তি খুঁজে পাননি তিনি। রবকে খুঁজে ফিরেছেন কত শত দিন। নিজ হাতে গড়া মূর্তি নয়, সূর্য নয়, চাঁদ নয়, নয় কোনো নক্ষত্র, সত্যিকার রবকে অবশেষে পেয়েছেন। কিন্তু তার চিরচেনা শহরের মানুষরা তার তওহীদের ডাক গ্রহণ করেনি। দিতে হয়েছে অগ্নিপরীক্ষা। অবশ্য আগুন তার রবের নির্দেশে শীতল হয়ে গিয়েছিল।
তওহীদের প্রচারণায় শহর ছাড়ছেন তিনি, সাথে স্ত্রী সারাহ (আ:) আর ভাতিজা লুত (আ:)। শুধু এই দুইজন তওহীদকে মনে ধারণ করেছে। তার রব তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) একজন গারীব; একজন আগন্তুক তার জন্মভূমিতে।

৪.
সিজদাহ থেকে উঠতে পারছেন না তিনি। পিঠের উপর খুব ভারি কিছু ফেলেছে কেউ। ছোট্ট মেয়েটা দৌড়ে আসে। বাবার পিঠে ভেড়ার নাড়িভুঁড়ি ফেলেছে মুশরিক উকবা, বাবার পেরেশানি দেখে আরো কয়েকজন দাঁড়িয়ে হাসছে। বাবাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে ফাতিমা। তার বাবা সবার কাছে কত্ত প্রিয় ছিল, শুধু তওহীদের দাওয়াত দেয়ায় আজ সবাই তার শত্রু। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার বাবা, শুধুমাত্র শিরক নিশ্চহ্ন করার মিশনের জন্যে ‘আল-আমিন’ উপাধি পাওয়া মানুষটাকে আজ সবাই পাগল, জাদুগ্রস্থ বলছে।

যখন ফাতিমার (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা) মার চাচাতো ভাই ওয়ারাকা বলেছিল,”তোমাকে তোমার জাতির লোকেরা বের করে দিবে” তখন শুনতেও কতো অদ্ভুত লাগছিলো রাসূলুল্লাহর কাছে। অথচ আজ রাসূলুল্লাহ (সা:) একজন গারীব, একজন আগন্তুক এই শিরকের জগতে।

গুরাবা
– উম্মে লিলি

(২৪/০১/২০১৯)