ছুটির দিনে

নাবিলা নোশিন সেঁজুতি

‘মা, আজকে ডাল নেই কেন?’ অনুযোগের সুরে সাদিয়া জিজ্ঞেস করল। ‘শুকনো ভাত গলা দিয়ে নামে, বলো?’

‘মাছের ঝোল দিয়ে মেখে খেয়ে নে, মা। ডাল, রসুন শেষ কালকেই। তোর বাবা এই বৃষ্টির পানি কাদা মাড়িয়ে বাজারে যেতে পারবে না বলেছে।’ নিতু মাছের বাটি থেকে চামচ দিয়ে তেল সরিয়ে সাবধানে মেয়ের পাতে খানিকটা ঝোল তুলে দিল। রায়হানের পকেটের খবর নিতুর চেয়ে ভালো আর কে জানবে। মানিব্যাগে যে কয়েকশ টাকা গুঁজে দিবে, তারও উপায় নেই। আত্মসম্মানবোধে টইটুম্বুর মানুষটা হয়ত রাতে আর ভাতই খাবে না, নিথর হয়ে পাশ ফিরে শুয়ে থাকবে।

‘স্যরিই, মা!’ নিচের ঠোঁট কামড়ে আড়চোখে মায়ের দিকে তাকালো সাদিয়া। সরু সরু আঙুলগুলো দিয়ে তাড়াতাড়ি ভাত মাখতে লাগল। খেয়েই কোচিং ছুটতে হবে।

‘স্যরি হতে হবে কেন?’ হাসিটা কেমন যেন
শুষ্ক দেখালো নিতুর চেহারায়। ‘আজকে বিকেলে বের হয়ে আমিই নিয়ে আসব বরং। আরো কিছু টুকিটাকি আছে বাজার সদাই, সেরে ফেলতে পারলে ভালোই হয়।’

‘আজকে তোমার অফ ডে, মা! তুমি ভাত খেয়ে ঘুম দাও তো প্লিজ।’

‘ ঘুমই তো আসে না রে। তাছাড়া ইবু তো সারা দুপুর ঝাপাঝাপি করতেই থাকবে।ছেলে না বাঁদর কিছুই বুঝি না!’

‘হি হি!’ ঝুঁটি দুলিয়ে হাসতে লাগল সাদিয়া। ‘মা, বাঁদরামো ও তোমাকে দেখলেই করে, জানো? ময়নার মা চোখ পাকালেই লক্ষী হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ভাত খেয়ে। তোমাকে দেখে আহ্লাদ বেড়ে যায় ওর।’

এবার হাসিটা ফুটে ওঠে নিতুর চোখে। ‘শুধু ইবুর আহ্লাদ বাড়ে? তোর হয় না?’

‘আমার ডিকশনারিতে আহ্লাদ বলে কিছু নাই, মা।’ চেহারাটা করুণ করে তোলে সাদিয়া। ‘আছে শুধু এক বস্তা জ্যামিতি আর আর করল্লার মতন তিতা জিওগ্রাফী আর ইতিহাস পাঁতিহাস এসব।’

হাসতে হাসতে টেবিল ছাড়ে নিতু। বারোতে পা দেয়া মেয়েটা তার সম্ভবত সবচেয়ে কাছের বন্ধু। সেই ছোট থেকেই দেখে আসছে মায়ের নিত্য জীবনযুদ্ধ, তাই কি এমন সুবোধ মেয়েটা? বয়সগত চাঞ্চল্য নেই তা নয়, তবে আরো ছোট থেকেই এত ভেবে চিন্তে কথা বলে যে কেমন যেন হৃদয় মোচড় দেয় কচি মুখটার দিকে তাকালে। সাত বছরের ইবু অবশ্য অন্য ধাঁচের। একাধারে আবদার, দুষ্টুমি চলছেই। এ বয়সে সাদিয়া যেমন নিতুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অফিসের জন্য বিদায় জানাতো বিনা বাক্যব্যয়ে, ইবু ততটাই অবুঝ ভঙ্গিতে প্রতিদিন বলবে, ‘আজকে অফিস যেয়ো না, মা! আজকে স্কুল থেকে আমাকে নিতে এসো, তারপর পার্কে যাব। ময়নার মাকে মানা করে দাও আজকে আমাকে আনতে।’

অথবা দামী কোন চল্কেট বা খেলনা চেয়ে বসবে। নিতু চুপ থাকলেও সাদিয়ার ভ্রুকুটিময় ইশারায় দায়সারা ভাবে চুপ মেরে যাবে। প্রতিদিন একই কাহিনী। শুক্রবারটা ছাড়া, ইবু জানে সেদিন মায়ের ছুটি,বড় বোনের ভ্রুকুটির অল্পই তোয়াক্কা করে তাই সে এদিন।

খাওয়া শেষে বিছানার পাশের ড্রয়ার থেকে প্লাস্টিকের কৌটা বের করে অল্প কিছু মৌরি মুখে ফেলল নিতু। চিবাতে চিবাতে বিছানায় একটু গড়িয়ে নেবে, হাতে মেয়েলি কোন এক পত্রিকা অথবা পুরনো কোন বই। ছুটির দিনের এইটুকুই শৌখিনতা বড় ভালো লাগে তার। সাদিয়ার কোচিং সামনের বিল্ডিঙে হওয়াতে রক্ষা, আলাদা ছোটাছুটির বালাই নেই। তবে মেয়েটার বড্ড কষ্ট হয়ে যায়। হাপুসহুপুস নাকেমুখে দুটা গুজেই কোচিং দৌড়াতে হয়। আগে এ মাসটা শুক্রবারেও ক্লাস হবে, সামনে পরীক্ষা।

‘মা, আমাকেও পান মশলা দাও।’ ইবুর আবদারে চিন্তার খেই হারিয়ে গেল নিতুর। মায়ের পাশে শুয়ে পেটে মাথা রাখল ইবু, মায়ের গায়ের গন্ধ তার ভারী ভালো লাগে। আপুটাকে একবার বলেছিল, ‘আপু, মায়ের গায়ে আল্লাহ্‌ একটা পারফিউম দিসে, না? আমার গায়েও কি আছে?’ আপু এমন হেসে কুটিকুটি যে লজ্জায় ইবুর মাথা কাটা যাচ্ছিল। কেন যে আপুটা এমন কথায় কথায় হি হি করে? ময়নার মাকেও বলা লাগল কথাটা, মহিলা তরমুজের বিচির মতন দাত বের করে ফিচিক ফিচিক হাসতে লাগল, ‘আবুরে, বাদে দেখবা আম্মার গন্ধ আর ভালা পাইবা না। আম্মা ধরলেও শরিলে জলুনি হইব। আমার পুলায় অহন ধারেও আইতে দেয় না। কয়, আম্মা তোমার গায় রসুন রসুন গন্ধ কেরে?’ কোন মানে হয় এসবের?

‘আচ্ছা, দিচ্ছি। ইবু, দেখ তো তোর আব্বু ঘরে ফিরল নাকি?’

‘উঁহু। আব্বু তো বড়ব্বার ঘরে। ময়নার মাকে দিয়ে মোটা ফাইলগুলা ঝাড়ায় নিয়ে বাবা দোতালায় চলে গেল।’ কুটকুট করে মৌরি চিবাতে চিবাতে উত্তর দিল ইবু।

বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হল নিতুর। সেই ফাইল, সেই বস্তাপচা এক আঁটি স্বপ্ন। আহারে, মানুষটা এখনো আশা রাখে। পৈতৃক সব সম্পত্তি আত্মসাৎ করা বড় ভাইয়ের কাছেই বার বার ছুটে যায় নিজের পরিকল্পিত বিভিন্ন ব্যবসার নীলনকশা নিয়ে, যদি বড় ভাই রাজী হয় ব্যবসার মূলধন ধার হিসেবে দিতে। ধার! মুখের ভেতর তেতো লাগে নিতুর। কোটি টাকার পৈতৃক সম্পদ নিজের নামে করে ছোট ভাইকে দয়া করে ছয় তলাটা লিখে দিয়েছেন যে মুখোশধারী দরাজদিল বড় ভাই, তার কাছে হাত পাতা! আবার, আবার। রায়হানের কবে বুঝ হবে?

‘ছোটু, হিসেবে তুই কিন্তু কিছুই পাস না, আর। মানে, তোর মালয়েশিয়ায় পড়ার খরচ, বিয়ের খরচ, আর তারপর ধর সাদিয়া মা আর ইবুর জন্মের সময়কার খরচাপাতি এসব হিসাব করে দেখলে তুই আমার চেয়ে ভাগে বেশীই পেয়ে গেসিশ। তারপরেও আমি তোরে ভিটার কিছু দিতে চাই। মিরপুরে এই ছয় তালা করতে আব্বারে আমিই টাকা দিসি, তুই তো জানস্ না। হিসাবে এটা আমারই হয়। কিন্তু ছোট ভাইরে তো ফেলতে পারি না, বুঝছিস না? তার উপর ব্যবসায় এমন লস খাইসোস, আমার তো বিবেক আছে, না কি? তোরে আমি ছয় তলাটা দিলাম, যাহ। ২টা রুম তো তোলাই আছে, বাকিটা আস্তে ধীরে করে ফেলিস আর কি।’

মাথা নিচু করে চলে এসেছিল রায়হান, চোখে ভাসে নিতুর। শ্বশুর জীবিত থাকতে খুব আদর করতেন নিতুকে। উনিই গল্পের ছলে বলেছিলেন কিভাবে পাই পাই জমিয়ে হারাম না ছুঁয়ে এ বাড়ির প্রতিটা ইটের গাঁথুনির খরচ জুগিয়েছেন।

‘মা রে, লোকে বলত ভেক ধরা দরবেশ। ভাবত, আড়ালে আবডালে ঘুষ তো নিশ্চিত খাই। একবার এক লোক জোর করে দুই হাড়ি দই ধরিয়ে দিয়ে গেল। বাসায় এসে হাড়ি খুলে দেখি, কতশত কড়কড়ে পাঁচশ টাকার নোট ভিতরে তোড়াবাঁধা!’

‘তারপর কি করলেন,বাবা?’ গালে হাত দিয়ে নিতু বৃদ্ধ মানুষটার একই গল্প বারে বারে শুনত। সাদিয়া একটু বড় হলে সেও যোগ দিত দাদাভাইয়ের গল্প শোনার আশে। কোন গা ছমছমে এডভেঞ্চারের চেয়ে কোন অংশেই কম মনে হত না দাদাভাইয়ের জীবনের গল্পগুলো। ইবু তখন একেবারে কোলের বাচ্চা।
‘আর কি করব? একেবারে অফিসে সবার সামনে ডেকে হাটে হাড়ি ভেঙে দিলাম!সত্যি সত্যি হাড়ি ভাঙা যাকে বলে।’ হাসতে হাসতে বলত আত্ম অভিমানী মানুষটা। সে মানুষের বড় ছেলে এমন ন্যায় নীতি বিবর্জিত, ভাবতেই গা গুলিয়ে আসে বিবমিষায়।

‘মা, মা? মোরি গাছ কেমন হয় দেখতে? মোরিগুলা কি ফুলের মতন থাকে?’

‘মোরি কি রে? বল্, মৌরি। উম, জানি না।গুগলে দেখতে হবে। যা তো, পানির বোতলটা ভরে নিয়ে আয়। পান মশলা খেলেই পানির তেষ্টা পায়।’

‘ময়নার মাকে বল।’

‘উঁহু, ময়নার মা রেস্ট নিচ্ছে। আর তুই মাকে পানি খাইয়ে যে সওয়াব পাবি সেটা কি ময়নার মা আমাকে পানি দিলে পাবে? উফ, যা তো!’

কেমন পা টেনে টেনে মুখ ব্যাজার করে ইবু চলে যাচ্ছে পানি আনতে, মায়া লাগছে নিতুর। খাওয়া নিয়ে এত বায়নাক্কা হাড় জিরজিরে ছেলেটার। পানি দিয়েই আবার মায়ের গা ঘেঁষে বসল ইবু। আহারে, ছেলেটা মায়ের আদরের এত কাঙাল, নিতুর চোখ জ্বালা করে উঠল। শ্বশুর মারা যাবার পরই চিলেকোঠায় আলাদা সংসার পাততে হয় জা আর ভাসুরের তাগিদে। রায়হানের এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে ব্যবসায় মার যাওয়া টাকা উদ্ধারের বিফল চেষ্টা আর প্রতি সন্ধ্যায় হেরে যাওয়া ধুলোমলিন চেহারা দেখতে দেখতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নিতু, নাহ, চাকরীর চেষ্টা করবে। সাদিয়ার স্কুলের বেতন আর ইবুর দুধের খরচটা তো যোগান দিতে হবে নিদেনপক্ষে।

অনলাইনেই এপ্লাই করত বেছে বেছে, ইচ্ছে ছিল স্কুলে পড়াবে। হয়েও গিয়েছিল, কিন্তু বেতনটা বড্ড কম। দশের বেশী কেউ অফারই করে না! পরে হুট করেই এক মাঝারী মাপের কম্পানিতে বনানীর হেড অফিসে চাকরীটা হয়ে যায় এডমিনে। শুরুতে বিশ, কয়েক দফায় বেতন বেড়ে এখন প্রায় চল্লিশের ঘরে পৌঁছেছে। হাসিমুখেই রায়হান নিতুর অনুপস্থিতি সামাল দিয়েছে, বাচ্চাদেরকে সঙ্গ দিয়েছে, তবে প্রতি সকালে নিতু যখন ব্যাগ কাঁধে তুলে বিদায় নেয় তখন কেন যেন চেহারার হতাশা কিছুতেই লুকাতে পারে না রায়হান।কি অবলীলায় নিতু রায়হানের দায়িত্বগুলো মুখ বুজে বয়ে চলছে বছরের পর বছর, আর সে বুকজুড়ে হাহাকার নিয়ে হতাশাগ্রস্থ মানুষের মতন অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে।

‘মা, আমার বিয়ে কয় বছর পর?’ ইবু সরল মুখে মাকে প্রশ্ন করল, জানে মা আপুর মতন তাকে নিয়ে ঠাট্টা করবে না।

‘কেন রে? কাউকে কথা দিয়ে ফেলেছিস নাকি?’ হাসি হাসি মুখে নিতু পাল্টা প্রশ্ন করল।

‘বল না, মা। আপুর আগে, না পরে?’

‘তুই চাইলে আজকেই বিয়ে দিতে পারি, ব্যাটা। এক কোলে আমার সাদিয়া মা, আরেক কোলে ইবু আর ব্যাটার বউ ঘাড়ের উপর বসায় আমি চিড়িয়াখানা যাব, কি বল, নিতু?’ রায়হানের গলায় দুজনে দরজার দিকে ফিরে তাকালো।

‘বাবা! জানো, কালকে মুনির বলেছে যার যত পরে বিয়ে হয় তার মাথার চুল তত তাড়াতাড়ি পড়ে যায়!’

একদফা হাসাহাসির পর ইবুকে ঘরের সাথে লাগোয়া ছাদে খেলতে পাঠিয়ে নিতুর মুখোমুখি হয়ে বসল রায়হান। তার দু হাত হালকা কাঁপছে, কপালের নীলচে শীরা ফুলে আছে,নিতু লক্ষ্য করল।

‘নিতু, ভাইয়ার নামে মামলা দায়ের করেছি। এ মাস থেকেই কোর্ট কাছারি শুরু। অনেক ভেবে দেখলাম, আব্বা কখনোই মানত না এই জোচ্চুরি। বাবার রেখে যাওয়া সম্পদে আমার লোভ নেই, নিতু তোমার চেয়ে ভালো আর কে জানবে, বল? কিন্তু আমি আর মাথা নিচু করে বাঁচতে চাই না।’ গলা ধরে এলো রায়হানের।

মাথায় আস্তা ফ্যান খুলে পড়লেও এত অবাক হত না নিতু। বার বার থামিয়ে দেবার পর অভিমানে যে কথা নিতু আর ভুলেও তুলে নি বিগত কয়েক বছর ধরে, আজ রায়হান নিজেই সে কথা তুলে রণক্ষেত্রে নামার ঘোষনা দিচ্ছে!

‘কিন্তু,’ আমতাআমতা করতে লাগল সে, ‘এসব মামলায় প্রচুর খরচাপাতির ব্যাপার থাকে। আমরা, মানে..’

‘নিতু, সাহস পেয়েছি বলেই তো পা বাড়িয়েছি। তোমাকে বলি নি, সামনের মাস থেকে আমার সেন্ট্রাল মেট্রোতে লেকচারার হিসেবে জয়েনিং। এতদিন ব্যবসা ছাড়া কিছুই ভাবতাম না, কিন্তু সাদাত যখন অফারটা দিল, সত্যি মনে হল I am still worth something. ও তো ইকোনমিকসের হেড অফ ডিপার্টমেন্ট ওখানে। খুব উৎসাহ দিল, নিজেই সব কাগজপত্র ফিল আপ করে ইন্টার্ভিউতে ডাকল।’

‘তারপর?’ বুক ধুকপুক করছে নিতুর। স্বপ্ন দেখছে নাকি?

‘বললামই তো।’ একগাল হেসে বলল রায়হান, ‘হয়ে গেল, আলহামদুলিল্লাহ্‌। ও অবশ্য ছিল না ইন্টার্ভিউ বোর্ডে, বন্ধু বলে কথা। বেতন পঁয়ত্রিশের মতন, বেনিফিট আছে কিছু, এই তো। কেস চালিয়ে কত থাকবে জানি না, তবে মামলাটা আমি জিতব, ইনশাআল্লাহ।’ দৃঢ় গলায় রায়হান প্রতিজ্ঞা করল।

দ্রুত উঠে নিতু দু রাকাত শোকরানা নামাজ আদায় করল। মুনাজাতে কি চাইবে ভেবেই পেল না, হুট করেই যেন সব পাওয়া হয়ে গেছে না চাইতেই। অনেক ভেবেচিন্তে একটাই দুয়া আসল,

‘আল্লাহ্‌, প্রতিটি ছুটির দিন এমন দিয়েন, প্লিজ। আল্লাহ্‌, এমন বহু বহু অফুরন্ত ছুটির দিন যেন জীবনে বার বার আসে।’

#রৌদ্রময়ী_গল্প