ডপলগ্যাঙ্গার

টেবিলে তিন পদের ডেজার্ট দেয়া আছে। কেউ ছুঁয়েও দেখছে না। এই হাই প্রোফাইল বাসায় এসে মিলির চরম বিরক্ত লাগছে। সবকিছু এতো ফেইক। ডায়েটের নাম করে কেউ মিষ্টি ধরবে না , তবু টেবিলে দেয়া চাই। দিবি তো দে , একপদেরই না হয় দে। নাহ, লোভনীয় তিনরকম জিনিস !

লজ্জা ভেঙে ও নিতেও পারছেনা সবার আগে। কিন্তু ওর ইচ্ছা করছে তিন পদের জিনিসই টেস্ট করার। সেটা করা যাবেনা। নইলে এলিট আন্টিরা চোখের চাহনিতে বুঝিয়ে দিবে ও ম্যানার্স এর ‘ম’ ও জানেনা।

“চল , যাবা? একসাথে গেলে খারাপ লাগবে না , গল্প করতে করতে নিবো, অড লাগবেনা।”

ওর মনের কথা এমন আচানক কে বুঝতে পারলো , চমকে পিছনে তাকালো মিলি।

কোথায় যেন দেখেছে এই মুখটা?
কত বয়স হবে ?
ওরই বয়সী মনে হয়, ওরই মত।

মিলি হঠাৎ ধরতে পারলো ওর সাথে চেহারায় অসম্ভব মিল আছে এই মেয়েটার তাই এতো চেনা লাগছে। সেইম কালো ফ্রেমের চশমা আর অবয়ব। দুজনে একসাথে হাটলে টুইন টাওয়ার না ইয়ে টুইন মৈনাক পর্বত লাগবে আর কি।

এই মেয়েটার সাথে ভাব হবে মনে হচ্ছে। দুজনেরই একটা কমন সফ্ট কর্নার আছে। স্টাইলিশ, চুল রং করা, হাড়গিলে মেয়েগুলার থেকে আলাদা।
কোনোকালেই যাদের সাথে মিশে ও আরাম পায়নি।

“হাই! হ্যা চলো?” ভাবনাগুলো একপাশে সরিয়ে রেখে বললো মিলি ।

“উমম হ্যাভ উই মেট বিফোর?” জিগেশ করলো মেয়েটা।

“আই গেস নোপ , আমি অলওয়েজ মার ফ্রেন্ড সার্কেল পার্টি এভোয়েড করি , আজ যে কি ভেবে আসলাম ..ছাতা”

“হুম , ইন্টারেষ্টিং! তোমার আর আমার দেখি একই কাহিনী। এই পার্টিগুলা কেমন দমবন্ধ লাগে।

প্লেটে নিজের জন্য এক পিস্ কেক কাটতে কাটতে জিগেশ করলো মিলি,
“তোমাকে কেটে দিবো একটা পিস্? “

“ইয়েস প্লিজ , থ্যাঙ্ক ইউ। সাইড এর পিসটা দিও। বাইরের ক্রিমের লেয়ারটাও পাওয়া যায় এতে , আই জাস্ট লাভ ইট।” বলল অবিকল ওর মত দেখতে মেয়েটা।

“উইয়ার্ড , নিজের প্লেটেরটা খেতে খেতে ভাবতে লাগলো মিলি , এ খালি দেখতেই আমার মতো না , এর চালচলন ও যে সেইম সেইম!

টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে হাত বাড়ালো মেয়েটা
“বাই দ্য ওয়ে , আ ‘ম মিলি। ইটস আ প্লেজার মিটিং ইউ”

অ্যাঁ??
মনে মনে বিষম খেলো যেন মিলি। এর নামও মিলি !
“রিয়েলি?” হালকা সৌজন্য হেসে বললো ও। সো কোইন্সিডেন্টাল! আমার নাম ও যে মিলি!

“দেখসো মিলি মিলি কেমন মিলিয়া গেলো । হা হা হা “
হাসতে যেয়ে একটু কেক ছিটকে পড়লো আরেক মিলির মুখ থেকে।
মেয়েটা ফানি আসে তো ! ভাবলো মিলি।

“চলো চলো ঐদিকে যেয়ে বসি , আমাদের এভাবে সব ডেজার্ট খেতে দেখলে আন্টিরা থাবড়াবে ,বলবে হু উইল ম্যারি ইউ ? হা হা হা।” আবার সেই বিকট হাসি।

মেয়েটা টকেটিভ আর কথায় কথায় বিশাল আওয়াজে হাসে।

“বুঝছো , আমরা যত কম করেই মুখে দেই না কেন , সবাই বলবে দেখসো কত খাইতেসে।
হু কেয়ারস , তাই না ? তুমিও দেখি আমার মতো সাইড ওয়ালা পিস্ নিসো , ইজ চকলেট ইয়োর ফেভারিট ফ্লেভার ?”
“হুম। “
“আমারও ! বাহ্ আমাদের তো দেখি খুব মিল। ডপলগ্যাঙ্গার আমরা , বুঝস ? ডপলগ্যাঙ্গার কি জানো তো ? জার্মান ওয়ার্ড। মানে হলো ‘ডাবল ওয়াকার।’ একই রকম দেখতে আর চলন বলনে একই রকম দুই মানুষ !”

মিলি জানেনা আবার ? “রতনবাবু আর সেই লোকটা” নামের ওরকম একটা গল্প সে পড়েছে সত্যজিৎ রায়ের।

রতনবাবু হাওয়া বদল করতে আরেক শহরে গিয়ে কোইনসিডেন্টালি এমন একজনকে পেয়ে যায় যে পুরাই রতনবাবুর কপি। আর তার জীবনের সবকিছু আশ্চর্য ভাবে রতনবাবুর সাথে মিলে যায়। প্রথম প্রথম ভালো লাগলেও পরে অদ্ভুত রকম এক হিংসার জন্ম নেয় রতনবাবুর মনে তার ডপলগ্যাঙ্গার এর প্রতি।

“তোমার বার্থডে কবে ?”
মিলি ওর বার্থডে বলতেই আরেক মিলির চিৎকারে চমকে উঠলো।
“আর ইউ কিডিং মি ? দ্যাটস মাই বার্থডে ম্যান !
সো উইয়ার্ড। সো উইয়ার্ড।”

উইয়ার্ড তো বটেই।
মিলি মনে মনে যেটা ভাবে এই মেয়ে সেটাই ওর আগে বলে দেয়।

“তোমার নাম্বার দাও। “
মিলির হাতেই ফোনটা ছিল। ওরা নাম্বার আদান প্রদান করলো।
সেদিন বেশ গল্প জমলেও কেন জানি আর কখনো ফোন করা হয়নি ওই মেয়েটাকে মিলির।
একদিনের দেখাতেই ফোন দিবে ? কি না কি ভাবে আবার। থাক , ওই মিলিই নাহয় আগে দিক। এসব ভাবতে ভাবতে মিলির আর ফোনই দেয়া হলো না। একদিন ও ভুলেই গেলো এরকম কারো সাথে ওর দেখা হয়েছিল।

তারপর জীবনের অনেক মোড় ঘুরে মিলি আজকের দিনে পৌঁছেছে। টিন এইজের সেই মিলির সাথে আজকের মিলির কোনো মিলই নেই বলতে গেলে।
চিন্তা চেতনায় বিপ্লব ঘটেছে , জীবনধারায় পরিবর্তন এসেছে।
কালের পরিক্রমায় স্ত্রী হয়েছে ,মা হয়েছে , ম্যাচিউরিটি বেড়েছে।

স্মৃতি থেকে আরেক মৈনাক পর্বত মিলিও মুছেই গেছে প্রায়।

সাত দিন জ্বরে বেহুশ থাকায় মসজিদে যাওয়া হয়নি।

রিমিন ভাবী ফোন দিয়েছেন।
“কি ম্যাডাম একটু সুস্থ হলেন?” শুনো মসজিদের প্রোগ্রাম ক্যানসেল করিনি বুজছো ?
আরে জানোনাতো সেদিন কি বেয়াক্কেলই না হইলাম।”

কেন কি হয়েছে , ক্লান্ত গলায় জিগেশ করলো ও।
রিমিন ভাবী এখন ঘটনার খুঁটি নাটি বর্ণনা দিতে শুরু করবে , ভীষণ টায়ার্ড লাগছে
কিন্তু ভাবি যা বললেন তাতে নড়ে চড়ে বসলো ও।
স্মৃতির পাতায় একটা মুখ জলছাপের মতো ভেসে উঠলো। জলছাপটা আস্তে আস্তে গাঢ় হচ্ছে।

“চলে আসো সুস্থ বোধ করলে। তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবোনে।”

মসজিদে পৌঁছে করিডোরের শেষ রুমটায় দেখতে পেল ওরই মতো হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে একই ভঙ্গিমায় কথা বলছে কালো বোরকা আর ফুলেল স্কার্ফ পড়া একজন।একই গড়ন ,নো ওয়ান্ডার রিমিন ভাবি এনাকে মিলি ভেবে ভুল করেছে।

আজকের হালাকায় মিলির স্পিচ দেয়ার কথা ছিল। নোট রেডি করা ছিলো , রামাদান এর উপর। কিন্তু জ্বর বাধিয়ে বসায় ক্যান্সেল করতে রিকুয়েষ্ট করেছিল মহিলাদের প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর রিমিন ভাবীকে।
কিন্তু আজ এঁনার কথা শুনার পর প্রচন্ড আগ্রহে মিলি মসজিদে এসেছে।

ঠিক সেইম সেইম রেফারেন্স। সেইম স্পিকার আর তাফসীর ইবন কাসির থেকে নোট করেছেন ইনিও। একই পয়েন্ট গুলা বলছেন যেগুলো মিলি বলবে ভেবে ঠিক করেছিল।

প্রোগ্রাম শেষ সবাই কুশল বিনিময় করতে এগিয়ে গেলো।
‘ খুব ভালো হয়েছে টক্ টা। ‘
‘ অনেক উপকারে লাগবে আশা করি ‘ একেকজন একেক কমেন্ট করছে।
একটু ভীঁড় কমতেই এগিয়ে গেলো মিলি।

স্মিত হেসে বললো , “চিনতে পারছো ?”

“আপ্ .. তোমার নামও মিলি না ? আমার ডপলগ্যাঙ্গার ? ও রে ! কতদিন পর !”

“যাক, মনে আছে তাহলে? আর কেন কথা হলনা আমাদের? ফোন নাম্বার নিলা , জীবনেও তো ফোন দিলা না?”
“তুমিও তো দাওনি।”
“আমরা একই রকম ভাবছিলাম , তাই না? দুজনেই ভাবছিলাম অপরজন আগে দিক। তারপর দুজনেই বিস্মৃত হয়ে গেছি দুজনের স্মৃতি থেকে।”

“তোমার …তোমার এতো চেঞ্জ?” একটু কৌতুহল মেশান গলায় জিগ্যেস করল মিলি ।
স্কার্ট পড়া ২০ বছর আগের তরুণীটা কে কল্পনা করতে চেষ্টা করছে সে । হাপুস হুপুস করে চকলেট কেক খাওয়া আর হা হা করে হাসা।
হাসিটা এখনও অবশ্য একই রকম আছে।

“আমার চেঞ্জ এ অবাক হোচ্ছ যে বড় ? নিজের দিকে তাকিয়েছো? তুমি বোরকা হিজাব ধরলে আমার না ধরে উপায় আছে?”
আশ্চর্য !
বইয়ে পড়া গল্প ও যে কারো জীবনে এতো সত্যি হতে পারে কল্পনাও করেনি মিলি কস্মিনকালে।

“তোমার ছেলে ?”
মসজিদের কার্পেটে হুটোপুটি করা দুরন্ত বালকটিকে দেখিয়ে বললো আরেক মিলি।

“হুম আমার তিন নাম্বার জন। তোমার বাচ্চারা …. “বলেই ব্রেক কষে থেমে গেল। এভাবে এতদিন পর দেখা হয়েই হুট্ করে বাচ্চার কথা জিগ্যেস করাটা ঠিক হবেনা।
“হা হা। ডোন্ট ওরি। আমার গুলাও বাবার সাথে ছেলেদের হলে আছে।
বলা বাহুল্য আমারও তিন সৈনিক। জাস্ট লাইক ইউ।”

“এই যে , পরিচয় হইলো?”
রিমিন ভাবী এগিয়ে এসেছেন , “ভাবি আপনাদের দুজনের এত মিল! আরে আমি তো সেদিন কি অপ্রস্তুতই না হইলাম। সারপ্রাইজ দিতে যেয়ে পেছন থেকে চোখ ধরলাম , আর দেখি এই মিলি যে সেই মিলি না!

“এই মিলি ভাবী – জামান ভাই টেলিকম এর জব নিয়ে গত মাসে শিফট হয়েছেন এখানে।” বলে চলেছেন রিমিন ভাবী।
“পাশের সবার্বেই বাসা। আসে পাশে কোনও ইসলামিক প্রোগ্রাম হয় কিনা খোঁজ নিচ্ছিলেন। তোমার অসুস্থতার কথা শুনে বললো ওর কাছে নোট রেডি করা আছে একই টপিকে। অসুবিধা না হলে শেয়ার করতে পারে সবার সাথে ।
আমিও ভাবলাম এনাকে তো তুমি বলেই চালিয়ে দেয়া যাবে , ক্যানসেল না করি আর প্রোগ্রাম। হা হা হা। জাস্ট জোকিং !”

সবাই স্ন্যাক্স টেবিলের দিকে গেছে , এক কোনায় দুই মিলি বসেছে।

“কি ভাবছো ?”
“জীবনটা অনেক সময় গল্পের মতো হয়ে যায় না ?”
“রতনবাবু আর সেই লোকটা ?”
“আরে! তোমারও পড়া আছে গল্পটা!”
“আপনি যাহা পড়িয়াছেন তাহা আবার আমার না পড়া থাকে কিভাবে ? হা হা হা !”

“আচ্ছা বলতো সবকিছু রতনবাবুর মতো একই রকম হওয়া সত্ত্বেও ,রতনবাবু ওই লোকটাকে হিংসা করে কেন ? যেন সইতেই পারেনা অবিকল তার মত আরেকজনের এক্সিসটেন্স ! ধাক্কা মেরে আবার ফেলেও দেয় ব্রিজ থেকে। আবার নিজেও পরের দিন একই সময় একই ব্রিজ থেকে এক্সিডেন্টালি পড়ে যায়। একই নিয়তি ওদের। এমন স্যাড এন্ডিং দেয়ার কোনো দরকার ছিল ? কি উইয়ার্ড !”

“আমাদের এন্ডিং ও কিন্তু এমন।”

“মানে , চমকে তাকালো মিলি।”

“হা হা হা !
ভয় পেলে বুঝি ?”

“শোনো। ” বলে চলেছে মিলি নাম্বার টু।
“আমরাও হিংসে করবো , প্রতিযোগিতা করবো,
কিন্তু …ভালো কাজে !
ধাক্কা দিবো , গুতাবো ..তবে, ভালো কাজের তাগাদা দিয়ে।
আর ….এন্ডিং ও যেন হয় একই ভাবে একই জায়গায় সেই দুআ করবো। মানে ভাল মৃত্যুর মাধ্যমে জান্নাতে !”

আমীন ..আমীন ..বলতে বলতে দুইজনই হা হা করে হেসে উঠলো।

রিমিন ভাবী দৌড়ে এসেছেন ….”ওই আস্তে!”
উনার বরের নাম আবার আমীন ,
“এমন তারস্বরে আমীন আমীন করলে আমার জামাই ভয় পেয়ে ছুটে আসবে যে কি হলো। “

উনার কথায় আরেক দফা হাসির ঢেউ খেলে গেলো ঘরটাতে।
মসজিদে তখন আসলেই জান্নাতি পরিবেশ বিরাজ করছিলো।
একটু পরেই আজান দিলো। আজান আর ইকামাত এর মাঝের সময়টুকু দুআ করার সুযোগ লুফে নিলো সবাই।
দুই মিলিই দুআ করছে,
“ও আল্লাহ! জান্নাতে আমাকে আর আমার ডপলগ্যাঙ্গারটিকে একসাথেই রেখো !”

…………….

ডপলগ্যাঙ্গার
উম্ম ঈসা

(০৩/০৫/১৯)