থাবা (৩য় পর্ব)

৮.
“বুঝলি সাদিক, এইটা যে সত্যি বাঘে খাওয়া কেস হিসেবে প্রমাণিত হবে তা একবারও ভাবিনি! আমরা মিছেই এত সন্দেহ করলাম!”

ভাইয়ের কথায় কোন মন্তব্য করলো না সাদিক। বাঘের ব্যাপারটা তারা শুনেছে একটু আগে। যদিও উদ্ধারকৃত লাশটি দেখেই কাউকে সনাক্ত করার সুযোগ নেই, তবু সুন্দরবনের করমজল থেকে একমাত্র রনির নিখোঁজ হওয়ার রিপোর্ট থাকার কারণে ব্যক্তিটি যে সেইই এই ধারণা করছে পুলিশ। তাছাড়া পোশাকের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অংশ দেখেও নাকি মৌয়াল বা স্থানীয় কেউ মনে হচ্ছে না।

ইন্সপেক্টর আরো বললেন, “আমার তো এখন মনে হচ্ছে তিথীর কেসটাও সুইসাইড। কোন ক্লু তো পেলাম না মার্ডারের, যেহেতু কোন ব্রেক ইনের চেষ্টা হয়নি।”

“মার্ডারের জন্য তো আর সেটা মাস্ট না।” বললো সাদিক। শুনে অবাক হয়ে গেলেন আজাদ সাহেব।

-“কি বলতে চাস তুই? ঢুকলো কি করে তাহলে খুনি?”
-‎”দরজার চাবি থাকতে পারে তার কাছে।”
-‎”তার মানে কি-“

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই দারোয়ান এসে জানালো চার তলার সাহেব তাদের যেতে বলেছেন উপরে। তারা এসেছে রনির বন্ধু সজীবের বাসায়। ভাড়া করা একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে সে একাই নাকি থাকে।

সজীব দরজায় দাঁড়িয়েই ছিল। দুজনকে দেখে মৃদু হাসি এবং কাশি দিয়ে অভ্যর্থনা জানালো। সে তাদের দেখে মোটেও আনন্দিত না- এ কথা নিশ্চিত হলেও কোন বিরক্তি বা ভয়ের ছাপ তার চেহারায় নেই। মানে তার মনে যে কি আছে সেটা জানার সুযোগ নেই একদম!

কোন আলাদা ড্রয়িং রুম না থাকায় সজীবের রুমেই বসলো দুই মেহমান। সাদিক চট করে রুমটা পর্যবেক্ষণ করে নিলো। একটা চিকন খাট, একটা চেয়ার, একটা টেবিল, আর একটা আলনা আছে রুমে। টেবিলে কিছু ফাইলপত্র, পানির বোতল আর এন্টিবায়োটিক ওষুধের কয়টা পাতা। টেবিলের নীচে আবার একটা সাদা কাগজ গড়াগড়ি খাচ্ছে। একটু খানি অংশ পড়ে বুঝলো সাদিক ওটা ওষুধের প্রেসক্রিপশন।

সিভিল পোশাকের সাদিককে দেখে তার সম্পর্কে প্রশ্ন করায় আগের বারের মত ডিটেক্টিভ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন ইন্সপেক্টর আজাদ। এবারও মুখ দেখে বুঝার উপায় নেই লোকটা কি ভাবছে। কথা শুরু করলেন ইন্সপেক্টর, “সজীব সাহেব, আমরা কেন এসেছি তা হয়তো আপনি বুঝতে পারছেন।”
-“রনির বিষয়ে, তাইতো (কাশি)।”
-‎”হ্যাঁ, সে বিষয়েই। তা, আপনি তো দেখি ভালোই ঠান্ডা লাগিয়েছেন।”
-‎”জ্বী। গত তিনদিন ধরেই সর্দি কাশি। দুইদিন ধরে ওষুধ খাচ্ছি।”
-‎”ও আচ্ছা।”
-‎”যাইহোক, আমি কিন্তু আগেই বলে রাখছি, আমি রনির (কাশি) লাশ সম্পর্কে কিছুই জানিনা।”
-‎”আপনি না জানলেও আমরা জানি, সজীব সাহেব। আপনার বন্ধুর লাশ উদ্ধার হয়েছে করমজলেই। অবশ্য লাশের চেয়ে ওটাকে বাঘের খাবারের উচ্ছিষ্ট বললে বেশি ভালো হয়।”
-‎”ও মাই গড! রনি!”

সজীব দুই হাত দিয়ে চেপে মাথা নিচু করে বসে পড়লো একটা চেয়ারে। ইন্সপেক্টর আজাদ বললেন, “উই আর সরি ফর ইউ, মিস্টার সজীব। কিন্তু আমরা কিছু এডিশনাল ইনভেস্টিগেশন করছি যার জন্য এই মৃত্যুর বাইরেও আমাদের আরো কিছু ইনফরমেশন দরকার।”

-“যেমন?”
-‎”আপনি রনির ওয়াইফ তিথীকে চিনতেন?”
-‎”(কাশি) জ্বী, অবশ্যই চিনতাম। আমি, রনি আর তিথী একই কলেজ থেকে পাশ করি। আমরা ভালো বন্ধু ছিলাম। পরে রনি আর তিথীর প্রেম হয় আর সেখান থেকে বিয়ে।”
-‎”আপনার সাথে তিথীর যোগাযোগ কেমন ছিল? মানে ওর বিয়ের পরের কথা জানতে চাচ্ছি।”
-‎”যোগাযোগ ভালোই ছিল (কাশি)। যেকোন প্রয়োজনে আমাকে ফোন দিত তিথী।”
-‎”শুধু প্রয়োজনে?”
-‎”আপনি কি জানতে চাচ্ছেন আসলে?”
-‎”সজীব সাহেব, তিথীর মৃত্যুর পর ওর ফোনের কল লিস্টে সবচেয়ে বেশি বার আর কারো না, আপনার নাম এসেছে।”
-‎”ও, আপনারা তাহলে এই জন্য… আচ্ছা, তাহলে আপনাদের থেকে রাখঢাক করে লাভ নেই। হ্যাঁ, তিথীর শেষ কটা দিন ওর সাথে আমার অনেক বার ফোনে আলাপ হয়েছিল। তবে সেটা কোন আপত্তিকর কারণে না, সেটার জন্য দায়ী ওর স্বামী মানে আমার বন্ধু রনি!”

ইনস্পেক্টর আজাদ ও সাদিক নড়েচড়ে বসলো। সজীব কথার ভিতর অনেক বার কাশলো, তবু কষ্ট করে হলেও কথা বলা চালিয়ে গেল-

“রনির সাথে রিসেন্টলি তিথীর সম্পর্ক খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তিথীর একটা ছেলে হয়েছিল তা নিশ্চয়ই জানেন। ছেলেটা হয়েই কয়েক দিনের মাথায় মারা যায়। একটু সময়মতো হসপিটালে নিলে হয়তো বেঁচে যেত। তিথী ওর স্বামীর প্রতি ক্ষুণ্ন ছিল এজন্য। কিন্তু তারও আগে থেকে ওর স্বামীর প্রতি ওর ক্ষোভ জন্ম নিয়েছিল কারণ রনি একটা অবৈধ ব্যবসায় জড়িত হয়ে পড়েছিল শেষ কয়েক মাসে।”

এ কথা শুনে দুই ভাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। দুজনের মাথায় কি একই চিন্তা কাজ করছে এখন? ইন্সপেক্টর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি বলতে পারবেন কিসের বিজনেস?”

-“সরি, আমি তা জানি না। মোস্ট প্রবেবলি তিথীও জানতো না। রনি ওকে কখনো বলেনি। তবে ও টের পেয়েছে। রনির মোবাইল চুপি চুপি ঘেঁটে কিছু সত্যতাও পেয়েছিল। ও এই ব্যাপারে রনিকে জিজ্ঞেস করে ভীষণ তোপের মুখে পড়েছিল। তবু ও খুব করে চেয়েছিল যেন রনি অন্ধকার জগৎ থেকে ফিরে আসে। এ জন্য কম চেষ্টা করেনি। ভালো ভাবে বলে, মন্দ ভাবে বলেও কোন লাভ হয়নি। বরং ওর উপর অনেক টর্চার চালিয়েছিল রনি।”
-“আপনি বন্ধুকে কিছু বলেননি এ বিষয়ে?”
-‎”আমাকে তিথী বলেছে একথা বেশি দিন হয়নি। ও চায়নি আমি রনিকে এই ব্যাপারে কিছু বলি। তিথী চাইতো যেন রনিকে আমি নতুন কোন চাকরি ধরিয়ে দেই আর যেন কথা দিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঠিক পথে আনি।”

আরো কিছু টুকটাক কথা শেষে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো ইন্সপেক্টর এবং ডিটেক্টিভ। রুম থেকে বের হওয়ার সময় প্রথম বারের মতো মুখ খুললো সাদিক, “এন্টিবায়োটিক ঠিক সময় মত না খেলে তা অসুখকে আরো বিগড়ে দেয়। সজীব সাহেব, আপনি বোধহয় লাস্ট ডোজটা ঠিক সময়ে নেননি।”

সজীবের চোয়াল ঝুলে পড়লো এ কথা শুনে। আসলেই আজ সারাদিনে ওষুধ খাওয়ার কথা ভুলে গিয়েছিল সে, এতদিন পর আবার অফিসে গিয়েছিল বলে। কিন্তু এই ছেলে কি করে সেটা বুঝলো?

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আজাদ সাহেব তাঁর ভাইকে বললেন, “লোকটা আমাদের বড়ই উপকার করলো ইনফরমেশন গুলো দিয়ে, তাইনা বল?”
-“তা দিয়েছে। কিন্তু সব যে সত্যি সেটার কি গ্যারান্টি?”
-‎”তুই কি একেও সন্দেহ করছিস নাকি রে?”
-‎”তা তো করতেই হবে!”
-‎”কিন্তু সে তো তিথীর খুনি না। চাবি তো আর ছিল না তার কাছে।”
-‎”থাকতেও তো পারে। রনির বাসার মেইন দরজাতে চাবি দেয়ার সিস্টেম, ভিতরে ছিটকিনিও ছিল না, মনে পড়ে? রনির অভ্যাস ছিল হুটহাট আসা যাওয়া করা, তার মানে তার কাছে নিশ্চয়ই মেইন দরজার চাবি ছিল। আর রনির মৃত্যুর পর কোন ব্যাগের সন্ধান কি পুলিশ পেয়েছে? না। তার মানে, সেটা কেউ সরিয়েছে।”
-‎”বলিস কি! তাহলে তো এই সজীব নামের লোকটাকে সার্চ করা উচিত ছিল।”
-‎”লাভ নাই তাতে, আমরা তাকে জানান দিয়েই তার বাসায় গিয়েছি। ব্যাগ সরাতে তার কষ্ট হওয়ার কথা না।”
-‎”দিলি তো নতুন ভাবনায় ফেলে। আচ্ছা, খুনের কথা বাদ। ওই জালিয়াতির কেস টার কথা বল। এলভিস আর. চৌধুরী কি রনিরই নাম?”
-“আমার মনে হয় না। তবে নিশ্চিত হতে গেলে আরো তথ্য লাগবে। আর এ ব্যাপারে তোমার হেল্প লাগবে, ভাইয়া।”

৯.
ক্লাস শেষে সাদিক হেঁটে হেঁটে তার বাসায় ফিরছে। আজ ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যাই হয়ে যাবে। তার সচরাচর এত দেরি হয়না, কিন্তু আজ হলো। কারণ আজ ক্লাস শেষে সে এক জায়গায় গিয়েছিল স্বশরীরে কিছু তথ্য জোগাড় করতে। অনেকটা সময় গেছে সেখানে, তবু যেটুকু নিজের সাধ্যের ভিতর আছে তা নিজেই করার চেষ্টা করছে, বাকিটা পুলিশ ভাইকে বুঝিয়ে দিয়েছে। আর তার ভাইও কথা মত কাজ করে তার তদন্তে অনেক সাহায্য করছেন।

আজাদ সাহেব অবশ্য তাও উদার চিত্তে সাদিককে প্রশংসা করেন। আজ দুপুরে যখন আর. এন. আর. ইন্স্যুরেন্সের রহস্য উন্মোচিত হলো, তখন তিনি সাথে সাথেই সাদিককে ফোন দিয়ে বললেন-

“জানিস, তুই যা যা বলেছিলি একদম সব হুবহু মিলে গেছে! যারা মামলা করেছিল তাদের থেকে সাক্ষ্য নেয়া গেছে। তোর লুকিয়ে তোলা ওই দুই ভাইয়ের ছবিটা খুব কাজে দিয়েছে। ঐটা দেখেই ওরা সনাক্ত করেছে ইন্সুরেন্স এর মূল দুই কালপ্রিটকে। আমিও বুঝেছিলাম রনিই মূল হোতা, কিন্তু ম্যানেজার এলভিস চৌধুরী যে ওর ভাই রবিন এটা বুঝিনি। কি আশ্চর্য, রবিনের রুমে এলভিস প্রিসলির ছবি দেখে তুই বুঝে গেলি ওটা ওরই ছদ্মনাম ছিল! ইউ আর জিনিয়াস! মা শা আল্লাহ।”

এসব শুনলে সাদিক অস্বস্তিতে পড়ে যায়। সে খালি খুঁজে পাওয়া সব ক্লু কাজে লাগিয়ে কিছু অনুমান করেছিল যেগুলো ঠিক প্রমাণিত হয়েছে। তার ভাই তথা পুলিশের সহযোগিতা না পেলে সেসব প্রমান করা কষ্টকর হয়ে যেত।

যদিও আসল রহস্য এখনো উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। সুন্দরবনে এক্সিডেন্ট নাকি খুন? ঢাকায় সুইসাইড নাকি খুন? এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর এখনও পাওয়া বাকি। তাছাড়া আর এন আর ইন্সুরেন্স এর লোপাট করা বিশাল অংকের টাকাও এখনো পর্যন্ত উদ্ধার হয়নি। আজাদ সাহেব যদিও আশাবাদী রবিনের মাধ্যমে তা উদ্ধারের ক্ষেত্রে, কিন্তু সাদিকের মনে হচ্ছে ব্যাপারটা তত সহজ হবে না হয়তো। আবারও তার অনুমান সঠিক প্রমাণিত হলো তার ভাইয়ের দেয়া এসএমএস থেকে-

“Robbin is missing. No clue to his whereabouts so far.”

ব্যাস, এবার যোগ হলো নতুন রহস্য। কোথায় পালিয়েছে রবিন?

হাঁটতে হাঁটতে মনের মধ্যে করা অনেক হিসাব নিকাশের পর এত সব রহস্যের জট প্রায় খুলেই ফেলেছে সাদিক। শুধু একটামাত্র খটকা, সেটা বুঝতেই পারছে না কিছুতে। এ যেন একটা পাজল মিলানোর সময় মাঝের টুকরা টারই অভাব!

সেই খটকা নিয়েই চিন্তা করার সময় হঠাৎ করে সাদিকের মাথায় প্রচন্ড জোরে আঘাত করলো কি যেন! তারপর নিমিষেই অন্ধকার হয়ে গেল তার চারিদিক!