দাওয়াহ

সকাল থেকেই খুব ব্যস্ততায় সময় কেটেছে। ক্লাস থেকে ফিরেই দেখা গেলো আম্মুর অবস্থা খারাপ। আর একটু দেরি হলেই না জানি কি হতো। আলহামদুলিল্লাহ্‌। তাও খুব দেরি হয়নি। এই পাড়ায় নতুন। বাসা চেঞ্জের এতো কাজের কারণে প্রেশার বেড়েছে অনেক। ডাক্তারের কাছে নেয়ায় ওষুধ দিয়ে দিলো।

ভাবতেই এখন অবাক লাগছে। কোন মতে কাঁধের ব্যাগ রেখে আম্মুকে নিয়ে বের হয়েছিলো। বাকিটা কিভাবে কিভাবে যেন আল্লাহ্‌ই ব্যবস্থা করে দিলেন। তিন তলা থেকে আম্মুকে ধরে ধরে নামাচ্ছিলো নুজহাত। কোনো মতে দ্বিতীয় তলায় নেমে সামনে পড়লো টুম্পা। কিছুক্ষণ পরই টুম্পা ওর আম্মুকে ডেকে নিয়ে এলো। টুম্পার আম্মু আর নুজহাত দু’জন ধরে ধরে নামালো আম্মুকে। পাড়া-প্রতিবেশি কারো সাথেই এখনো তেমন পরিচিত হওয়া হয়নি। অথচ কত মানুষকে আজ আল্লাহ্‌ পাঠিয়ে দিলেন ওর সাহায্যে। বাসা থেকে নীচে নামতেই একটা সিএনজি এসে নুজহাতের সামনে দাঁড়ালো।

কোনো সাত পাঁচ না ভেবেই নুজহাত সিএনজি-তে উঠে পড়লো ও হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললো। সিএনজি এর দরজা লাগাতে যাবে এমন সময় এক জন অল্প বয়সী মেয়ে হুট করে সিএনজি-তে উঠে বসলো ও বললো, “আপু, আপনি একা পারবেন না। আমিও যাই আপনার সাথে।” নুজহাত কিছু বুঝে উঠার আগেই সেই মেয়েটা টুম্পার আম্মুকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো, “আন্টি, আপনি আম্মুকে বলে দিবেন যে আমি নতুন ভারাটিয়া দের সাথে গিয়েছি।”
টুম্পার আম্মুও সায় দিয়ে বললো, “হ্যাঁ! তুমি যাও।”

নুজহাতের মনে পড়ে বাসা যেদিন চেঞ্জ করেছিলো সেদিনই টুম্পার সাথে রাস্তায় দেখা হয়েছিলো। নুজহাত অভ্যাস বসত পিচ্চি টুম্পাকে দেখা সালাম দিয়েছিলো। রাস্তায় অপরিচিত ও বয়সে বড় কেউ সালাম দেয়ায় টুম্পা কিছুটা ভয়ার্ত চোখে তাকায়। তবুও সালামের জবাব দেয় ও জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি মিলি আপু?”
“না, আমার নাম নুজহাত। তোমার?” আদর জড়ানো কন্ঠে উত্তর দেয় নুজহাত।
এভাবেই পরিচয় টুম্পার সাথে। টুম্পার ভারী স্কুল ব্যাগটা সেদিন বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলো নুজহাত।

অল্প বয়সী মেয়েটা জেরিন। এবার কলেজে ভর্তি হবে। জেরিনের সাথে আগে থেকে পরিচয় ছিলো না। তবে ক্লাসে যাবার সময় জেরিনের সাথে পথে দেখা হতো ও নুজহাত অভ্যাস বসত সালাম দিতো। আজই আম্মুকে নিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে ওর নাম জানতে পারলো।

আর সিএনজি-টা সেই সিএনজি যেটায় করে বাসা চেঞ্জ করার সময় ওরা এসেছিলো। খুব গরম ছিলো সেদিন। তাই সিএনজি ড্রাইভারকে এক গ্লাস ঠান্ডা সরবত দিয়েছিলো। ড্রাইভার ওদের দেখে চিনেছে। হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে ও এতক্ষণ অপেক্ষা করে নিয়েও এসেছে।

হাসপাতাল থেকে ফিরে আম্মু এখন ঘুমাচ্ছে। আম্মুকে দেখতে এসেছিলো টুম্পার আম্মু, জেরিন ও জেরিনের আম্মু। আম্মু ঘুমাচ্ছে শুনে নুজহাতের সাথেই কিছুক্ষণ গল্প করে চলে গেলো সবাই। অনেক কথার মধ্যে দু’টি কথাই নুজহাতের কানে বাজছে।

“তুমি নাকি টুম্পার ব্যাগ নিয়ে এসেছিলে সেদিন? জানো, সেদিনের পর থেকে টুম্পার আব্বু অফিস থেকে ফিরলে টুম্পা দৌড়ে গিয়ে ওর আব্বুর ব্যাগটা নিজে নিয়ে আসে। তাই তো আজকে যখন দেখলো যে তুমি কাউকে ধরে নীচে নামছো ওই আমাকে টেনে টেনে নিয়ে গেলো।” বলছিলো টুম্পার আম্মু।

“জানো, আপু। আমি এই হাদীসটা আগে থেকেই জানতাম যে শুধু পরিচিত না অপরিচিতদেরও সালাম দিতে হয়। কিন্তু লজ্জা লাগতো তাই অনেক সময় পরিচিতদেরও সালাম দিতাম না। কিন্তু সেদিন যখন তুমি সালাম দিলে। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। এর পর থেকে নিজেও অপরিচিত পরিচিত সবাইকে সালাম দিতে শুরু করেছি। মনে হচ্ছিলো ওই আপু পারলে আমি কেন পারবো না।”

ছোট্ট একটা কাজ কিভাবে সবার মাঝে প্রভাব ফেললো তা ভেবেই অবাক হচ্ছে নুজহাত। এক আপু একবার বলেছিলো মুখে দাওয়াহ্‌ না দিয়ে নিজের কাজের মাধ্যমে দাওয়াহ্‌ দেয়ার চেষ্টা করবে। সেটাই সবচে’ বেশি ফলপ্রসূ। কথাটা সত্যি। তাই হয়তো সাহাবাদের দেখেই অনেকে ইসলাম গ্রহণ করতো। আমাদের কোন কাজ কার মাঝে কিভাবে প্রভাব ফেলবে তা বুঝা সত্যিই খুব কঠিন। রাসুল(সাঃ) যখন তায়েফে দাওয়াহ্‌ দিতে গিয়েছিলো তখন শুধুমাত্র খাওয়া শুরু করার আগে ‘বিসমিল্লাহ্‌’ বলেছিলেন। তাতেই একজন দাসের অন্তরে বিশ্বাসে বীজ বপন করা হয়েছিলো।

ভাবতে ভাবতে ছোট্ট একটা প্রশান্তির শ্বাস নিলো নুজহাত। সত্যিই সুন্নাহ্‌ নিজেই দাওয়াহ্‌!

……………………………

দাওয়াহ্‌
– নুসরাত জাহান মুন

(১৫/০৩/২০১৯)