নিজের ঘর

১.

শ্বশুরবাড়ির দরজায় পা রাখতেই নীলু হঠাৎ খেয়াল করলো তার মারাত্মক খিদে পেয়েছে। অথচ বের হওয়ার সময় মা নিজে ভাত মেখে খাইয়ে দিয়েছেন। টেনশনে সে খেতে পারছিল না, কোনমতে গিলেছে আর গজ গজ করেছে।

-মা বাজে মোটে সাড়ে বারোটা। এই সময় কেউ লাঞ্চ করে?
– খেয়ে যা সোনা। ও বাসায় হাজার কাজে কখন না কখন খাবি। তুই না খেয়ে গেলে আমার গলা দিয়ে ভাত নামবে না।
– তোমার গলা দিয়ে ভাত নামানোর জন্য আমাকে বড়ই যন্ত্রণা দিচ্ছো কিন্তু।
– থাক, মায়ের জন্য একটু যন্ত্রণা নিলে কিছু হয় না।

……

বেল বাজাতে দরজা খুলে দেন রাবেয়া বেগম, নীলুর শাশুড়ি।

-এত দেরি করলে কেন মা?

নীলু নার্ভাস ভাবে হাসে। জবাব মাথায় আসছে না। দুপুরে কি রান্না হবে আজকে? রুমে বিস্কুটের ডিব্বায় একটা এনার্জি প্লাস বিস্কিটের প্যাকেট ছিল। তবে রনি যদি রাত জেগে অফিসের কাজ করে তবে প্যাকেট খালি পাবে নির্ঘাত। কি ছাইপাশ ভাবছে। আশ্চর্য। বাসায় পা দেওয়ার আগে এই খিদে কই ছিল? ওঠার সময় নিচের দোকান থেকে এক প্যাকেট বিস্কিট কিনলেও তো হতো।

বিয়ের দু’মাস হয়েছে নীলুর। এখনো সে ঠাহর করতে পারেনা তার সীমারেখা কতটুকু। মায়ের কাছে থাকতে মা একটু পরপর একটা না একটা খাবার এনে সাধাসাধি করেন। ফ্রিজ ভর্তি খাবার। কিন্তু কেন যেন কিছুই নিজে থেকে নিয়ে খায় না সে। খিদেই পায় না।

আর এ বাসায় নিজের খাবার নিজে খেয়ে নিতে খুব লজ্জা লাগে। অসময়ে খিদে পেলে ফ্রিজ থেকে কিছু বের করে খেতে দারুণ অস্বস্তি বোধ করে সে।

এটা সেটা ভাবতে ভাবতেই রুমে ঢোকে। ফ্রেশ হয়ে বিস্কিটের ডিব্বা খোলে। খালি। রুম থেকে বের হয়ে আসে। পেটের মধ্য ইঁদুর বিড়াল যুদ্ধ করছে। হাজার অস্বস্তি ঠেলে ডাইনিং টেবিলের উপরে থাকা ফলের ঝুড়ি থেকে একটা আপেল নেয় সে। আপেলটা খেয়ে রান্নায় হাত লাগাবে। ভাবতে ভাবতে কিচেনে ঢোকে ফল কাটার ছুড়ির জন্য। ঢুকতেই মরিয়মের মা তাকে শুনিয়ে শাশুড়িকে বলে ওঠে,

খালাম্মা, আফনের বউমা দেহি আইস্যাই মুখ নাড়ান লাগসে।

বুয়ার খোঁটা খেয়ে মরমে মরে যায় নীলু।

২.

-আপুউ, আইশা আমার নোট খাতা ছিঁড়ে ফেলেছে।

লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে সুমির। আইশাটা কবে একটু বুঝবে। কি সব যে করে। সারাদিন ছুটছে, ভাংগছে, ছিঁড়ছে, ফেলছে। তিন বছরের বাচ্চা সামলানোর চেয়ে ১০০জন বড় মানুষ ম্যানেজ করা সহজ মনে মনে ভাবে সুমি।

তিনবছরের একটা বাচ্চার নিজের জগত থাকে। সেই কম্ফোর্টেবল জগত থেকে তাকে উপড়ে নিয়ে আসা হয়েছে। এই কারণে রাগও করতে পারেনা মেয়ের সাথে। ছয়মাস হলো আইশার বাবার সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে সুমির। এরপর থেকেই বাবার বাসায়। বাবা, মা আর ছোট বোন রুমি সাদরে গ্রহণ করেছে সুমির প্রত্যাবর্তন। মনের ভুলেও এমন কিছু কেউ কখনও বলেনি যাতে সুমি কষ্ট পায়।

কিন্তু সুমি নিজেই অস্বস্তিতে ভোগে। বিয়ের আগে রুমি একটা কথা বললে সুমি পালটা জবাব দিতো। বোনে বোনে কত কথা কাটাকাটি করতো। মা এসে রেফারির ভূমিকা পালন করতেন।

আর এখন কথা কাটাকাটি তো পরের কথা কেউ মুখ কালো করে ফেললেও সুমির মনটা খচখচ করে। কেন যেন বাড়িটা আর নিজের লাগেনা, সেই আগের মত। মানুষগুলোকেও দূরের মনেহয়। “সবাই পালটে গেছে।” মনে মনে ভাবে সে। জানেনা, সে নিজেই পাল্টেছে। আর পাল্টেছে সময়।

৩.

“তোর এত্ত বড় সাহস! আমাকে না জিজ্ঞেস করেই তুই মুসার রব্বকে মেনে নিলি? এত্ত বড় সাহস তোর।”

রাগে লোকটার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। থরথর করে কাপছে ক্রোধে। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না নাম, সম্মান, ঐশ্বর্য পায়ে ঠেলে তার স্ত্রী মুসার রব্বের প্রতি ঈমান এনে ফেলেছে।

তার রাগ দেখেও বিন্দুমাত্র বিচলিত দেখা যাচ্ছে না মেয়েটাকে। কি এক প্রশান্তি ফুটে উঠেছে চোখেমুখে। কে বলবে কী অবর্ণনীয় অত্যাচার করা হয়েছে তার উপর। যখন তার মৃত্যদন্ড ঘোষণা করা হলো তখনো তার চেহারা নির্বিকার, প্রশান্ত বরং বিড়বিড় করে কি যেন বলছে।

সে কি বলছে কোলাহলে কারো শোনার সময় হয়নি। কিন্তু তার রব্ব ঠিকি শুনেছেন। সপ্ত আসমানের উপর থেকে আরশের অধিপতি শুনেছেন তাঁর দাসী কি বলেছে। আরশের অধিপতি সেই কথায় এতই সন্তুষ্ট হয়েছেন, যে তিনি সেই কথা তাঁর পবিত্র কিতাবে লিপিবদ্ধ করে সম্মানিত করেছেন।

সে বলছিল,

رَبِّ ابْنِ لِى عِندَكَ بَيْتًا فِى الْجَنَّةِ وَنَجِّنِى مِن فِرْعَوْنَ وَعَمَلِهِۦ وَنَجِّنِى مِنَ الْقَوْمِ الظّٰلِمِينَ

‘হে আমার রব, আপনার কাছে আমার জন্য জান্নাতে একটি বাড়ি নির্মাণ করুন এবং আমাকে উদ্ধার করুন ফির’আউন ও তার দুস্কৃতি হতে এবং আমাকে উদ্ধার করুন যালিম সম্প্রদায় হতে।’

নিজের ঘর
নূরুন আলা নূর

জুন ২১, ২০১৮ইং