পহেলা বসন্ত

-নূরুন আলা নূর
১.
ঘুম থেকে উঠেই মন ভালো হয়ে গেলো শিফুর। আজকে পহেলা বসন্ত। ক্যাম্পাসে র‍্যালি, মেলা আরো কত কি। গত এক সপ্তাহ ধরে মার্কেট ঘুরে কাঁচি হলুদ রঙের শাড়ি কিনেছে। সেই সাথে ম্যাচিং ফুলের গয়নাও রেডি। শিফুরা সব বন্ধুরা মিলে দারুণ মাস্তি করবে আজ।

ঘুমাতে রোজ দুইটা আড়াইটা বেজে যায়। সকাল ৯/১০টার আগে উঠতে পারেনা কিছুতেই। কিন্তু আজকের কথা আলাদা। উত্তেজনায় সারা রাত ঘুমাতে পারেনি। সকালে মোবাইলটা এলার্ম দিতেই ঘুম ভেঙে গেল তার।

আজকে অনেক প্ল্যান – ভাবতে ভাবতে বাথরুমে ঢোকে, ফ্রেশ হয়, ব্রাশ করে। আজকের সাজটা আর সবার চেয়ে ভিন্ন হওয়া চাই। আজকে দেখতে সবার চেয়ে সুন্দর লাগা চাই। ঝটপট রেডি হওয়া শুরু করে সে বাথরুম থেকে বের হয়ে।

– মা কুচিটা বাঁকা হয়ে গেলো তো!

– কই বাঁকা হল! একদম সোজা পাটপাট করে ভাজ করে দিয়েছি।

– আরে না না আবার খুলে ঠিক করে দাও। ঠিকমত হয়নি।

– এত বুঝিস তো নিজে পরিস না ক্যান?

গজ গজ করতে করতে আবার কুচি খুলে ঠিক করে দেন রাবেয়া বেগম। মেয়ের এসব নখরার সাথে ভালো রকম পরিচিত তিনি। স্কুলে থাকতে এই মেয়েকে চুল বেঁধে দিতে কালোঘাম ছুটে যেত তার। এই পাশ উচু কেন, এই দিক নিচু কেন নানা বায়ানাক্কা করে বারবার চুল খুলে বেঁধে দিতে হত। মন মত হওয়ার আগ পর্যন্ত ঘ্যানঘ্যান করত। এখন তাও নিজের চুল নিজে বাঁধে। বাঁধে আর কি, স্ট্রেটনার দিয়ে সোজা করে নয়ত রোলার দিয়ে কার্ল। এই করে করে চুলের বারোটা বাজাচ্ছে।

শাড়ি পরে, মেকআপ করে নেয় ঝটপট। পাকা হাতে মেকআপ করতে খুব কম সময় লাগে শিফুর। চুল সেট করে ফুলের গয়না গায়ে দিয়ে বেড়িয়ে পরে সে।

২.
ক্যাম্পাসে ঢুকতেই উৎসবের ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে । সবাই রঙ বেরং এর পোশাকে। অধিকাংশই শাড়ি-পাঞ্জাবী। আর যারা শাড়ি/পাঞ্জাবী পরেনি, তারাও অন্তত লাল হলুদ পোশাকে এসেছে।

সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। কেউ মেলায় ঘুরছে, কেউ মেহেদি দিচ্ছে, পিঠা কিনে খাচ্ছে কেউ। আর অধিকাংশই ছবি তুলছে নিজেদের। শিফুও ব্যস্ত হয়ে যায় নিজের সার্কেল নিয়ে। এমা, মেহজাবীন, কণা, রাসেল, শাহেদ, ওরা শিফুর বন্ধু। তুই তোকারি সম্পর্ক সবার। যারা বলে, “ল্যাড়কা ওউর ল্যাড়কিকে বিচ কাভি দোস্তি নেহি হোতি” তাদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায় ওরা। কে বলেছে ফ্রেন্ডশিপ হয়না। ওরা তো ফ্রেন্ড ছাড়া আর কিছু ভাবেনা নিজেদের। যদিও মাঝে মাঝে শাহেদের এলোমেলো খাপছাড়া এসএমএস গুলো ভাবনায় ফেলে দেয় শিফুকে।

– এই শিফুর বাচ্চা, আরেকটু হলেই তো র‍্যালি মিস করতি।

– আরে ইউনির সামনের গলিতে মরার জ্যামেই তো এত লেট হয়ে গেল।

– আরে এসব পরে শোনা যাবে চল চল, শুরু হয়ে যাচ্ছে র‍্যালি।

প্রতিবছরেই বসন্ত মেলার মূল আকর্ষণ থাকে এই র‍্যালি। ঢোলের তালে হাটতে হাটতে কখন যে নাচা শুরু করে ওরা নিজেই বুঝতে পারেনা। মুখে মুখে হই হই বলে তাল দিচ্ছে সবাই। গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে, একে অন্যকে ডাকছে, ছবি তুলছে, হাসছে, আনন্দ করছে।

সবার হাতেই মোবাইল, ক্যামেরা। কার ক্যামেরায় কে বন্দী হচ্ছে বোঝা দায়।

– এই ফেবুর প্রোপিক তুলি চল চল।

– পাউট কর পাউট কর।

– এইবার ইনোসেন্ট ফেইস কর সবাই।

– এইবার দাঁত বের করে হাসি সবার।

– কোমরে হাত দিয়ে নাচের স্টাইলে দাঁড়া।

ছবি তোলা যেন শেষ হয় না। সবার মোবাইলেই তোলা হয় অসংখ্য গ্রুপ ছবি। আশেপাশের অপরিচিত মোবাইলেও নিজের অজান্তে কত ছবি উঠে যায় ওদের। কিন্তু সেসব ভাবার সময় কই।

৩.
– গাড়ি কই রাখসেন সোহেল ভাই?
– আপা, মেইন রোডে আইসা পড়েন, গলিতে গাড়ি ঢুকাইতে গেলে অনেক সময় লাগবে।
– মেইন রোডে! শাড়ি, হিল পরে এত দূর কেমনে আসবো!
– একটা রিকশা নিয়া আসেন আপা, গলিতে গাড়ি ঢুকাইলে বাসা যাইতে দেরি হবে।

ধুর সাতা। ফোন রেখে গজ গজ করে শিফু।
ক্লান্তিতে পা ভেঙে আসছে, কোমর ব্যথা করছে। সারাদিন হাইহিল পরে হাটাহাটি করায় পায়ের ব্যথা কোমরে উঠে এসেছে।

কোন রিকশা যাবে না এত কাছের মেইন রোডে। অগত্যা হেটেই রওনা দেয়। এত শখের শাড়ি ধুলায় মাখামাখি।

– আজকে ড্রাইভারের খবর আছে। গাড়িতে উঠেই ঝাড়ি দিবো। চাইলেই গাড়ি ভিতরে নিয়ে আসতে পারতো। না, মেইন রোডে পার্কিং করেছে।

মেইন রোডে আসতেই গাড়িটা চোখে পরে শিফুর। রাস্তার অপর পাশে পার্কিং করা। সোহেল ভাই গাড়ির সামনে দাঁড়ানো, শিফুকে দেখেই হাত নেড়ে ইশারা করে।

– আপা এই দিকে। (ইশারা করে ডাকে ড্রাইভার)

আজকে তোমার খবর আছে, গাড়িতে উঠে নেই দাঁড়াও।

মনে মনে গজগজ করতে করতেই রাস্তা পার হচ্ছিলো শিফু। রঙ সাইড থেকে আসা গাড়িটা খেয়াল করেনি সে। গাড়িটা শখের বশে ভার্সিটির কোন ছাত্র চালাচ্ছিল হয়তো। রঙ সাইডে যে আস্তে চালাবে, জোশের বশে খেয়াল ছিল না তার। গাড়িটা এসে যখন শিফুর গায়ে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল, তখনো শিফুর বিশ্বাস হচ্ছিল না এত সহজে মরে যাওয়া যায়।

মাথা দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। সুন্দর মুখটা কেমন বিকৃত লাগছে। এই মুখটার ছবি কত মানুষ তার মোবাইলে তুলে নিয়েছে, কত ফেইসবুক প্রোফাইলে আজ এই মুখটার হাসিমাখা ছবি থাকবে।

সব কিছু মিথ্যা প্রমাণ করে শিফু চলে যাচ্ছে। আর কোন সুযোগ রইলো না ভুলগুলোর জন্য ক্ষমা চেয়ে যাওয়ার, পাপ গুলোর জন্য ইস্তিগফার করার, গুনাহগুলো নেকীতে বদলে নেয়ার।

মৃত্যুর সাথে সাথে আমলের সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল শিফুর। তার নেই কোন সাদকায়ে জারিয়া যা মৃত্যুর পরেও তাকে নেকীর সৌভাগ্য দেবে। বরং সে তো সেইসব অভাগাদের দলে, যার মৃত্যুর পরেও গুনাহের খাতা চালু থাকবে।

তার ফেইসবুকের ছবিগুলো রয়ে গেল সব। পরিচিত-অপরিচিত মানুষের মোবাইলের ছবিগুলোও রয়ে গেল। তার পর্দা না করা এই ছবিগুলো যতদিন পরপুরুষদের সামনে পড়বে ততদিন তার গুনাহের ভাগ শিফুর আমলনামায় যুক্ত হতে থাকবে।

শিফু কখনো ভাবেনি মৃত্যু এভাবে আসবে। এত সহজে, এত দ্রুত। ভাবলে হয়ত জীবনটা অন্যভাবে গুছিয়ে নিতো সে। হয়ত ক্ষণিকের এই জীবনের তুচ্ছ হাসি আনন্দের কথা না ভেবে আখিরাতের অনন্তকালের জীবনের জন্য কিছু সঞ্চয় করে রাখতো ।

………..

পরিশিষ্ট

মুমিন পুরুষদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত।

আর মুমিন নারীদেরকে বল, যেন তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে। আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না। তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত করে রাখে। আর তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজদের ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাই এর ছেলে, বোনের ছেলে, আপন নারীগণ, তাদের ডান হাত যার মালিক হয়েছে, অধীনস্থ যৌনকামনামুক্ত পুরুষ অথবা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ছাড়া কারো কাছে নিজদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। আর তারা যেন নিজদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে। হে মুমিনগণ, তোমরা সকলেই আল্লাহর নিকট তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।

আল কুরআন, সুরা নূর

……………………..…..

#রৌদ্রময়ী_গল্প