প্রস্থান

একটা জমাট বাঁধা চিৎকার কেন যেন বার বার গলার কাছ পর্যন্ত এসে আটকে যাচ্ছে। আমি শুয়ে আছি আমার নিজের ঘরে। আমাকে ঘিরে জড়ো হয়েছে পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন অনেকেই। পুরো ঘরটাই কথায় গমগম করছে।

ঘরে ঢুকেছি খুব বেশিক্ষন হয়নি। এখন আমার পাশে আমার পুতুলটারও শুয়ে থাকার কথা ছিলো। কথা ছিলো ঘরটা ঠিকই গমগম করবে, তবে চোখে জল নিয়ে না, হাতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে। পুতুলটা ছোট্ট ছোট্ট হাত পা ছোড়াছুড়ি করতো অথবা কাঁদতো। অনেকে চোখ নাকের মিল খুঁজে পেত কোননা কোন আত্মীয়ের সাথে। মুরব্বীরা আবার আমাকে নানা উপদেশ দিতো।

কিন্তু তা হলো না…

আমার পুতুলটা বসার ঘরের ফ্লোরে শুয়ে আছে। খুব শান্ত হয়ে। সেদিনও তো আমার ভেতরে থেকেই দস্যিটা ফুটবল খেলতে কিক দিচ্ছিলো। অথচ আজ খুব শান্ত। কে যেন ওকে ধবধবে সাদা একটা কাপড় পড়িয়ে দিয়েছে। এইটুকু শরীরে এই রঙ ভালোলাগে!! আশ্চর্য!! মানুষগুলোর কান্ডজ্ঞান বলে কিছুই রইলো না।

কেউ কেউ এসে আমাকে বার বার বুঝাচ্ছে বলছে, “এভাবে পাথর হয়ে থেকো না… কাঁদো… একটু কাঁদলে ভালো লাগবে…”

আবার কেউ কেউ অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করছে। আমার শাশুড়ি এসে কিছুক্ষণ বিলাপ করে গেলেন। বিলাপের মধ্যে এমন সব কথা তিনি বললেন… ছিহ্‌…

তার কিছুক্ষণ পরই আমার ভাসুর এসে খুব বকাঝকা শুরু করলেন কেন আমার পুতুলটাকে বসার ঘরে রাখা হয়েছে এই নিয়ে…

আমার মাথায় কাজ করছে না যে আমার পুতুলটার বাবা কোথায়!! তিনি কেন কিছুই বলছেন না… একঘন্টার শিশু তাই বলে কি ওনার মনে “বাবা” অনুভূতিটা এখনও আসেনি… !!! আশ্চর্য!!

আমার প্রথম সন্তানের বয়স একঘন্টা… কেন যেন আমার চোখে কোনো পানি এলো না। কারো সাথে কোনো কথাও বলতে পারলাম না। সবটা আমার কাছে খুব ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে…

কালও তো সব ঠিক ছিলো। সন্ধ্যার দিকে শাশুড়ি মা বললেন ওনার কুটুম বাড়িতে পিঠা নিয়ে যেতে… আমার ননদিনির নতুন বিয়ে হয়েছে বলে কথা!! আমি যেতে রাজি হলাম না। একেবারে শেষ সময় এখন… কে শোনে কার কথা… বিয়ের পর আসলে মেয়েদের কথা বলার ক্ষমতাটাই থাকা উচিৎ না…

তারপর…

রাস্তায় সেই বাইক ঝাকুনি… প্রচণ্ড ব্যাথা… যন্ত্রণা… এ্যাম্বুলেন্সের শব্দ… ডাক্তার… নার্স… ছুটোছুটি… রক্ত… নদীর স্রোতের মত প্রবাহিত রক্ত… অপারেশনের মাঝ পথে হঠাৎ ডাক্তারের বলা, “আমি আর পারছিনা অন্য কোনো বড় হাসপাতালে নিয়ে যান।”

আমার পুতুলটা তখনো আমার ভেতরেই… এই অবস্থাতেই আবার এ্যাম্বুলেন্সের শব্দ… আবার ডাক্তার… নার্স… ছুটোছুটি… রক্ত… নদীর স্রোতের মত প্রবাহিত রক্ত… আর আমি সব দেখছি… আমার পেটের ভেতরটা হাতিয়ে ডাক্তার খুব ছোট্ট একটা পুতুল বের করলো…

ডাক্তার বললো বাচ্চা ভালো আছে। আমার ব্লিডিং বন্ধ হচ্ছে না। ভাবলাম যাক ও তো ভালো আছে। এবার আমি চলে গেলেও কোনো সমস্যা নেই। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে আমার ব্লিডিং বন্ধ হলো। কিন্তু ততক্ষণে আমার পুতুলটা চলে গেলো। অভিমান হয়েছে হয়তো ওর। হয়তো ভেবেছে এতক্ষণেও মা একবার কোলে নিলো না কেন! একটু আদর করলো না কেন! একবারও কি কপালে একটু চুমু খেতে পারতো না! একবারও কি একটু বুকে জড়িয়ে ধরতে পারতো না! বাবার মতই অভিমানী মেয়ে আমার!

প্রচণ্ড উত্তপ্ত একটা দিন। সবাই হাসপাস করছে। কোথাও কোনো পানি নেই। সূর্যটাকে যেন কেউ একেবারে এক হাত উপরে এনে লাগিয়ে দিয়েছে। ঘামে অবস্থা খারাপ অনেকেরই। এর মধ্যে খুব ছোট্ট একটা পুতুল এসে আমায় টেনে নিয়ে গেলো… এমন এক জায়গায় যেখানে কোনো উত্তাপ নেই। অদ্ভুত প্রশান্তি চারদিকে… আমার সেই দিনের কথা মনে পড়ে গেলো…

ধীরে ধীরে রাত গভীর হলো। ছোট্ট একটা দেহ… ওজন হয়তো ২.৫ কেজি হবে….. অথচ পৃথিবীসম ভার যার, সেই দেহ দাফন করে উনি ঘরে ফিরেছেন। আমি এখনও শুয়ে আছি… তিনি ঘরে ফিরে খুব সংক্ষেপে জড়ানো কন্ঠে বললেন, “ধৈর্য্য ধরো! এই ধৈর্য্যের প্রতিদান তুমি সেই দিন নিশ্চয়ই পাবে।”

হঠাৎ করেই এতক্ষণের গলার কাছে আটকে থাকা চিৎকারটা বুক ফেটে বেড়িয়ে এলো। তিনিও কাঁদছেন, আমিও।
.


প্রস্থান
নুসরাত জাহান মুন

(২৩/০৪/১৯)