ফোকাস

মিলি খুব যত্ন করে নিকনের লেন্সটা মুছলো। অনেক্ষণ ধরে সে ফোকাসটা আনতে চেষ্টা করছে , পারছে না। দু’টা ডলফিন ভাসছে গ্লাসের পানিতে, পিছনটা ব্লার করে কায়দা করে ছবিটা তুলতে হবে যাতে ডলফিন দুটো স্পষ্ট ফোকাসে থাকে। ব্যাকগ্রাউন্ড আর সাবজেক্ট দুটিই একসঙ্গে স্পষ্ট থাকছেনা। দুটি অবশ্য একসাথে ঝাপসা এসেছে অনেক গুলো ছবিতে , ওগুলো কাজের না, ডিলিট করে দিতে হবে।

আসলে পাতলা আবরণ দিয়ে গ্লাসের তলানি আলাদা করা , গ্লাস উল্টা করে ধরলেও পানি পড়েনা। মিলির ছোট খালা সৌখিন মানুষ, তার বাসায় অনেক মজার মজার শো পিস। তারই একটাকে সাবজেক্ট করেছে মিলি। এই হলো ডলফিন পানিতে ভাসার শানে নূযুল।

ছোট খালারা টু উইকস এর জন্য আরেকটা সিটিতে কাজে গেসে, তাই আপাতত ওরা এ বাসায়। বাসার সবকিছুই সাদা সাদা। বেশি সাদা ভালো লাগেনা মিলির। আপন আপন লাগেনা। কেমন একটা বৈরাগী ভাব। পড়ার জন্য কোনো বই পাচ্ছেনা সে। পুরো বাসায় শো পিস আছে মেলা পদের , কোনো বই চোখের সামনে নাই। রিপোর্টে গত দুদিন ধরে কিছুই ঢুকানো হচ্ছেনা। পারসনাল রিপোর্ট। প্রতিদিন কি করলো না করলো তার একটা লগবুক, ভালো লাগে মিলির এভাবে ডায়রিতে ধরে রাখতে। ঢাউস দুটো বিশাল দরজার হাতলে মোচড় দিল সে। ক্যাচ করে আওয়াজ করে খুলল ওটা , হোআইট হাউস টাইপের বাসা, এক কাবার্ডের মধ্যেই সংসার পাতা যাবে।

নিচের তাকে দু’সারি বই সুন্দর করে গুছানো। চোখ চকচক করে উঠলো ওর। নাহ কাজের কোনো বই নেই, সব হাবিজাবি। সামনের সারির বইগুলো পাচ বছর আগে দেখলেও নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে বসে পড়তো নিয়ে। হাতড়ে হাতড়ে পিছনে বেশ কয়েকটা ভালো মানের বই পায় ও। টেনে বের করে একটা। যাক দুটো হাদিস পড়া হলো, টিক দেয়া যাবে হাদিসের ঘরে। মাস শেষে ডায়রিটা ফুলফিল করতে না পারলে খুব মন খরাপ হয় ওর। কনসিস্টেন্সিটাই তো আসল, তাই না?

বইটা রাখতে গিয়ে সামনের সারিতে আবার চোখ গেল মিলির। নিজের মনেই ঠোটটা কেঁপে উঠলো তার। বইগুলো এখন আর কেন টানেনা ওকে? একসময় লেপের তলে, টেবিলের তলে, কত চলেছে ওসব, আম্মুর চোখ রাঙ্গানি উপেক্ষা করে। পড়া হয়ে গেছে একবার তাই? নাহ এই লেখকদের অনেক বই পড়েছে সে, কিন্তু এগুলোতো পড়েনি । টাইটেল সব মুখস্ত ছিল তার। নতুন বের হওয়া বই এগুলো।

সারাদিন একধরনের আতততৃপ্তি নিয়ে ঘোরে সে। চাইলেও ওগুলো তাকে টানতে পারবে না আর। অনেক ঘোরাঘুরির পর ফোকাস এখনো স্থির হয়েছে তার। যেটা স্পষ্ট আসার কথা সেটাতেই এসে স্পষ্ট হয়েছে লেন্স।

রাতে জামান ফিরলে একসাথে ভাত খায় ওরা। কিচেন গুছিয়ে, তকতকে করে উপরে উঠে মিলি। জামান ল্যাপটপে। ওর সাথে এখন কথা বলেও তেমন কোনো লাভ নেই। সারাদিন পর কেবল ল্যাপটপ এ বসেছে , অনেক কাজ।

ঘরে ঢুকে ফ্যান ছাড়ে মিলি। বিছনায় বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে হোআইট হাউস কাবার্ডের দিকে। যেন বোবায় ধরেছে ওকে। স্লিপ ওয়াকিং এর মত হেটে যায় সে , কাবার্ড খুলে , একটা বই হাতে নেয় , সামনের সারির বই! পাতার পর পাতা উল্টে যায়। জায়গা জায়গা এসে আছাড় খায় সে, মন বিদ্রোহ করে উঠে, না , এটা ঠিক না, এরকম তো না ব্যাপারটা। এরকম করে লিখলে সবাই তো এরকমই ভাববে। কেমন করে লিখল এমন কথা! রোমাঞ্চে না ঘৃনায় বুঝে উঠেনা কিন্তু মুখে থুতু জমে যায় ওর। সাদাসিদে লেখার পিছে নিজের সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে পাহাড়সম ঠাট্টা!

কখন যে শেষ হয়ে গেছে শ’খানেক পাতার ছোট গল্পের বইটা। বেশ আবেগী গল্প , মায়ায় ভরা, বুক মোচড়ানো। কেবল মাঝে মাঝে সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে করা ব্যঙ্গগুলি ওই দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখলেও চলবে। শেষের মলাটে লেখকের ছবি। তেলতেলে চেহারার চাদর পরা একজন সাধারণ ভদ্রলোক , যাকে দেখে তার মনে হত এত প্রতিভা কোথায় পেল লোকটা ? কখনো মনে হয়নি এ প্রতিভা যে তাকে দিল তাকে নিয়ে কি ঠাট্টাটাই না সে করছে। এখন স্পষ্ট দেখতে পায় মিলি , প্রতিভার নিচে প্রতিবন্ধিকে । পাতায় পাতায় আবেগ ছড়ানো মানুষটা,হায় তার রাব্ব এর ব্যাপারেই আবেগহীন হয়ে রইলো। চিনতে পারলনা।

‘দাজ্জালের ফিতনা’ নিয়ে খুব ক্লিয়ার আইডিয়া ছিল না মিলির যে ব্যাপারটা আসলে কি। একটা ঘন্টা নষ্ট করে সে অবশেষে বুঝতে পারল, সেই যে দাজ্জাল সবকিছুকে উল্টা দেখাবে, তার কপালেই তার পরিচয় লেখা থাকবে তাও মানুষ বুঝতে পারবেনা , শারমিন যখন বলছিল সে খুব অবাক হয়েছিল। লেখাই তো থাকবে তার কপালে সেই দজ্জাল, তাও কেন আমরা বুঝবনা!

মিলিরা অভিভূত হতে থাকবে, বিভ্রান্ত হতে থাকবে। লেখকদের কাজই নাকি মানুষকে বিভ্রান্ত করা। বলেছিল একসময়কার মিলির প্রিয় লেখক। আহারে, কেমন মায়ায় ভরা একেকটা লাইন, পড়ার পর মিলি কেমন অবশ অবশ হয়ে থাকত ভলোলাগায়। হাদিসের বইগুলি, বা ‘জান্নাতি দশ নারী’ কেমন পানসে লাগত, কনট্রাডিকটিং লাগত, কনফিউজিং লাগত !

কুরআনের আয়াত গুলোকে বড় খটমটে লাগতো । একপেশে লাগতো । মিলিকে অভিভূত করতে পারত না, তাকে টানতো না। তবু এলেবেলে চোখ বুলাত সে প্রায়ই । পড়লে যে সওয়াব আর না পড়লে যে আগুন এটুকু সে বুঝতো। তবে অতটা স্পষ্ট ছিল না।

দুটো ফোকাস, উপন্যাসে উপর পড়লে কুরআন স্পষ্ট হত না । কুরআন স্পষ্ট হলো, এখন উপন্যাসগুলি বেজায় ঝাপসা লাগে, কি লেখে এইসব হাবিজাবি ! অনেকদিন পর্যন্ত তার দুটিই ঝাপসা ছিল। আজকেও তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ফোকাস তো নাও আসতে পারত তার জীবনে, ভাগ্যিস তিনি মোডটা চেঞ্জ করে দিয়েছিলেন! দু হাত বুকের উপর চেপে ধরে সে। মনে হয় কে যেন উপর থেকে পরম মমতায় তাকে জড়িয়ে ধরেছে। এ মমতাও ছাপা প্রিন্টে পড়েই অনুভব করেছে সে।

চাঁদের আলো এসে পড়ছে মেয়েটার মুখে। অতটা তীব্র নয় , কেমন স্নিগ্ধ। চোয়াল শক্ত করে খট খট করে কি বোর্ড চেপে চলেছে সে। চৌদ্দ শত বছর আগে মানুষটা যে কাজের দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিল, সেই কাজে হতাশ হয়ে থেমে থাকলে চলবেনা। হুম, জানে সে অত বড় সাহিত্যিক হয়ত হতে পারবেনা, ফি বছর বইও বেরুবে না। কিন্তু দ্বিগুন আবেগ দিয়ে অনেক কিছু লেখবে সে। এগুলোই হবে ওর সাদকায়ে জারিয়া। হয়ত কোনো একদিন কেউ পড়বে , কেউ ফিরে আসবে , কে জানে! ওকে লিখে যেতেই হবে। রহস্যময়তার গোলকধাঁধায় যেন কেউ না হারায়। পিছনের সারির বইগুলো আস্তে আস্তে সামনের সারিতে জায়গা করে নেয়। নিবেই একদিন সে জানে। সময় যত লাগে লাগুক।

ফোকাস ঠিক করে ছবিটা সে তুলবেই।৷

ফোকাস
– উম্ম ঈসা

(১৯/০১/২০১৯)